#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#শেষ পর্ব
.
অদ্রিজা হাত দিয়ে চোখের জল মুছে লম্বা একটা শ্বাস নিচ্ছে। ওর গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এরপরে কী হয়েছিল সেটা জানার অনেক আগ্রহ থাকার পরেও জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছেনা কারণ কোন ভয়ংকর শেষ শোনার সাহস নেই ওর। তাই জিজ্ঞেস করেও করতে পারছেনা ভয়ে। আদ্রিয়ানও চুপ করে আছে আর এগোচ্ছেনা। ওর চোখের কোণে হালকা জ্বলজ্বল করে থাকা জলটা দু-আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিষ্টি দৌড়ে এসে আদ্রিয়ানের কোলে হাত রেখে বলল,
— ” বাবাই আইকক্লিম খবো। ওখানে এনেছে? ফুপা দেয়না, ফুঁপা পঁচা।”
আদ্রিয়ান উঠে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে মিষ্টির চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
— ” কাউকে পঁচা বলতে হয়না মা। এই ঠান্ডার মধ্যে আইসক্রিম খাওয়া ভালো না ফুপা তো তাই বারণ করেছে। ”
মিষ্টি মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” কিন্তু আমি খাবোই। আন্টি বাবাইকে বলনা আমি খাবো।”
অদ্রিজা মুচকি হেসে বলল,
— ” খাবেতো সোনা। বাবাই ঠিকই দেবে।”
এরমধ্যেই অভ্র আর জাবিন একপ্রকার দৌড়ে এলো। জাবিন বলল,
— ” দেখনা ভাইয়া কখন থেকে আইসক্রিম খাবে। কিন্তু তুই যদি বকিস তাই আমরা দেইনি।”
অভ্রও বলল,
— ” হ্যাঁ কখন থেকে বোঝাচ্ছি কিন্তু আপনার মেয়েতো। কারো কথা শোনেনা। বাপ-মা যেমন মেয়ে তো তেমনই হবে।”
জাবিন হেসে বলল,
— ” ভাবীও তো আইসক্র..”
আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” ওকে একটু আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে যাবো তুমিও এসো?”
অদ্রিজা ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল। মিষ্টি হেসে দিয়ে আদ্রিয়ানের গালে চুমু দিয়ে বলল,
— ” থ্যাংকু।”
আদ্রিয়ান হেসে ফেলল। অভ্র একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
— ” বাপড়ে আমার মামনীটা তো দেখছি হেব্বি ইংলিশ বলা শিখে গেছে।”
জাবিন একটা ভাব নিয়ে বলল,
— ” এটা আমার ট্রেনিং। তাই না মা?”
মিষ্টি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আদ্রিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে মিষ্টিকে নিয়ে গেল। অভ্র, জাবিন সাথে সাথে গেল। অদ্রিজা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ওও ওদের পেছন পেছন গেল। আইসক্রিম এর কাছে গিয়ে আদ্রিয়ান ও বাদে সবার জন্যেই আইসক্রিম চাইল। জাবিন আর অভ্র আদ্রিয়ানকে একবারও বলল না খেতে কারণ বলে লাভ হবেনা, আদ্রিয়ান খাবেনা। যার সাথে আদ্রিয়ান খাবে সে তো নেই। অদ্রিজা কিছু বলতে যেয়েও বলল না। তবে শুধু তাকিয়ে দেখছে এদের বন্ডিং। ডায়েরির প্রতিটা শব্দকে জীবন্ত দেখছে শুধু একটা মানুষেরই অভাব আছে। অনিমার অভাব। তাই হয়ত সবটা ফাঁকা লাগছে অদ্রিজার। ইস! যদি এখানে অনিমাও থাকত কত সুন্দর হত সবকিছু, সবটা দেখতে কত ভালো লাগতো। এসব ভাবতে ভাবতেই বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অদ্রিজার ভেতর থেকে। হঠাৎ করেই কেউ একজন মিষ্টির চোখ ধরল পেছন থেকে। মিষ্টি ‘কে?’ বলে উঠতেই সবার চোখ পরল ওদিকে। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, অভ্রর মুখে হাসি ফুটে উঠল, জাবিনতো খুশিতে চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। অদ্রিজা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর বয়সী একটা মেয়ে মিষ্টির চোখ ধরে রেখেছে। একটা লাল লং কুর্তি, কালো জিন্স পরে গলায় একটা কালো স্কার্ফ জড়িয়ে রেখেছে, পাশে একটা লাগেজ রাখা। মেয়েটার শ্যামবর্ণের, মুখে দারুণ মিষ্টি একটা হাসি ঝুলে আছে, সেই হাসিতে দুগালেই টোল পরেছে, ডান গালের টোলটা বড় হলেও বা গালের টোলটা ছোট, বা গালের ঠোঁটর কাছাকাছি দিকটায় একটা তিল, মুখে সেই সিগ্ধতা। এইরকমই এক রমনীর বর্ণনা অদ্রিজা পড়েছে, এই সবকিছুই যে ওর মনে গেঁথে গেছে। অদ্রিজার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে খুবই আস্তে ‘অনিমা’ শব্দটা বেড়িয়ে এলো। মিষ্টি সেই মেয়েটির হাত ধরেই যেন বুঝে গেল কে? খুশি হয়ে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
— ” মাম্মা।”
মেয়েটা হেসে দিয়ে মিষ্টির চোখ ছেড়ে ওকে কোলে নিলো, মিষ্টিও মেয়েটার গলা জড়িয়ে ধরল , মিষ্টি মেয়েটার গালে একটা চুমু দিল, মেয়েটাও মিষ্টির গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
— ” আমার সোনাটা আমাকে মিস করছিল বুঝি?”
মিষ্টি মাথা নেড়ে বলল,
— ” তুমি এত দেয়ী কললে কেন?”
মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,
— ” সরি সোনা। মাম্মার একটু আর্জেন্ট কাজ ছিল তাইতো চলে যেতে হয়েছে।”
এরপর মেয়েটা অভ্র আর জাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কী কেমন আছ?”
জাবিন এগিয়ে এসে আলতো করে আলতো হাতে হাগ করে বলল,
— ” জানো কতটা মিস করেছিলাম তোমাকে?”
অভ্র বলল,
— ” কিন্তু আপনার তো কালকে আসার কথা ছিল। কী সারপ্রাইজ দিলেন!”
মেয়েটা মুচকি হেসে জাবিনকে নামিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ান এখনও অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। মেয়েটা আদ্রিয়ানের কাছে গিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— ” কী মিস্টার? আমায় দেখে খুশি হওনি মনে হচ্ছে? একদিন আগে এসে অসুবিধায় ফেলে দিলাম বুঝি?”
আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। মেয়েটাও ধরল। অদ্রিজা নিশ্চিত হয়ে গেল এটা অনিমাই। তারমানে অনিমার কিচ্ছু হয়নি সেদিন। বেঁচে গেছিল? কিন্তু কীকরে? কিছুক্ষণ পর অনিমাকে ছেড়ে আদ্রিয়ান বলল,
— ” আজকে কীকরে?”
— ” আজকের দিনটা থাকার দরকার পরেনি তাই চলে এলাম। আর আমি জানতাম তোমরা এইসময় এখানেই থাকবে তাই সরাসরি এখানেই এলাম।”
আদ্রিয়ানের এখন অনিমাকে নিজের সাথে আরো কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখতে আরো কথা বলতে কিন্তু আপাতত সেটা সম্ভব নয় সবার সামনে। অনিমা সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” অাইসক্রিম খাচ্ছিলে বুঝি? আমারটাও নাও। আর এইযে মিস্টার আমি নেই বলে নিশ্চয়ই আপনিও আইসক্রিম নেননি। মামা আরো দুটো দাও তো।”
দোকানদার দুজনের হাতেই আইসক্রিম দিল।এরপর অনিমা মিষ্টির সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে বলল,
— ” এই যে বাবার প্রিন্সেস। এইকটা দিনতো দিব্বি কাটিয়েছেন মা কে ছাড়া। আর এখন মা এলো আপনিতো ঠিকভাবে পাত্তাও দিচ্ছেন না।”
মিষ্টি হেসে বলল,
— ” তোমার আগে আইকক্লিম খাবো।”
অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকাল, আদ্রিয়ান হেসে দিলো, অনিমাও হেসে দিয়ে মিষ্টির নাক টিপে দিয়ে বলল,
— ” জিতবোতো আমিই।”
বলে আইসক্রিম খুলে দ্রুত খেতে শুরু করল। আদ্রিয়ান কোমরে হাত দিয়ে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এবার দেখে বলোতো কে মেয়ে আর কে মা? আলাদা করতে পারছ?”
অদ্রিজা তো এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। এতক্ষণে ওর মনে হল যে না। ডায়েরিতে ও যা যা পরেছে সবটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। আদ্রিয়ানের ডাকে হুস এলো ওর। অনিমা অদ্রিজাকে চিনতে না পেরে ভ্রু কুচকে আইসক্রিম খেতে খেতে বলল,
— ” এটা কে?”
আদ্রিয়ান এরপর অনিমাকে অদ্রিজার সাথে আর অদ্রিজাকে অনিমার সাথে আলাপ করিয়ে দিল। আদ্রিয়ান বলল,
— ” তোমার এই ডায়েরিটা পুরোটাই পড়েছে ও। আর বাকি অংশও কিছুটা শুনেছে।”
অদ্রিজা অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ ম্যাম। প্রতিটা লাইন ফিল করেছি আমি। মনে হচ্ছিল সবটাই আমি প্রত্যক্ষ দর্শন করছি। কিন্তু আপনি সেদিন কীকরে বেঁচেছিলেন সেটাই এখনও… ”
সেদিনের কথা মনে পরতেই অনিমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। আদ্রিয়ান অনিমা একে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। অনিমা বলল,
— ” বলব আইসক্রিম টা শেষ করি?”
এরকম নানারকম কথা বলতে বলতে সবাই আইসক্রিম খাওয়াটা শেষ করল। আইসক্রিমটা শেষ করে অনিমা জাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তোমরা মিষ্টিকে নিয়ে ঐ মাঠের দিকটায় নিয়ে খেলো আমরা আসছি?”
অভ্র-জাবিন মিষ্টিকে নিয়ে চলে গেল। আদ্রিয়ান অনি আর অদ্রিজা সেই বেঞ্চটায় বসল। অদ্রিজা কৌতূহল নিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে বাকিটা শুনবে বলে। আদ্রিয়ান অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” সেদিন আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন ছিল, সবচেয়ে ভয়াবহ অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম সেদিন আমি। নিজের স্ত্রী আর সন্তানের মধ্যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে সেটা ভাবলেও তো বুক কেঁপে ওঠে আর আমিতো ফিল করেছি। আমি পারছিলাম না আমার জানপাখিকে ছেড়ে আসছে। ও বারবার বলছিল ওকে ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু আমার হাত পারছিল না ওকে ছাড়তে। কিন্তু সময় ক্রমশ কমছিল। অনিও এরমধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেল। আমার মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছিল। তখনকার মত অসহায় নিজেকে কখনও মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল আমি একজন অযোগ্য স্বামী, অযোগ্য বাবা যে পারছেনা নিজের স্ত্রী সন্তানকে বাঁচাতে।”
আদ্রিয়ানের কন্ঠস্বর কাঁপছে অনিমারও চোখ ছলছল করে উঠছে। সেইদিনটা যে বড্ড বেশি বিষাক্ত ছিল। আদ্রিয়ান আরও গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
— ” সেদিন অনির কসমের জন্যে আর আমার সন্তানের জীবনের জন্যে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে, নিজেকে জীবন্ত লাশ করতে প্রস্তুত হয়ে অনিকে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে মনকে তৈরি করছিলাম কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না আমি। কিন্তু তখনই আল্লাহর রহমত হয়ে অভ্র এসে হাজির হয় সেখানে। এসে হাফাতে হাফাতে বলেছিল, ” স্যার বেবীকে আমায় দিন ম্যামকে আপনি নিয়ে আসুন।” আমি কিছু না ভেবে দ্রুত বেবীকে ওর হাতে দিয়ে অনিকে কোলে তুলে বেড়িয়ে এসছিলাম। আমরা বেড়োনোর ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই গোটা হসপিটালটা ব্লাস্ট করে সেদিন। আর আমরা জীবণের ভয়ংকর একটা মুহুর্ত থেকে নিজেদের বেড় করে আনতে পারি। আসলে অভ্রর ফ্লাট হসপিটাল থেকে কাছে ছিল অনেকটা ব্লাস্টের খবর পেয়েই ও চলে আসে। প্রথমে পুলিশ ওকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না কিন্তু পরে ও জোর করেই ঢুকে পরে ভেতরে, কারণ ভেতরে আমরা ছিলাম। ভাগ্যিস ও এসছিল নাহলে…”
এটুকু বলে থেমে যায় আদ্রিয়ান। অনিমা বলতে শুরু করে,
— ” জ্ঞান ফিরে নিজেকে অক্ষত দেখে ঘাবড়ে গেছিলাম তবে কী আদ্রিয়ান আমার মেয়েকে ফেলে এসছিল? কিন্তু আমার পাশে আমার মেয়ে হাসিমুখে হাতমুখে হাতপা নেড়ে খেলতে দেখে আমি স্বস্তি পাই। এরপর সবটা শুনে বেশ অবাক হই। ভাবতেও পারিনি আমি বেঁচে থাকব। আমার স্বামী, মেয়ে, পরিবারের সাথে জীবণ কাটাতে পারব। সেদিন আদ্রিয়ান আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছিল। ঐরকমভাবে কাঁদতে এর আগে দেখিনি আমি তোমাকে।”
সবটা শুনে লম্বা এক শ্বাস নিলো অদ্রিজা। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অদ্রিজা বলল,
— ” কিন্তু ঐ রূপ? ওর কী হয়েছিল?”
আদ্রিয়ান এবার চোখমুখ শক্ত করে বলল,
— ” হসপিটাল থেকে বেড়োনোর পরেই ওকে পুলিশ ধরে নেয়। কারণ চারপাশে পুলিশ ঘিরে ছিল। ও এবার আর পালাতে পারেনি কারণ এবার ওকে শিকলে বেধে আটকে রাখা হয়েছিল আর সেটা ইনশিউর করেছিলাম আমি। এরপর কোর্টে ওর ফাঁসির রায় হয়। রায় শুনেই ও ডেসপারেট হয়ে গেছিল, ভরা আদালতেই আমায় আর অনিকে অ্যাটাক করতে আসে কিন্তু মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে যায় আর যখন জ্ঞান ফেরে তখন ও পাগল হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হয় যে ওকে সুস্হ করে রায় কার্যকর হবে। প্রায় একবছর পাগলাগারদে রাখার পর ও সুস্থ হয় আর এরপর ওকে ফাঁসি দেওয়া হয়।”
অদ্রিজা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক ওই জঘন্যতম লোকটার একটা শাস্তি তো হয়েছে। অদ্রিজা বলল,
— ” বাই দা ওয়ে কোথায় গেছিলে তুমি?”
অনিমা মুখে হাসি রেখেই বলল,
— ” আমাকে কলকাতা যেতে হয়েছিল এক সপ্তাহের জন্যে। একটা ট্রেনিং ছিল, মেডিক্যাল গ্রাউন্ডের।”
অাদ্রিয়ান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমাদের যেতে হবে এখন।”
অনিমাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।”
অদ্রিজা হেসে দিয়ে বলল,
— ” তোমার সাথে কথা বলেও দারুণ লাগল। তুমি জানো ডায়েরিটা পড়ে ইচ্ছা করছিল আপনাকে দেখার। ভাগ্যিস আপনি একদিন আগে ফিরে এলে। নাহলে আপনাকে না দেখার আফসোস সারাজীবন থেকে যেতো।”
অনিমা মুচকি হেসে অদ্রিজাকে আগ করল। এরপর ওরা তিনজন মিলে এগিয়ে গেলো। অদ্রিজা মিষ্টিকে কোলে নিয়ে আদর করে ওদের বিদায় দিলো। ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল অদ্রিজা। এইকদিনে এই আশ্রমে এসে একটা দারুণ কাজ হয়েছে। এক অসাধারণ বাস্তব প্রেমের কাহিনী জানতে পেরেছে। ভালোবাসার নতুন এক সজ্ঞা শিখেছে।
_________________
গোটা বাড়িতেই আজ আনন্দ। অনিমা তো আবরার মেনশনের প্রাণ হয়ে গেছে। ও না থাকলে কারোরই ভালো লাগেনা কিন্তু ও থাকলে সবটাই শান্তি।
আজ মিষ্টিকে ওর দাদা দাদি নিয়ে গেছে তাদের রুমে। মিষ্টিও দিদার গল্প শুনবে তাই আর কোন আপত্তি করেনি। অনিমা ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে আদ্রিয়ান জড়িয়ে ধরল ওকে। অনিমা মুচকি হেসে আদ্রিয়ানের হাতের ওপর হাত রাখল। আদ্রিয়ান অনিমার কাধে থুতনি রেখে বলল,
— ” জানো কতটা মিস করেছিলাম তোমাকে?”
বলে সেই লকেটটা অনিমার গলায় পড়িয়ে দিয়ে ওর কাধে একটা চুমু দিলো। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
— ” আমারটা কোথায়?”
অনিমা টেবিল থেকে সেই কালো ঘড়িটা বার করে আদ্রিয়ানের হাতে পরিয়ে দিল। আদ্রিয়ান অনিমার কোমর ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
— ” এরকমটা কেন কর? কোথাও গেলেই লকেটটা খুলে আমায় দিয়ে যাও আল ঘড়িটা নিজে রেখে দাও?”
অনিমা আদ্রিয়ানেল কাধে হাত রেখে বলল,
— ” আমাদের একেওপরের ভালোবাসার জিনিস এগুলো। তাই এভাবে পাল্টে নিয়ে নিজের কাছে রাখি যাতে তোমার সাথে না থেকেও তোমাকে ফিল করতে পারি।”
— ” মা মিষ্টিকে আজ তার রুমে কেন নিয়েছে বলোতো?”
অনিমা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— “কেন?”
আদ্রিয়ান অনিমাকে হুট করেই বলল,
— ” মুখে বলে কী লাভ? চলো প্রাকটিক্যালি দেখাচ্ছি।”
— ” আদ্রিয়ান এক বাচ্চার বাবা হয়েও তোমার এসব দুষ্টুমি গেলোনা। নামাও।”
— ” তুমি বললেই নামাতে হবে নাকি?”
বলে অনিমাকে আর কিছু বলার সুযোগই দিলোনা আদ্রিয়ান। এতোদিন পর নিজের জানপাখিকে কাছে পেয়ে সমস্ত ভালোবাসা উজার করে দিলো তাকে।
_________________
আবরার মেলশনে সবাই হৈ হৈ করছে। অনিমার বাড়ি থেকেও সবাই এসছে আজ। কারণ তাদের সকলের আদরের মিষ্টির জন্মদিন আজকে। মিষ্টির তিনবছর পূর্ণ হলো আজ। সকলে মিলে মিষ্টির বার্থডে সেলিব্রেট করল। নূর ও এসছে আজ নীড়ও বড় হয়ে গেছে অনেক। নূরকে দেখলে আজও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়োয় অনিমার ভেতর থেকে। নূরের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে অনিমার দিকে আঙ্গুল তুলে হয়ত বলত, ‘আমার সব দুর্ভাগ্যের জন্যে তুমি দায়ী, শুধুই তুমি’। কিন্তু নূর তো উল্টে ওকেই বুঝিয়েছে। নূরের এরকম আচরণ অনিমার অপরাধবোধ হাজারগুন বাড়িয়ে দেয়। এসব ভেবেই নূরের কাছে গিয়ে নূরকে জড়িয়ে ধরল অনিমা। নূর প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেও ধরল। এরপর স্বাভাবিকভাবেই কিছুক্ষণ কথা বলল। সকলে মিলে অনেক আনন্দের পর রাতের খাবার খেয়ে অনির বাড়ির লোকেরা চলে গেল। অভ্র-জাবিন আজ এখানেই থেকে গেল।
রাতে মিষ্টি দুধ খাবেনা বলে জেদ করছে, আদ্রিয়ান সারারুম হেটে হেটে মিষ্টিকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টায় আছে অনিমা খাটে পা দুলিয়ে সবটা দেখছে আর হাসছে। আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” হাসবেনা একজন তোমার মেয়ে একদম তোমার মত হয়েছে। ভালো জিনিস সবসময়ই জোর করে খাওয়াতে হবে।”
অনিমা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
— ” মোটেও না। আমি না খেতে চাইলেও তোমার একধমকে লক্ষী মেয়ের মত খেয়ে নেই। কিন্তু তোমার মেয়ের কিছুতেই কিছু হয়না। একজন তোমার মত হয়েছে,ঘাড়ত্যারা।”
আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলল,
— ” আমি ঘাড়ত্যারা? ওয়েট আগে দুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পারাই পরে তোমাকে দেখছি।”
আদ্রিয়ান এবার মিষ্টিকে ধরে বলল,
— ” ভালো মেয়েরা দুধ খেয়ে নেয়। তুমি আমার ভালো মেয়েনা?”
মিষ্টি জেদ ধরে নাক ফুলিয়ে বলল,
— ” মাম্মাও তো খায়না, মাম্মাকি ভালো মেয়ে না?”
আদ্রিয়ান এবার অনিমার দিকে ডেবিল টাইপ হাসি দিয়ে তাকালো আর অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। তারপর আদ্রিয়ান বলল,
— ” একদম তোমার মাম্মাও খাবে দেখো।”
আদ্রিয়ান মনিকে কল করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে মনি দুধ নিয়ে এসে দিয়ে চলে গেল। অনিমা দাঁথ চেপে তাকালো নিজের মেয়ের দিকে সবসময় বাপকে দিয়ে ওকে শায়েস্তা করাল। দূর। আদ্রিয়ান অনিমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— ” বেবি, শেষ করে ফেলো তো। তুমিও না ভালো মেয়ে? তোমার মেয়ে বিশ্বাস করবে না তাহলে।”
অনিমা বিরক্তি নিয়ে একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টির দিকে তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলল,
— ” এক ডোকে।”
আদ্রিয়ান শব্দ করে হেসে দিলো। অনিমা বেচারি আর কী করবে অসহায় বাচ্চার মত কোন উপায় না পেয়ে নাক চেপে দুধটা শেষ করল। তবুও মিষ্টি জেদ ধরল খাবেনা। অনিমা এবার হেসে দিয়ে বলল,
— ” ঠিক হয়েছে। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে।”
আদ্রিয়ান অনেক কষ্টে মিষ্টিকে ধরে, সব আজগুবি লজিক, থিউরি দিয়ে পটিয়ে দুধটা খাইয়ে দিলো। এরপর ওকে বুকে নিয়ে শুয়ে পিঠ চাপড়ে গল্প বলতে বলতে ঘুম পারিয়ে দিল। অনিমা এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল বাবা আর মেয়েকে। এই দুজন মানুষের মধ্যেই তো ওর সব সুখ নিহিত। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” চল ব্যালকনিতে যাই?”
অনিমা মাথা নাড়ল। দুজনেই ব্যালকনির ফ্লোরে বসে জোছনা বিলাশ করছে কিন্তু কেউ কিছু বলছেনা। আদ্রিয়ানের পরনে শুধুই একটা জিন্স আছে। নিরবতার মাঝে হঠাৎ অনিমা বলল,
— ” সেদিন যদি অভ্র না আসতো? তাহলে? কী করতে তুমি?”
আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
— ” আমি জানিনা। আমি ঐ ভয়ংকর মুহূর্তটা মনেও আনতে চাইনা। সেদিন অভ্র না আসলে যদি আমি তোমাকে ফেলে চলেও আসতাম তবুও আমি জীবিত থাকতাম না জানপাখি। তোমার দেওয়া কথা রাখতে হয়তো আমার শ্বাস চলত, হয়ত সব দায়িত্ব পালন করে মিষ্টিকে মানুষ করতাম কিন্তু আমার ভেতরে প্রাণ থাকতোনা। কারণ আমি আগেও বারবার বলেছি তুমিই আমার প্রাণভোমড়া। আমার শ্যামাঙ্গী, আমার জানপাখি, আমার মায়াবিনী।”
অনিমা শক্ত করে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” এতো কেন ভালোবাসো আমায়?”
— ” কারণটাইতো আজও খুজে পাইনি শুধু এটুকুই জানি। ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।”
অনিমা কিছু বলল না আদ্রিয়ানের উন্মুক্ত বুকে মাথা রাখলো, আদ্রিয়ানও নিজের বুকের সাথে জাপটে ধরল ওকে। অনিমা মনোযোগ দিয়ে শুনছে আদ্রিয়ানের হৃদস্পন্দন। এই হৃদস্পন্দন একটা কথাই বলছে, ‘ভালোবাসি তোকে, ‘ভালোবাসি তোকে’, ভালোবাসি তোকে’ । অনিমা খেয়াল করল ওর মনের কোন এক কোণে এই একই শব্দ স্পন্দিত হচ্ছে, ‘ হ্যাঁ ভালোবাসি তোকে’।
#সমাপ্ত
( শেষমেশ এই গল্পটাতেও সমাপ্তি টানলাম। শুরু করলে শেষ তো করতেই হয়। কী আর করার? অনেকটা ব্যাস্ততার মধ্যে লিখেছি তাই অনেকটা খাপছাড়া টাইপ হয়েছে, নিজেরও মন মত হয়নি। আপনাদের কী বলব? যাই হোক গল্পটা শেষ করার পর সকলেরই একটি সুন্দর রিভিউ আশা করছি।
ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।)
One of the greatest story in my life! A Lot Of Thank you to Anima Kotoal for gifting us ‘A Real Compassion’ in our life.