ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ৭

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৭
.
সকালে মামনী, বড় আম্মু, আপি মিলে ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভ করছেন। আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। আসলে ভাবছি যে কী করা যায়। সবাই কাজ করছে আর আমি আমি মামনীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” মামনী আমি প্লেটগুলো রেডি করে দেই?”

মামনী, বড় আম্মু, আপি তিনজনে একসাথে আমার দিকে তাকালেন। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম কী এমন বললাম রে বাবা? তিনজনই এভাবে তাকালো কেনো?মামনী একটু রাগী কন্ঠে বলল,

— “এক থাপ্পড় মারবো? বউ হতে এসছো? পাকা মেয়ে?”

বড় আম্মুও তাল মিলিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তাইতো? পিচ্ছি মেয়ে একটা। এখনো তুমি এই বাড়ির মেয়ে। আগে বড় হও তারপর ভেবে দেখবো বউ বানানো যাবে কী না। তাই বাড়ির মেয়ে মেয়ের মতো থাক, বউ হওয়ার চেষ্টাও করিসনা।”

আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি ওনাদের দিকে। আপিদের দিকে তাকিয়ে দেখি আপি মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি মাথা চুলকে চেয়ারে বসে পরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে এলো খেতে। মামনী একটা প্লেটে খাবার বেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” যা তো মা আদ্রিয়ানকে খাবারটা দিয়ে আয়?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,

— ” কেনো? উনি সবার সাথে বসে খায়না?”

সবাই একটু অন্যরকমভাবে তাকালো আমার দিকে। মামনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ” ইশরাক মারা যাওয়ার পর থেকে তো ও ভুলেই গেছে ওর একটা পরিবার আছে। সারাটাদিন কোথায় না কোথায় থাকে আর যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে নিজের রুমে নিজেকে বন্দি করে রাখে। ”

বড় আব্বু বললেন,

— ” আমরা সবাই জানি ওর জন্যে ইশরাক কী ছিলো। ওর মৃত্যুতে চরম আঘাত পেয়েছে ও। কিন্তু এতে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখে কী লাভ?”

সবার মুখেই আবার অন্ধকার নেমে এলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেটটা হাতে নিয়ে উপরে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাইয়া সবে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছেন। আফটার শাওয়ার লুকে বরাবরেও মতোই নজর কারা লাগছে ওনাকে। কিন্তু আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,

— ” আপনার ব্রেকফাস্ট।”

— ” হুম রেখে দাও।”

আমি খাবারের প্লেটটা টি-টেবিলে রেখে একটু ইতস্তত করে বললাম,

— ” আচ্ছা আপনি এভাবে একা কেনো খাবার খান। বাড়ির সবার সাথে টেবিল বসেও তো খেতে পারেন?”

উনি কিছু বললেন না চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছেন। আমি আরেকটু সাহস সঞ্চার করে বললাম,

— ” দেখুন আর কিছুর জন্যে না হোক বাবা, মামনী? ওনাদের কথা ভেবে তো এক টেবিলে বসে খেতেই পারেন তাইনা? জানেন ওনারা কতো কষ্ট পান আপনাকে এভাবে দেখে?”

উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

— ” অভ্যেস করে নিতে দাও। নইলে পরে আরও কষ্ট পাবে।”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। কী বলতে চাইলেন উনি? পরে কেনো কষ্ট পাবেন সবাই? আমি ওনার কথার আগাগোড়া না বুঝলেও ভ্রু কুচকে রেখেই বললাম,

— ” পরে কী হবে সেটা পরে দেখা যাবে। তাই বলে আপনি সবাইকে এভাবে কষ্ট দিতে পারেন না। জানেন সবাই কতটা আপসেট? ওনাদের কী দোষ? আপনি ওনাদের সাথে এমন কেনো করছেন?ওনাদের কষ্টে আপনার কিচ্ছু যায় আসেনা?”

উনি চিরুনিটা ছুড়ে ফেলে একটু চেঁচিয়ে বললেন,

— ” না যায় আসেনা।”

আমি এবার একটু রেগে গেলাম। মানে কী? যায় আসেনা? বললেই হলো নাকি? নিজের বাবা মায়ের কষ্টে নাকি তার কিছুই যায় আসেনা। অদ্ভুত! আমি রাগী গলাতেই বললাম,

— ” যায় আসেনা মানে কী হ্যাঁ ? যারা আপনাকে এতো কষ্ট করে বড় করলো, মানুষ করলো তাদের কষ্টে আপনার কিচ্ছু যায় আসেনা? আপনি জানেন মামনী এখনো অপেক্ষায় বসে থাকে কবে আপনি আবার ওনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে বাচ্চাদের মতো খাইয়ে দেওয়ার আবদার করবেন। বাবা আপনার একটা দুষ্টুমির আশায় এখনো বসে আছে? কবে আপনি আবার আগের মতো দুষ্টুমি করবেন আর উনি আপনার কান মুলে দেবে। খেতে বসে বড় মাছের পিসটা কে খাবে? বেশি মাংস কে নেবে? পায়েসে কিসমিস কার বেশি পরেছে এসব নিয়ে আবার আপনি ইফাজ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করবেন সেই আশায় ইফাজ ভাইয়াও বসে আছেন? বড় আব্বু, বড় আম্মুও আপনাকে আগের মতো দেখতে চায়। এসবের কোনো দাম নেই আপনার কাছে তাইনা?”

বলে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিলাম। বাপরে বাপ। কতগুলো কথা বলে ফেললাম? আমারই গলা ব্যাথা করছে। কিন্তু ওনার দিকে তাকিয় দেখলাম উনি চুপ করে আছেন। আমার কথাগুলো কী কোনো কাজে দিলো নাকি সবটাই ওয়েস্ট? এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,

— ” প্লেটটা নিচে নিয়ে যাও।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

— ” কেনো? আপনি খাবেন না?”

উনি একটু ইতস্তত করে গলা ঝেড়ে বললেন,

— ” অব্ নিচে টেবিলে খাবো।”

আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আমার কথাগুলো ওনাকে সত্যিই এফেক্ট করলো? সিরিয়াসলি? আরে বাহ অনি? তু সি গ্রেট হ্যা। উনি একটু ধমকের সুরে বললেন,

— ” হা করে দাঁড়িয়ে না থেকে যাও আমি আসছি।”

আমি তাড়াতাড়ি খাবারের প্লেটটা নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। খুশিতে এখন নাচতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি নিচে যেতেই মামনী বলল,

— ” কীরে? প্লেট নিয়ে চলে এলি যে? আদ্রিয়ান খাবেনা?”

আমি এখন ওনাদের কিছু বললাম না, হঠাৎ আদ্রিয়ান ভাইয়াকে দেখে সারপ্রাইজড হবে সেটাই ভালো। সবাই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু আমি মুখ গোমড়া করে চুপ করে আছি। একটু পরেই উনি নিচে নেমে এলেন আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনি ওনার চেয়ার টেনে বসেও পরলেন। সবাই প্রায় দুমিনিট হা করে তাকিয়ে ছিলো ওনার দিকে। উনি সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”

মামনী অবাক কন্ঠে বললেন,

— ” তুই আমাদের সাথে বসে খাবি?”

আদ্রিয়ান সোজা ভাবেই বলল,

— ” খাবো বলেইতো এসেছি।”

সবাই এবার আমার দিকে তাকালো। যেনো সব ক্রেডিট আমার। ওনাদের ওভাবে তাকানোতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আজব! আমি কী করেছি? শুনু দুটো কথা বলেছি। এটা তো যে কেউ বলতে পারতো। আমি ওনাদের থেকে চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। কেউ এখন আর কথা বাড়ালো না। সবার চোখেমুখেই একরাশ খুশির ছাপ। উনি যদিও আগের মতো আড্ডা দুষ্টুমি করেননি একদম চুপচাপ খেয়েছে। তবে সবার সাথে বসে খেয়েছে এটাই অনেক। উনি খেয়ে উঠে চলে যেতেই বাবা বললেন,

— ” দেখেছো আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলোনা। অনেক কিছু চিন্তা করেই কাজ করেছি আমি।”

সবাই মুচকি হাসলো। আমি মাথা নিচু করে খাচ্ছি। বাবা কথাগুলো কেনো বললেন বেশ বুঝতে পারছি তাই খুব লজ্জাও লাগছে।

______________________

অসহায় একটা বাচ্চার মতো বায়োলজি বই নিয়ে বসে আছি আমি। সেই বিকেল বেলা উনি আমাকে বিশ পেইজ পড়া দিয়ে গেছেন। যদিও দাগানো সাইডগুলো পড়তে হবে কিন্তু পড়া অনেক। অথচ আমি সবে পাঁচ পেইজ পড়েছি। তাও আগাগোড়া সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কোচিং তো কাল শুরু হবে। এখনি আমায় এতো প্যারা দেওয়ার কী দরকার ছিলো? আল্লাহ জানে। আবার যাওয়ার আগে হুমকিও দিয়ে গেছেন এসে পড়া কম্প্লিট না পেলে নাকি স্কেল দিয়ে মারবেন। ভাবা যায়? সাধে বলেছি জীবন তেজপাতা হয়ে গেলো। রাত দশটা বেজে গেছে ওনার খাবারটা নিয়ে এসছি ওপরে। এখনো ফেরেন নি উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি এলেন। ওনাকে দেখে এমন একটা ভাব করলাম যেনো এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে বিশ্ব উদ্ধার করে ফেলেছি। উনি শার্টটা খুলে রেখে ওয়াসরুমে ফ্রেশ হতে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” কম্প্লিট হয়েছে?”

আমি ক্যাবলাকান্ত একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— ” হ্যাঁ মানে না। প্রায় হয়ে গেছে।”

— ” কতোটুকু?”

আমি ইতস্তত করে বললাম,

— ” প্ পাঁচ পেইজ।”

উনি বিরক্তিমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

— ” বিকেল থেকে মাত্র পাঁচ পেইজ? মাত্র ওয়ান ফোর্থ কম্প্লিট করে বলছো প্রায় হয়ে গেছে? এতোক্ষণ কী করেছো? আসার পরতো এমন ভাব করলে যেনো পড়তে পড়তে তুমি শহীদ হওয়ার পথে।”

অামি একটা শুকনো ঢোক গিলে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” বিশ্বাস করুন আপনি যাওয়ার পর থেকে একদম মন, জান, প্রাণ, আন্তা ..”

উনি আমাকে থামিয়ে বললেন,

— ” কলিজা, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি সব লাগিয়ে পড়েছো কিন্তু হয়নি। তাইতো? এতোগুলো জিনিস লাগিয়ে পড়লে? অথচ আমি তোমাকে যেটুকু পড়তে বলেছি পুরোটাই হৃদপিন্ড আর ফুসফুস নিয়ে। ওয়াও! ওয়ান্ডারফুল!”

এখন কথা না ঘোরালে সিউর মারবে। তাআ আমি কথা কাটিয়ে বললাম,

— ” আচ্ছা আপনি কোথায় ছিলেন? মানে বাড়ির সবাই বলছিল আগে এতো রাত করতেন না?”

উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

— ” সবার মন মতো চলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

— ” চাইলেই সম্ভব। আর তাছাড়াও বাড়িতে আপনার নতুন বউ আছে। তাকে এভাবে একা রেখে বাইরে বাইরে..”

এটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলাম। শিট! মার থেকে বাঁচার ভয়ে কাকে কী বলছিলাম? শিউর এবার আমায় ঝাড়বে। উফফ। উনি খানিকটা শক্ত গলায় বললেন,

— ” এটা ঠিক যে তুমি লিগালি আমার বউ। যে পরিস্থিতিতেই হোক আমি তোমায় বিয়ে করেছি তাই তোমার সব দায়িত্ব আমার। তোমার ভরণপোষণ থেকে শুরু করে তোমার ক্যারিয়ার। ইভরিথিং ইজ মাই রেসপন্সিব্লিটি। আর আমি এসব করবো কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করোনা আমার কাছ থেকে। ”

এটুকু বলে উনি কাবার্ড থেকে টি-শার্ট বেড় করে পরতে পরতে বললেন,

— ” এসে জেনো পড়া কম্প্লিট পাই।”

এটুকু বলে না খেয়েই হনহন করে বেড়িয়ে চলে গেলো। আমি ওনাকে ডেকে বললাম,

— ” আরে খাবারটা খেয়ে যান? ”

কিন্তু উনি আমার কথায় কর্ণপাত না করে চলে গেলেন। আমি একরাশ মন খারাপ নিয়ে বেডে বসে রইলাম। কেনো এমন করেন উনি? আর এই সবকিছুতে আমার কী দোষ? সবাই মিলে আমায় কেনো ঠেলে দিলো এই জটিল জীবণে? সেদিন যদি সত্যিই সত্যিই কারো কথা না ভেবে বলতাম আমি এই বিয়ে করতে চাইনা, করবো না মানে করবো না। তাহলে হয়তো এসব নাটক আর দেখতে হতোনা আমাকে। আমার এখনো ঐ দিনটার কথা মনে পড়লেই আফসোস হয়। এককথায় চরম আফসোস হয়। আচ্ছা সত্যিই কী আফসোস হয়? এসব ভাবতে ভাবতে আবার অতীতের কথা ভাবতে লাগলাম-

ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুর পর আদ্রিয়ান ভাইয়া কতোটা ভেঙ্গে পরেছিলেন সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। নিজের প্রিয় কোনো ব্যক্তির লাশের খাটিয়া কাধে তুলে নেওয়াটা যে কতোটা কঠিন সেটা একমাত্র তারাই বোঝে যারা সেই কাজ করেছেন। তখন ঐ খাটিয়াটুকুই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু মনে হয়। কাধ হয়তো ভেঙ্গে পরতে চায়, নিঃশ্বাস হয়তো আটকে আসে, পা হয়তো মাটিতে আটকে যেতে চায়। ওই মুহূর্তে হেটে এগোনোটা হয়তো অনেকটাই কঠিন। সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ইশরাক ভাইয়ার লাশসহ খাটিয়াটা যখন আদ্রিয়ান ভাইয়াকে কাধে তুলতে হয়েছিল তখন দেখেছিলাম আমি ওনাকে। যে মানুষটা জিমে এরচেয়ে ভারী ভারী জিনিস সহজেই উঠাতে পারতো সেই মানুষটা যখন খাটিয়া কাধে তুলে নিচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল ওটা ওনার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে বড্ড বেশি ভারী।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here