#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৯
.
সকালে কারো অনেক কর্কশ ডাকে চোখ খুলে তাকালাম। সকাল সকাল আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলো। উফফ ডিসগাস্টিং। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি উনি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি একটা হাই তুলে উঠে বসে বললাম,
— ” কী হয়েছে?”
উনি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললেন,
— ” কী হয়েছে? আধ ঘন্টা ধরে ডাকছি তোমাকে। উঠে যে পড়তে বসতে হবে ভুলে গেছো?”
আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। এই লোকটা ইহকালে আমাকে শান্তি দেবেনা সেটা আমি শিউর। আরে ভাই হাজবেন্ড হাজবেন্ড এর মতো থাকনা টিচার হতে কে বলেছে? হাজবেন্ডরা যা করে তার কিছুই তো করছেই না উল্টে আমার পড়া নিয়ে পরে আছেন। ধ্যাত ভাল্লাগেনা। উনি আমার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললেন,
— ” এই যে মহা গবেষক? এতো গবেষণা বাদ দিয়ে যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
আমি ওনার দিকে এক ড্রাম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে তারপর ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বেড় হয়ে দেখি উনি দুটো কফির মগ হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” ব্যালকনিতে এসো।”
আমি একটু অবাক হলেও কিছু বললাম না। হাতমুখ মুছে ওনার পেছন পেছন ব্যালকনিতে চলে গেলাম উনি আমার দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিলেন। আমিও চুপচাপ সেটা হাতে নিয়ে নিলাম। উনি কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বললেন,
— ” আমি নিজে বানিয়েছি খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে?”
আমি এবার চরম অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি কফি করেছেন তাও আমার জন্যে? আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ভ্রু কুচকে ফেললেন। ভ্রুজোড়া কুচকে রেখেই বললেন,
— ” আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে কফিটা খাও। আমাকে দেখার জন্যে যথেষ্ট সময় আছে। যতোদিন বেঁচে আছি দেখতে পাবে কিন্তু কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেলে আর খেতে পারবেনা।”
আমি কিছু না বলে কফির মগে চুমুক দিলাম। এক চুমুক খেতেই উনি ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলেন কেমন হয়েছে? আমিও মাথা নেড়ে বললাম বোঝালাম দারুণ। আসলেই দারুন হয়েছে খেতে। উনি এতো ভালো কফি বানায় জানতামি না। উনি আবারও কফির মগে চুমুক দিয়ে বললেন,
— ” এখানে মিনিট দশএক থাকো, ফ্রেশ এয়ার নাও এরপর ভেতরে গিয়ে পড়তে বসবে ঠিক আছে?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। উনি কিছু বলছেন না রেলিং ও ভর দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে আর মাঝেমাঝে কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। আমিও কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সকালের এই ফ্রেশ এয়ার উপভোগ করছি। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে উনি বললেন,
— ” অনি?”
আমি হালকা চমকে উঠলাম। এমন আদুরে কন্ঠে অনি উনি আগে ডাকতেন। আপির বিয়ের আগে। প্রায় চারমাস পর ওনার মুখে এরকমভাবে অনি ডাক শুনলাম। কোনরকম তুতলিয়ে বললাম,
— ” জ্ জ্বী?”
উনি ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” কাউকে কখনো ভালোবেসেছো?”
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেনো করলেন আমায়? উনি আবারও বললেন,
— ” কী হলো বলো?”
আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
— ” বেসেছি তো। এখনো বাসি। আব্বু,আম্মু, কাব্য, আপি, ভাইয়াদের। এবাড়ির সবাইকেও এখন খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”
উনি মুখে হালকা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— ” আমাকেও?”
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কী উত্তর দেবো বুঝতে পারছিনা ভালোবাসি আমি ওনাকে? এই প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে এখনো অজানা। আমার কোনো উত্তর না পেয়ে উনি বললেন,
— ” চলো রুমে চলো পড়তে হবে।”
আমিও ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ ভেতরে চলে গেলাম। উনি প্রায় দেড় ঘন্টা পড়িয়েছেন আমায়। পড়া শেষ করে আমি রেডি হয়ে নিলাম। উনিও আমার সাথেই রেডি হয়ে নিচে নামলেন। এখন উনি সবার সাথে একটেবিলেই খান। ইফাজ ভাইয়া ইচ্ছে করে ওনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মামনীকে বললেন,
— ” ছোট আম্মু বড় মাছের পিসটা আমাকেই দাও তো।”
কিন্তু আদ্রিয়ান কোনো রিঅ্যাক্ট করলেন না। ওনাকে পাতে যেটা দেওয়া হয়েছে চুপচাপ সেটাই খাচ্ছেন। ইফাজ ভাইয়া অাবারও হতাশ হলেন সাথে বাকিরাও। আমি খেয়ে উঠে বললাম,
— ” আচ্ছা তাহলে আমি আসছি হ্যাঁ। কোচিং এ লেইট হয়ে যাবে নয়তো।”
উনি টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
— ” ওয়েট ওয়েট। আমি ড্রপ করে দেবো তোমাকে।”
আমি একটু হেসে বললাম,
— ” নাহ তার প্রয়োজন নেই আমি যেতে পারবো।”
উনি ভ্রু কুচকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ” অফার করছিনা তোমাকে। ইটস মাই ওর্ডার।”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” আসার সময় তো একাই আসতে হবেনা? প্রবলেম কী?”
— ” আগ্গে না। আমি নিজে আপনাকে পিক করবো। আর যেদিন আমি যেতে পারবোনা সেদিন গার্ড পাঠিয়ে দেবো।”
আমি অবাক সাথে খুব বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” মানেটা কী? আমি কী বাচ্চা যে হাত ধরে রাস্তা পার করাবেন? প্রথম দিন যাওয়াটা আলাদা ব্যাপার কিন্তু তাই বলে রোজ?”
উনি এবারেও শক্ত কন্ঠে বললেন,
— ” আমি আগেও বলেছি দিস ইজ মাই ওর্ডার। আমার পার্মিশন ছাড় বাড়ির বাইরে কোথাও যাবেনা তুমি।”
— ” কিন্তু..”
— ” আমার কথার ওপর কথা শুনতে আমার ভালো লাগেনা অনি। যা বলেছি সেটাই ফাইনাল।”
সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওনারা মাথা নিচু করে খাচ্ছে আর মিটমিটিয়ে হাসছেন। আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
— ” চলো?”
আমি ওনার পেছন পেছন গেলাম। কোচিং সেন্টারের পৌছে উনি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। উনি যেতেই একজন লোক এসে বললেন,
— ” আরে মিস্টার এডি এখানে?”
বলে আদ্রিয়ানের সাথে হ্যান্ডশেইক করলেন। আদ্রিয়ান কিছু বলবেন তার আগেই লোকটি বললেন,
— ” তা হঠাৎ স্যার? কোনো কাজ ছিলো নাকি?”
উনি আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,
— ” হুমম আসলে ওকে ভর্তি করেছি এখানে। মেডিক্যাল এর জন্যে কোচিং করবে। তাই পৌছে দিয়ে গেলাম।”
— “আচ্ছা কে হয় উনি আপনার?”
উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
— ” ও আমার ওয়াইফ।”
আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে তারপর ক্লাসে পাঠিয়ে নিজেও চলে গেলেন। আমি ভাবছিলাম যে লোকটা বাসররাতেও বলেছিল আমায় বউ বলে মানেনা অথচ আজও সবার সামনে কতো সহজ সাবলীলভাবে আমাকে নিজের স্ত্রীর হিসেবে পরিচয় দিয়ে দিলো।
______________________
বিকেলে আপির রুমে আপির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। আপি আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলল,
— ” আদ্রিয়ান কী এখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে?”
— ” না আপি শুধু ঐ একদিনিই করেছিলেন।আসলে একটু রেগে ছিলেন আমার ওপর। এরপর তো কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি। উল্টে আরো কেয়ার করে এখন।”
আপি বিলি কাটা থামিয়ে বলল,
— ” ভালোবেসেছে?”
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম আপির দিকে তারপর বললাম,
— ” কী বলছো? এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা হয়? যেটুকু করছেন দায়িত্ববোধ থেকে করছেন।”
আপি আবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ” দেখ। কোচিং এ ভর্তি করা, পড়তে বলা এই পর্যন্ত দায়িত্ববোধ থেকে করে মেনে নিলাম। কিন্তু নিজের বসিয়ে এতো যত্ন করে পড়ানো, নিজের হাতে কফি করে খাওয়ানো, মাত্র বিশ মিনিটের রাস্তাটাও একা ছাড়তে না চাওয়া। এগুলোও কী শুধু দায়িত্ব?”
আমি নিজেও একটু ভাবনায় পরলাম। কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে বললাম,
— ” হ্যাঁ তাছাড়া আর কী?”
আপি আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বলল,
— ” গাধি একটা?”
বলে মাথায় আবার বিলি কাটতে শুরু করলো। আমি আপির কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও প্রশ্নগুলো আমার মনেও যে উঠছে না তা কিন্তু নয়। সত্যিই কী এগুলো শুধুই দায়িত্ববোধ নাকি অন্যকিছু?”
_____________________
আমি মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে বসে আছি আর আদ্রিয়ান বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনি বইটা সামনে ঠাস করে রেখে একগাদা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
— ” লাইক সিরিয়াসলি? তো জিকে এতোটা খারাপ আই জাস্ট কান্ট বিলিভ।”
আমি মুখ ফুলিয়ে হালকা তুতলে বললাম,
— ” আসলে ঐ ফিজিক্স ক্যামিস্ট্রির চক্করে এসব পড়া হয়নি।”
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
— ” তাই বলে এই সামান্য জিনিসগুলো কেউ না পারে? যেভাবে সাল আর মাস বলছো এতে করে তো দেশেই ইতিহাসটাই বদলে দেবে তুমি। কবে জেনো বলে বসো সাত মার্চের ভাষণ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দিয়েছে, আর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ১৯৫২ তে হয়েছে, আর ভাষা আন্দলন ১৯৭১ এ।”
— ” আমি এতোটাও ডাফার নই।”
— ” এর চেয়ে কমও নও। পাঁচ বছর যাবত আমার কোনো প্রাকটিস নেই তবুও চোখ বন্ধ করে বলতে পারবো।”
আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
— ” আপনার মতো ওতো ট্যালেন্ট নেই আমার মধ্যে।”
— ” না না ট্যালেন্ট আছে তোমার। সারাদিন লাফালাফি করার, টুইন্টি ফোর সেভেন আবলতাবল বকার, বোকা বোকা কথা বলার আর আমার গুষ্ঠির পিন্ডি চটকানোর ট্যালেন্ট খুব বেশি পরিমাণ আছে তোমার।”
আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। সারাদিন আমাকে টিজ করে খবিশ একটা। উনি ভ্রু কুচকে রেখেই ল্যাপটপটা অন করে বললেন,
— ” তাড়াতাড়ি কম্প্লিট করে এটা। আমি অ্যাপটা ডাউনলোড করে ওটায় লগ ইন করছি। কাল সকালে এক্সাম আছে তো?”
বলে ল্যাপটপে কিছু করতে লাগলেন। আমিও পড়তে শুরু করলাম। একটু পর উনি বলে বললেন,
— ” তোমার ফোনে মেসেজ আছে দেখো ওটা দেখে কোচিং রোলটা বলো?
আমি দেখে বললাম ওনাকে। উনি ওটা টাইপ করে বললেন,
— ” পাসকোডটা বলো?”
আমি সাথে সাথেই চমকে উঠলাম। শরীর জমে যাচ্ছে আমার আস্তে আস্তে। এই উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” কী হলো পাসকোডটা বলো?”
ওনার আওয়াজে আমি কেঁপে উঠলাম। আমার শরীর অবস হয়ে আসছে। আমি বাক্যটা বড্ড বিষাক্ত লাগছে আমার কাছে। বড্ড বেশি। আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম,
— ” অ্ আমি জানিনা। আমি কিচ্ছু জানিনা। কিচ্ছুনা।”
উনি ল্যাপটপটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আমার দুই বাহু ধরে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
— ” অনি? কী হয়েছে তোমার? আমিতো জাস্ট পাসকোডটা জানতে চেয়েছি।”
আমি জোরে চেঁচিয়ে বললাম,
— ” আমি জানিনা কোনো পাসকোড।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনি এবারেও চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
— ” তুমি এতোটা হাইপার হচ্ছো কেনো? আমি পাসকো..”
— ” নাহ। নাহ আপনি কিচ্ছু জানতে চাইবেননা আমার কাছে। আমি কিচ্ছু জানিনা,কিচ্ছুনা।”
বলে শব্দ করেই কেঁদে দিলাম আমি। উনি এবার আমাকে নিজের বুকে জরিয়ে ধরলেন। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— “ওকে ফাইন। আমি কিচ্ছু বলছিনা। কুল।”
বলে আমাকে ওনার বুকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এই প্রথম উনি নিজে থেকে এতোটা কাছে টেনে নিলেন আমায়। অন্যসময় হলে হয়তো লজ্জা পেতাম, ওনার থেকে একটু দূরে সরে যেতাম। কিন্তু এখন এতোটাই ভয় পেয়ে আছি যে আমিও শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম ওনাকে শরীর ভীষণ রকম কাঁপছে। কাপুঁনি থামাতে ওনার পিঠের ওপর দিয়ে টিশার্টটা শক্ত করে ধরে আছি। অদ্ভুত ব্যাপার ওনাকে আমি যতোটা শক্ত করে ধরে আছি তার চেয়েও বেশি শক্ত করে ধরে রেখেছেন উনি আমাকে।
#চলবে…