#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৪০
©জারিন তামান্না
১ বছর পরে একদিন,
মধ্যদুপুর!
বিছানার উপর বসে আছে পলক। সামনে সিফাত দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে ভয়,উৎকন্ঠা। অফিস থেকে একরকম দৌঁড়েই বাড়ি ফিরেছে সে। বাসায়ও কেউ নেই। সবাই সিফাতের দাদার গ্রামের বাড়িতে গেছে। সিফাতের দাদার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এতিমদের খাওয়ায় তারা প্রতিবছর। দান খয়রাত করে। কিন্তু,এ বছর পলককে নিতে চায়নি দাদী। গ্রামে গেলেই লোকে পলকের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে কথা বলে। দাদী একরকম বিরক্ত এখন পলকের উপর। তাই তাকে নিবে না বলে মানা করে দিয়েছেন। দাদীর এমন আচরণে রাগ করে সিফাতও যায়নি।অফিস থেকে আগেই ছুটি নিয়েছিল পলক। তাই আজ আর অফিস যায়নি সে। কিন্তু,সিফাত গিয়েছিল। হঠাৎ পলক ফোন করে ‘ক্যাপ্টেন’ বলেই কেঁদে দিয়েছিল। কান্নার দমকে কিছুই বলতে পারছিল না সে। সিফাত ভয় পেয়ে গেছিল পলকের এমন কান্নায়। বারবার জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে কিন্তু পলক কিছুই বলেনি তেমন। কোনমতে শুধু বলেছে যে,,বাড়ি আসুন এখুনি। পলকের এমন কথা আর কান্নাভরা কন্ঠ শুনে আর একমূহুর্তও দেরি করেনি সিফাত। ছুটে চলে এসেছে বাড়িতে।পলকের কাছে। ঘরে এসেও দেখেছে পলক বিছানায় বসে কাঁদছে। তার তখন থেকেই সিফাত জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কিন্তু পলক চুপচাপ বসে আছে। কাঁদছে নিরবে। এবার সিফাত আর দমিয়ে রাখতে পারলো না নিজেকে।ভয়ে, চিন্তায়, আর পলকের এমন নিরব থাকায় রাগ করে জোরে ধমক দিলো সে পলককে। বললো,
_এইই মেয়ে কি শুরু করেছো তুমি এটা? বলবে কিছু, নাকি আমি বেরিয়ে যাবো বাসা থেকে।পরে ইচ্ছামতো কান্না করো একা একা।
ঈষৎ কেঁপে উঠলো পলক সিফাতের এমন ধমকে।তারপর হাতের মুঠো খুলে সিফাতের দিকে এগিয়ে দিলো প্রেগন্যান্সি টেস্টের স্টিক।ওটা দেখে হতভম্ব সিফাত। রাগ করতে করতে ওটা হাতে নিল সেটা ।দেখলো না পর্যন্ত। ছুঁড়ে মারলো ঘরের কোথাও একটা। এখন রীতিমতো বিরক্ত সে এসবে। কারণ, কখনো কখনো পিরিয়ডের ডেট মিস হলেই পলক প্রেগন্যান্সি টেস্ট করায়। বিগত দু বছরে কতবার সে এই কাজ করেছে হিসেব নেই। কিন্তু,প্রতিবারই নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। শুরু শুরুতে সিফাত এসব না জানলেও একদিন একটা ফাইল খুঁজতে গিয়ে আলমারিতে পলকের ড্রয়ারে একসাথে কয়েকটা প্রেগন্যান্সি কিট আর স্টিক দেখে অবাক হয় সে। প্রতিটা নেগেটিভ হওয়া স্টিকই পলক সযত্নে রেখে দিয়েছিল। সাথে আছে আরও কয়েকটা নতুন কিট। আনইউজ! সেদিন সবটা বুঝতে পেরে খুব রাগারাগি করেছিল সে পলকের সাথে। ২ দিন কোন কথাই বলেনি সে পলকের সাথে। পরে পলক অনেক বলে কয়ে মাফ চেয়ে মান ভাঙিয়েছিল তার। কিন্তু, আজ অনেকদিন পর আবারও পলককে একই কাজ করতে দেখে প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো সিফাতের। আজও নিশ্চই হতাশ হয়ে পলক এভাবে কান্না কাটি করছে। পলকের কান্না একদমই সহ্য হয় না তার। যদিও পলক খুব সহজে কাঁদে না তবুও কখনো কাঁদলে সিফাত সহ্য করতে পারে না সেটা। আর পলক যেভাবে ফোন করে কান্না করতে করতে তাকে বাসায় আসতে বলেছে সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছিল। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। আর বাসায় এসে শেষে এমন একটা কারণ জানতে পেরে রাগে দুঃখে ছুঁড়ে ফেলেছে স্টিকটা।
তাকে ওভাবে স্টিকটা ছুঁড়ে ফেলতে দেখে অবাক হয়ে ভেজা কন্ঠেই পলক বললো,
_ওভাবে ছুঁড়ে মারলেন কেন? পজিটিভ তো!
_কিসের পজেটিভ, হ্যাঁ? কিসের পজেটিভ? প্রতিবার এক কাহিনী করো তুমি। কতবার মানা করেছি এমন না করতে! ফালতু একটা! আমার সাথে থাকলে কোনদিন কন্সিভ করবা না তুমি। কোন দিন মা হইতে পারবা না নিজের সন্তানের। বুঝো না কেন তুমি এটা??? আর কত বার বলবো আমি এই এক কথা!!! প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো সিফাত। রাগে ঠিকমতো বুঝেইনি পলক কি বলেছে। কিন্তু, তার এই রাগকে উপেক্ষা করে শান্ত স্বরেই বললো পলক,
_I’m pregnant, captain! কন্সিভ করেছি আমি।বাবা হতে চলেছেন আপনি!
_what? চমকে বললো সিফাত। থমকে গেল সে। কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সিফাত, এইই কি বললা তুমি? কি বললা??
সিফাতের অস্থিরতা দেখে কিছু বললো না পলক। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজলো স্টিকটা। কিছুটা দূরে ঘরের মেঝেতেই পড়ে আছে ওটা।ওদিকে এগিয়ে গেল পলক। সিফাত অবাক হয়ে দেখছে তাকে। তাকে যেতে দেখে আবার চেঁচালো সিফাত, এইই মৃন্ময়ী, কই যাচ্ছেন?বলছেন না কেন কিছু? পলক তবুও কিছু বললো না। চুপচাপ গিয়ে হাতে উঠিয়ে নিল ওটাকে। তারপর, ওটা নিয়ে এসে সিফাতের চোখের সামনে ধরে বললো, দেখুন!
পলকের কথা শুনে একবার পলককে তারপর আবার স্টিকটাকে দেখলো একবার সিফাত। কাঁপা কাঁপা হাতে নিলো ওটাকে পলকের হাত থেকে। ভেতর ভেতর ভয় পাচ্ছে সে। প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে।প্রচন্ড অস্থির লাগছে তার। এখন শরৎকাল। খুব একটা গরম নেই।তবুও ঘরে এসি চলছে। এরপরেও ঘামছে সে। প্রচন্ড ঘামছে। অস্থির কন্ঠে পলককে বললো, মৃন্ময়ী ফ্যান ছাড়ুন। ফুল স্পিডে দিবেন একদম। সিফাতকে এভাবে অস্থির হতে দেখে পলক ছুটে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিল। পানির গ্লাস নিয়ে এসে সিফাতকে দিল। সিফাতও এক ঢুকে খেয়ে নিলো পুরোটা।
_ক্যাপ্টেন, আপনি আসুন। বসুন ফ্যানের নীচে। পলক বললো। কিন্তু, সিফাত নড়লো না।নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পলককে জিজ্ঞেস করলো,
_Are u sure, Mrinmoyi? should I go ahead?
সেই রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল পলকের। এভাবেই কাছে যাওয়ার নিশ্চয়তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল সিফাত তাকে। কান্নাভেজা মুখেই সে হাসলো সিফাতের কথা শুনে। তারপর, জোরেজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে “হ্যাঁ” বললো। পলকের সায় পেয়ে ধীরে ধীরে স্টিকটা চোখের সামনে নিয়ে দেখলো সিফাত। দুটো লাল দাগ দেখাচ্ছে। যার অর্থ পলক কন্সিভ করেছে। মা হতে চলেছে সে। আর সিফাত বাবা। কতক্ষণ স্থির নয়নে চেয়ে রইলো ওটার দিকে। তারপর ঝট করে পলককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল সে। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। কিন্তু, আজ সিফাত কাঁদছে। তার চোখের পানিতে পলকের পিঠ ভিজে একাকার হচ্ছে। কাঁদছে পলকও। আজ দুজনের জীবনের একটা বর্ণনাতীত খুশির দিন। এই মূহুর্তটা তাদের দুজনের কাছেই সবচেয়ে সুখের একটা মূহুর্ত। বিগত ৩ বছরের এত এত চেষ্টা,এত কষ্ট, এত এত মানুষের এত কথা,তাচ্ছিল্য সব সহ্য করে…রাত রাতভর তাহাজ্জুদে রবের দরবারে করা ফরিয়াদ আজ কবুল হয়েছে তাদের। এই সুখ তাদের কাছে অমূল্য। কাঁদতে কাঁদতেই পলক বললো,
_Congregations, captain. বাবা হচ্ছেন আপনি।
_Thank you Mrinmoyi…. thank you….. thank you.. thank you so so soooooo much. আজকে আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে এটা। নইলে তো আমি..আমি…কান্না আর খুশির দমকে ঠিক ভাবে কথাও বলতে পাড়ছে না সিফাত। তা বুঝতে পেরে তার পিঠে হাত বুলিয়ে পলক বললো,
_ওপরে একজন আছে তো ক্যাপ্টেন। আমাদের এত চেষ্টা,এত ফরিয়াদ তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা এবারে পূর্ণ হতে চলেছি।
পলকের কথায় সিফাতও মনে মনে বললো, আলহামদুলিল্লাহ। তারপর, পলককে ছেড়ে দাঁড়িয়ে খুব শক্তপোক্তভাবেই তার কপালে এঁকে দিল তার গভীর প্রেমময় স্পর্শ। পলক তার শার্টের বুকের অংশটা খাঁমচে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কপাল থেকে সিফাত সরে এলে সেও সিফাতের বুকে চুমু দিয়ে মুখ গুঁজলো তাতে। এ যে এক পরম সুখের মূহুর্ত তার জন্য।
_________________________________
দুপুরের নামায পড়েই দুই রাকাত শুকুরানার নফল নামায পড়লো তারা দুজন।তারপর ছুটলো ডাক্তারের কাছে। ইমার্জেন্সিতে ইউরিন টেস্ট করিয়ে বিকেলের মধ্যেই রিপোর্ট হাতে পেল তারা। রিপোর্ট পজেটিভ। ৪৭ দিনের প্রেগন্যান্ট পলক।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে বাচ্চাকে সুস্থ বলা হয়েছে। তারপরেও শুরুর ৩ মাস খুব সাবধানে থাকতে বলেছেন ডক্টর পলককে।
তাদের ডাক্তারও আজ ভীষণ খুশি। এই ৩ বছরে তাদের এই সংগ্রামটা নিজের চোখেই দেখেছেন তিনি। সিফাত ভেঙে পড়লেও পলককে কখনো হাল ছাঁড়তে দেখেননি তিনি। বরং, স্বামীর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মা হওয়ার আদম্য ইচ্ছা নিয়ে চেষ্টা করে গেছে। নিজের মা হওয়ার থেকেও বেশি তার চেষ্টা ছিল সিফাতের সন্তানের মা হওয়া। সিফাতকে নিজের ঔরসজাত সন্তানের বাবা করা। ডাক্তারকে সে বহুবার বলেছে সিফাতের থেকে কমতি থাকলেও তাকে যেন মেডিসিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নিজের মাঝে সন্তান ধারণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা যেন সে রাখে। কিন্তু,পলকের কোন সমস্যা ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই সে মা হওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই তাকে মেডিসিন দিতে চাইতো না ডাক্তার। বলতো ধৈর্য্য নিয়ে চেষ্টা করে যেতে। কারণ,মেডিসিনের চাইতেও তাদের ধৈর্য্য, সম্পর্কের সুস্থতা, চেষ্টা বেশি জরুরি। আজ এতদিনের এত ত্যাগ, সাধনা সব সার্থক তাদের। ভীষণ খুশি তিনি পলক আর সিফাতের জন্য।
____________________________________
৮ মাস পরে,
ওটির সামনে অস্থির পায়ে ছুটোছুটি করছে সিফাত। হাসপালে রীতিমত গুঞ্জন চলছে পলকের ডেলিভারি নিয়ে। ওটির বাইরে পুরো করিডোর জুড়ে মানুষ গিজগিজ করছে। এক পেশেন্টের জন্য এতগুলো বাড়ির লোক এই প্রথম দেখছে তারা। কিন্তু, রুকুর ফ্যামিলি বলে চলে যাওয়ার জন্য কিছু বলতেও পারছে না।
আরও সপ্তাহখানেক পর সি-সেকশনের ডেট দিয়েছিল ডাক্তার পলককে।কিন্তু,হঠাৎ পলকের পানি ভাঙায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল তাকে। রুকুই সব ব্যবস্থা করেছে। পলকের রেগুলার ডাক্তার শহরের বাইরে হওয়ায় রুকুই ডেলিভারি করাবে ওর। ওটির ভিতরেই আছে সে। কিন্তু, পলকের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। বাইরে সিফাত পায়চারী করছে। করিডোরে রাখা চেয়ারগুলোতে হাতে হাত চেপে ধরে বসে আছে প্রাপ্তি আর ইয়ানা। ৯ বছরের ইয়ানা সযত্নে আগলে রেখেছে তার প্রিয় বোন, বান্ধুবী ৬ বছরের ছোট্ট প্রাপ্তিকে। তাকে সাহস দিয়ে বলছে পলক ঠিক আছে। শাহনাজ বানু, রেহনুমা, রেহানা, আমজাদ আলী, ইশতিয়াক আলমও এসেছেন।বসে আছে চেয়ারে। দোয়া করছে পলকের জন্য। অন্য পাশের চেয়ারে বসে আছে অন্তরা, নিশাত, অনন্যা, নাজিয়া। ৫ মাসের প্রেগন্যান্ট নাজিয়া। তারপরেও, পলকের খবরটা শুনে একপ্রকার জেদ করেই এসেছে এখানে। পলাশ, রিহান তিয়ান, সবাই পায়চারী করছে করিডোর জুড়ে। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে তাদের। সিফাত পলকের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। বারবার মনে পড়ছে ও.টিতে যাওয়ার আগে পলকের বলা কথাগুলো।
★
ও.টিতে নেওয়ার আগে পলক শক্ত করে সিফাতের হাত ধরে বলেছিল,
_ফিরে আসার খুব জোর চেষ্টা করবো। কিন্তু, যদি না পারি তবে প্লিজ এদের সবাইকে সামলে রাখবেন। আমার একটা বাচ্চাও যেন কখনো কষ্ট না পায়। একজন আদর্শ স্বামীর মতই একজন আদর্শ বাবা হয়ে উঠবেন আপনি ওদের জন্য। ইয়ানা, প্রাপ্তি যেন কখনো এটা মনে না করে ওরা আমাদের সন্তান নয়।
_আপনি ফিরবেন মৃন্ময়ী। আমার আগে কোথাও যাওয়ার অনুমতি আমি দেইনি কিন্তু আপনাকে। একদম টেনশন করবেন না। আমাদের বাচ্চাগুলোকে নিয়েই সুখে সংসার করবো আমরা। তারপর খুব যত্ন করে গভীরভাবে এঁকে দিয়েছিল তার ভালোবাসা পলকের কপালে।
★
পুরো প্রেগন্যান্সির সময়টাতে খুব যত্নে রেখেছিল সিফাত পলককে। পলকের মুড সুয়িং হতো অনেক। সে সময় তার সমস্ত রাগ জেদ চুপচাপ সহ্য করেছে সিফাত। মাঝে মাঝে পলক বমি করে ঘর বিছানা সব ভাসিয়ে দিত। কতবার সিফাতের উপরেও বমি করেছে সে। সিফাত বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়নি। নিজ হাতেই পরিষ্কার করেছে সব। মিডিল স্টেজে এসে পলকের গরম লাগতো বেশি। তাকে ধরে ঘুমাতে দিতো না। এতকালের পলককে ধরে ঘুমানোর অভ্যাসও ছেড়েছিল সে। তারপরেও রাতে উঠে মাঝে মাঝে পলকের জামা সড়িয়ে তার পেটে হাত বুলিয়ে দিত। চুমু দিতো।আদর করতো বাচ্চাকে। কথা বলতো একা একাই। সিফাত জানতো পলক ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু,পলক সবটাই দেখতো। বলতো না কিছুই। হাসতো নিরবেই।পেট বড় হওয়ার পর টানটান লাগতো। চুলকাতো। প্রায় দিন সিফাত নিজ হাতেই ওয়েল ম্যাসাজ করে দিতো পলকের পেটে। পায়ে পানি আসায় ব্যাথা করতো। মাঝ রাতে উঠে উঠেও তাকে পা টিপে দিতো। শুরুতে পলক আপত্তি করলেও সে বলতো, স্বামী স্ত্রী তো একে অন্যের অংশ মৃন্ময়ী। তাহলে আপনার পায়ে হাত লাগালে সেটা আমার পায়ে হাত লাগানোর মতোই। একই কথা। খারাপ লাগার কি আছে? তারপর থেকে পলকও বলেনি আর কিছু।
এছাড়াও কতরকম পাগলামি যে সিফাত করেছে এই সময়টায়।পলক মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে বকাঝকাও করতো সিফাতকে। কিন্তু, সিফাত শুনতো না। যতভাবে পারা যায় পলকের যত্ন নিতো। কিন্তু, এত খেয়াল রাখার পরেও শেষমেশ এমন কিছু হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি সে।
____________________________________
এক ঘন্টা পরে,
তিনজন নার্স বেরিয়ে এলো ও.টি থেকে।তিনজনের কোলেই তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো তিনটা বাচ্চা। তাদের মধ্যে একজন নার্সকে সিফাত চেনে। পলককে ও.টিতে নেওয়ার জন্য সেই এসেছিল। তাকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে সিফাত জিজ্ঞেস করলো,
_সিস্টার, কি অবস্থা মৃন্ময়ীর? অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল, এখনো কোন খবর নেই। আপা কি করছে এতক্ষণ ধরে?
সিফাতের অস্থিরতা দেখে হাসলো নার্স। বললো, ম্যাম ঠিক আছেন স্যার। ড্রেসিং চলছে। শেষ হলেই বের করা হবে উনাকে।
তার কথা শুনে সিফাত স্বস্তির শ্বাস ফেললো একটা। তারপর বাচ্চার কথা খেয়াল হতেই বললো,
_সিস্টার আমার বেবিটা?
_এই তো স্যার বেবিরা ! হেসে বললো নার্স।
_বেবিরা! মানে?
_কেন আপনি জানতেন না?
_কি জানবো? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সিফাত।
_কংগ্রাচুলেশনস স্যার।ম্যাম ৩ টা বেবির জন্ম দিয়েছেন ! দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছে আপনাদের। সময়ের ব্যাবধানে ছেলেরা বড় আর মেয়েটা ছোট।
_কি…ক- ই..কি বলছেন আপনি এটা? মৃন্ময়ীর তো একটা বেবি ছিল…তাহলে তিনটা কিভাবে.? হতবাক স্বরে বললো সিফাত।
_ওর তিনটা বেবিই ছিল সিফাত। তোকে বলতে মানা করেছিল পলক। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। ডাক্তারকেও ও মানা করেছিল তোকে যেন না জানায়। তাই আল্ট্রার রিপোর্টও তোকে দেখতে দেয়নি কখনো। কিন্তু আমরা জানতাম। -রেহনুমা বললেন।
বিস্ময়ে হতবিহ্বল সিফাত। বাকরুদ্ধ রীতিমত। মনে পড়ে গেল সে রাতের কথা যেদিন পলক তাকে তার ইচ্ছের কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
একদিন রাতের কথা। পলকের তখন ৭ মাস চলে প্রেগন্যান্সির।বিছানায় শুয়ে সিফাতের বুকে মাথা রেখে পলক জিজ্ঞেস করেছিল,
_আচ্ছা ক্যাপ্টেন, আপনার ছেলে বেবি চাই নাকি মেয়ে বেবি?
_আমার তো টুইন লাগতো গো মৃন্ময়ীইইই!! কিন্তু,এত কিছুর পরে আল্লাহ যে সন্তান দিচ্ছেন সেটা ছেলে মেয়ে যাই হোক আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে আর বেবিকে সুস্থ রাখলেই আমি খুশি। আর কিচ্ছু লাগবে না আমার। পলক সেদিন কিটিকিটিয়ে হেসে বলেছিল,
_আচ্ছা,আমাদের যদি ২/৩ টা বেবি একসাথে হয় তাহলে কেমন হবে,বলুন তো?
_সিফাতও হেসে বলেছিল, এইবার তো আর সম্ভব না। একটাই আছে ওই চড়ুই পাখির মত পেটটায়। কিন্তু, পরের বার আল্লাহ চাইলে ২/৩ টা কেন, ৪/৫ টা গোল করতেও অসুবিধে নেই আমার!
পলক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল সেদিন সিফাতের কথায়। একবার মা হতে গিয়েই যে বেহাল দশা তার, এরপরে আরও! তার ওমন অবস্থা দেখে শরীর কাঁপিয়ে হেসেছিল সিফাত সেরাতে।
আবার , একদিন বিকেলের ঘটনা।পলকের পেটে অলিভওয়েল মালিশ করছিল সিফাত। সেদিন সে মালিশ করতে করতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো।বললো,
_এইইই মৃন্ময়ী, দেখুন বেবি কিক মারছে!!! পলক প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও পরে সিফাতের এক্সাইটমেন্ট বুঝতে পেরে স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
_হ্যাঁ, তো? বড় হচ্ছে.. কিক তো মারবেই।
_বেবির বোধয় ওয়েল ম্যাসাজ পছন্দ হয়েছে। খুশি হয়ে কিক মারছে। দাঁত ক্যালিয়ে হেসে বললো সিফাত। পলকের পেটের উপরই হাত রাখা ছিল। কথা বলতে বলতেই আবারও কিক মারলো বাচ্চা। সিফাত আনন্দে গদগদ। কিন্তু, সেটা সামলে উঠার আগেই আরেকটা কিক মারলো। সিফাত পুরো অবাক। একসাথে এতগুলো কিক সাধারণত বাচ্চারা মারে না। পলককে জিজ্ঞেস করলো,
_এত কিক কেন মারছে কেন,মৃন্ময়ী ?
_একটার সাথে আরেকটা লাগালাগি তো। তাই একটা মারলে বাকিগুলাও মারে। আপেলে কামড় দিতে দিতে তালে তালে বললো পলক।
_মানে? একটা মারলে বাকিগুলাও মারে কিভাবে?বাচ্চা তো একটাই!অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সিফাত। টনক নড়লো পলকের। আমতা আমতা করে বললো,
_আ…আ’ব…মানে আপনি ম্যাসাজ খুব ভালো করেন তো। তাই হাত পা সব একসাথে নাড়াচ্ছে। রেস্পন্স করছে আর কি! এখন তো হাত-পা সব প্রায় একসাথেই জড় সড় হয়ে আছে,, তাই হাত পা সব গুলোই ছুঁড়ে লাথি গুতা মারতেছে আর কি!! ক্যাবলা হেসে বললো পলক।
_অহ, আচ্ছা.. আচ্ছা। দাঁড়ান আরও ভালো করে মালিশ করছি। আরাম লাগবে আমার সোনাটার। বলেই আরও বেশি করে ম্যাসাজ করতে শুরু করেছিল সে।
তবে এখন সিফাত বুঝতে পারছে কেন সেরাতে পলক এভাবে বলেছিল। আর কেনই বা সেদিন পর পর তিনটা কিক মারা ফিল করেছিল সে। যমজ বাচ্চাগুলো তো এমনই।সবগুলার সব কাজ একসাথে। ও.টি যাওয়ার আগেও বাচ্চাগুলা বলতে যে এদেরই বুঝিয়েছিল সেটাও এবার বুঝলো সিফাত। আর সিফাত কিনা ভেবেছিল ইয়ানা, প্রাপ্তি, ইশান, নিয়ন আর তাদের প্রথম সন্তান-এদের কথা বলছিল পলক।
_কাকে আগে কোলে নিবেন আপনি? এদের ওয়েট কিছুটা কম। এনআইসিইউতে রাখতে হবে। কিন্তু,ম্যাম বারবার করে বলে দিয়েছেন যেন আপনাকে দেখিয়ে তবেই এদের কোথাও নেই।
_মান্নাতকে দিন আমায়। সিফাত বললো।
_কাকে দিবো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো নার্স।
_আমার আর মৃন্ময়ীর মেয়ে। আমাদের মান্নাতকে।
সিফাতের এহেন কথায় নার্স বুঝলো সিফাত তাদের মেয়েকে চাইছে। হাসি মুখে নার্স বললো,
_ওও আচ্ছা। সুন্দর নাম। মাশাল্লাহ! বলেই তারই কোলে থাকা মেয়ে বাবুটাকে এগিয়ে দিল সিফাতের দিকে। আলতো হাতে সিফাত নিল তাকে। মন ভরে দেখলো তাকে। পলকের রুপ রঙ নিয়েই এসেছে সে। বললো, মাশাল্লাহ! ভীষণ খুশি সিফাত। যেখানে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাই সে হারিয়েছিল সেখানে রবের রহমতে আজ তিন সন্তানের বাবা সে। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা সুখজল নেমে এলো তার চোখ বেয়ে।
হজ্বে গিয়ে পলক মানত করেছিল এই একটা সন্তানের জন্য।
নামায রোজা দান খয়রাত কিছুই বাদ দেয়নি সে। নিজের বিনিময়ে হলেও একটা সন্তান চেয়েছিল সে সিফাতের জন্য। আর মেয়ে সন্তান আল্লাহর বিশেষ রহমত। তাই এই মেয়েকে সে নাম দিয়েছে, মৃন্ময়ী মান্নাত।
__________________________________
_আরে আরেএএএ…কি শুরু করেছিস তোরা রিহান? পলাশ মামা হয় ওদের। ওর কোলেও দে তোরা একটু।
মান্নাতকে সিফাত কোলে নেওয়ার পর পরই রিহান আর তিয়ানও ছুটে গিয়ে কোলে নিয়েছে সা’দ (সৌভাগ্য)আর সু’আদ (প্রভাব -প্রতিপত্তি)কে। পলক নিজেই ঠিক করে রেখে গেছিল এই নাম। আর মেয়ের নামটা সিফাত রাখবে বলে কিছু ঠিক করেনি। তাদের এই কাড়াকাড়ি দেখে এমন বললেন রেহনুমা।
_ আন্নি-মা বকছো কেন? সা’দ আর সু’আদ কে একটু রাখিনা কোলে। পলাশ ভাইয়া পরে নিবেনি।- রিহান বললো।
_হ্যাঁ, আন্নি-মা। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমাদের পলকের ছেলে এটা। মাশাল্লাহ কি সুন্দর হয়েছে। একটুও কাছ ছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না তো। -খুশিতে গদগদ হয়ে বললো তিয়ান।
_এবার নিজেরও একটার বন্দোবস্ত কর বাবা। অনন্যাকেও সুযোগ দে আমাকে দাদী বানানোর। -হেসে বললেন রেহনুমা।
তিয়ানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল অনন্যা। সহসা এমন কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সে।অফিসে কাজ করার সূত্রে ১ বছরের সম্পর্কের পর ৭ মাস আগে বিয়ে হয়েছে তিয়ান আর অনন্যার।প্রচন্ড ভালোবাসে সে তিয়ানকে। আর তিয়ানও নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসেছে মেয়েটাকে। পলক আর তিয়ানের ব্যাপারেও সে জানে সবই। নিজের বোনের মত ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে সে পলককে । তাই পলকের ডেলিভারি কথা শুনে সে আর তিয়ান দুজনেই ছুটে চলে এসেছে।
_আমাকে কেন বলছো আন্নি-মা?। আমি তো একপায়ে খাঁড়া বাবা হওয়ার জন্য। এখন তোমার বৌমা আমাকে সুযোগ না দিলে তোমাকে দাদী কি করে বানাই বলতো?
-তিয়ান বললো রেহনুমাকে। সিফাত পলকের পাশাপাশি এই পরিবারের সবার সাথেই বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে তার। তাই রেহনুমা তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে। তুই করে বলে। আর তিয়ানও রিহানের মতোই তাকে আন্নি-মা বলে।
_এই চুপ করো তো তুমি। সবাই আছে তো এখানে। কি ভাববে তারা? লাজুক হেসে বললো অনন্যা।
_সে যে যাই ভাবুক। এবার কিন্তু, সত্যি সত্যি বাবা হতে চাই আমি। ওয়েট…আজ বাড়ি ফিরেই সব বন্দোবস্ত শুরু করবো। বলেই দুষ্টি হেসে চোখ মারলো সে অনন্যাকে।
_ধ্যাত! লাজুক হেসে তিয়ানের হাতে হাল্কা চাপড় মেরে বললো অনন্যা। হাত বাড়িয়ে কোলে নিল সা’দকে।
ওদিকে,
_এই…তুমি দিবা না ওরে? আমি কিন্তু খালামণি হই ওর। আমার অধিকার আগে। দাও বলতেছি। -ঝগড়ার সুরে বললো নিশাত।
_আমিও চাচ্চু হই ওর। আমার অধিকারটাই তাই আগে, ওকে আদর করার। রিহান বললো।
_এইই..একদম বেশি বেশি অধিকার দেখাইতে আসবা না কিন্তু! আমি… (নিশাত)
_উফফফ….চাচী-আম্মু ! শুধু কি তোমরাই দেখবে? আমরা দেখবো না ভাইয়া গুলাকে? ইয়ানার কথায় ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে সামনে তাকালো রিহান- নিশাত। ইয়ানা আর প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড বিরক্ত তারা। কারণ সামনা সামনি তারা প্রায় সময় রিহান আর নিশাতকে এমন মিষ্টি মধুর ঝগড়া আর খুনসুটি করতে দেখে। বিয়ের পর থেকে এই চলছে তাদের। ১ বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। রিহানই নিশাতকে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রিহানকে সবাই চিনে ৩ বছর ধরে। জানে সে কেমন। তাই তার মত ছেলে পেয়ে আর আপত্তি করেনি পলকের পরিবার।কিন্তু, নিশাতের খুব জোর আপত্তি ছিল। সে আগে অনার্সটা শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু, সেকেন্ড ইয়ারের এক্সাম শেষেই তাকে বিয়ে করে রিহান। এখনো অবশ্য সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। রিহান বা তার পরিবার কেউ আপত্তি করেনি। প্রথমে আপত্তি থাকলেও রিহানের ভালোবাসা, লেখাপড়ায় তাকে উৎসাহিত করা,,তার খেয়াল রাখা সব মিলিয়ে সেও ভালোবেসে ফেলে রিহানকে। কিন্তু, প্রকাশ করে না সেভাবে। এই মানুষটাকে জ্বালিয়ে,পুড়িয়ে, অপ্রকাশ্যে ভালোবাসতেই বেশি ভালো লাগে তার। তাই বেশিরভাগ সময় এমন মিষ্টিমধুর ঝগড়া করে সে রিহানের সাথে। কিন্তু, রিহানও বুঝে সবটাই। মুখে না বললেও নিশাত তাকে ভালোবাসে এটা বুঝে সে। তাই নিজেও বেশ উপভোগ করে নিশাতের এই ভালোবাসাময় ঝগড়া খুনসুটিগুলো।
_দেখ না ইনু, আমাকেই তো দিচ্ছে না। তোকে দেই কি করে?
_ইনু আম্মা…তোমার চাচী-আম্মুর দোষ সব। আমি কিছু করিনি।
_তুমিই তো কোলে নিয়ে রেখেছো আংকেল। ছোট ফুপ্পি কিভাবে নিবে তাহলে? প্রাপ্তি বললো।
রিহান চুপ হয়ে গেল প্রাপ্তির কথায়। চুপচাপ নিশাতের কোলে দিলো বাবুকে। নিশাত কোলে নিয়ে সীটে বসলো, যেন ইয়ানা ও প্রাপ্তি দেখতে পারে সহজে।
সিফাত হতভম্ব সবার এমন কাড়াকাড়ি দেখে। পলাশকে খেয়াল করতেই দেখলো নাজিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। অসহায় মুখ করে দেখছে বাচ্চাগুলোকে। কিন্তু,,তিয়ান রিহান আর নিশাতের যন্ত্রণায় কোলে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। নাজিয়া সেটা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। পলাশের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে গিয়ে মান্নাতকে তার কোলে তুলে দিল সিফাত। তাকে কোলে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলো তাকে পলাশ। তারপর নাজিয়াকে বললো, আমাদেরও এমন একটা মেয়ে হবে রে নাজিয়া? (আগের অভ্যাস মতই নাজিয়াকে সে তুই করেই বলে)
_প্রাপ্তির ভাই লাগবে বলছে! করুণ মুখ করে বললো নাজিয়া। তা দেখে হাসলো পলাশ।
২’৫ বছর হলো পলাশের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। বিদেশে যাওয়ার ৫ মাস পরেই ডিভোর্স লেটার পাঠায় নাজিয়ার স্বামী তাকে। সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য ওখানেই নিজের কানাডিয়ান এক মেয়েকেই বিয়ে করে নাজিয়ার স্বামী। ডিভোর্স লেটার পাঠায় নাজিয়াকে। এই নিয়ে প্রতারণার মমলা করে নাজিয়ার পরিবার নাজিয়ার শশুড়বাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, বিয়েটাও আর টিকিয়ে রাখেনি তারা। ডিভোর্স হয়ে যায়। মামলায় জেল না হলেও নাজিয়াকে মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল নাজিয়ার প্রাক্তন স্বামীকে। কিন্তু,, একজন মেয়ের ডিভোর্স যে কারণেই হোক, সমাজ একটা মেয়েকেই দোষী করে। নাজিয়াকেও শুনতে হয়েছিল অনেক কথা। অনেকের অনেক দোষারোপ, কু-প্রস্তাব! নাজিয়াকে বড্ড স্নেহ করেন আমজাদ আলী। একমাত্র বোনের মেয়ে বলে কথা! তাই তিনিই পলাশের সাথে নাজিয়ার বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। নাজিয়ার পরিবারও আপত্তি করেনি আর। নাজিয়া প্রথমে করতে চায়নি বিয়েটা। করুণা মনে হয়েছিল তার এটা। কিন্তু, পলাশ ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিল বিয়ের জন্য। প্রাপ্তিকে সে নিজের মেয়ে হিসেবেই ভালোবাসে। কেউ বুঝতেই পারে না যে এটা তার নিজের মেয়ে নয়। বিয়ের ১’৫ বছর পর্যন্ত সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না পলাশের সাথে নাজিয়ার। কিন্তু, ধীরে ধীরে সেও সিক্ত হয়েছে পলাশের ভালোবাসায়। আর কয়েকমাস পরেই পলাশের সন্তানের মা হতে চলেছে সে।
পলাশের কোল থেকে মান্নাতকে কোলে নিল অন্তরা। জীবনের কঠিন সময়ের স্রোত পেরিয়ে সেও স্থির হয়েছে কিছুটা। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ৩ বছর হলো চাকরি করছে সে। বিয়ে করেনি আর। তবে তারই এক কলিগ জোবায়ের পছন্দ করে তাকে। সেও অবিবাহিত। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু অন্তরা রাজি হচ্ছে না। নিয়নকে একাই বড় করতে চায় সে। নিশাত, পলক, পলাশ অবশ্য খুব জোর চেষ্টা করছে অন্তরাকে রাজি করানোর। জোয়ায়েরকে তাদের বেশ পছন্দ। আমজাদ আলীরও আপত্তি নেই। প্রথম প্রথম নারাজ থাকলেও নিয়নের জন্মের পর মন গলতে শুরু করে আমজাদ আলীর। এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে তার সাথে নাজিয়ার সম্পর্ক।
দুই নাতির কানেই আযান দিলেন আমজাদ আলী। ইশতিয়াক আলী প্রথমেই কোলে নিলেন মান্নাতকে। পলককে এখন সে চোখে হারায়। নিজের মেয়ের মত স্নেহ করেন। এই মেয়েটার ধৈর্য, চেষ্টা, ভালোবাসা খুব করে আগলে রেখেছে তার গোটা পরিবারকে। ব্যবসায়ও তার অবদান কম নয়। আর সেই পলকের মেয়েই মান্নাত। তার একমাত্র নাতনী!
____________________________________
পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে পলককে।বেশ কাহিল সে। তিন তিনটা বাচ্চাকে গর্ভে রেখেছিল এতকাল। একরাত এখানেই রাখা হবে তাকে। সকালে কেবিনে শিফট করা হবে।
সিফাত এসে বাইরে থেকে দেখে গেছিল একবার। ঘুমে ছিল তখন পলক।
মাঝরাতে নার্সরা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। ব্রেস্ট ফিডিং করানোর জন্য। এ্যানেসথেসিয়ার প্রভাব কাটছে ধীরে ধীরে। ব্যাথায় অসহনীয় লাগছে তার এখন। তারপরেও বাচ্চাগুলোকে খাওয়াচ্ছে সে। হাজার হোক মা তো! সব ব্যাথা কষ্টের উর্ধ্বে সন্তানের সুখ,,আনন্দ, সুস্থতাই আগে।
পরেরদিন কেবিনে শিফট করা হলো পলককে। হসপিটালে শুধু সিফাত, রুকু আর নিশাত ছিল। সারা আসেনি একবারের জন্যও। বাচ্চাদের ফিডিং করাচ্ছিল পলক। ফিডিং করানো অবস্থাতেই সিফাত এলো রুমে। তাকে আসতে দেখে নিশাত বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। কেবিনে ঢুকে পলকের পাশে বসলো সিফাত। পলক শুয়ে আছে। পাশে মান্নাত। খাচ্ছে সে। বেডের পাশে কিছুটা দূরে দুটো ঝোলানো খাটে রাখা হয়েছে সা’দ ও সু’আদ কে। পলকের কপালে সময় নিয়ে এবং বেশ গভীরভাবে চুমু দিলো সিফাত। তারপর, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_কেমন আছেন মৃন্ময়ী ?
_আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
_আলহামদুলিল্লাহ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ যেমন হয়,তেমনই আছি আমি।
_সারপ্রাইজ কেমন লাগলো?
_শ্বাসরুদ্ধকর! এত খুশি এত এক্সাইসমেন্ট কখনো হয়নি আমার এই জীবনে। আর এই প্রাপ্তির জন্য আমি আল্লাহ আর আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
_ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন!আমাকে মা হওয়ার স্বাদ দেওয়ার জন্য।
সিফাত হাসলো আলতো করে। যে মেয়েটার ধৈর্য্য আর চেষ্টার জন্যই এত কিছুর পরে সে বাবা হতে পারলো, আজ সেই কিনা তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কি অদ্ভুত ভালোবাসা!
_মৃন্ময়ী… ঘোর লাগা কন্ঠে ডাকলো সিফাত।
_জ্বী?
_ভালোবাসি! -পলকের স্যালাইন পুশ করা হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো সিফাত।
_ক্যাপ্টেন…
_হু?
সিফাতের হাতটা টেনে নিয়ে তাতে একটা চুমু দিলো পলক। মৃদু হেসে বললো,
_ভালোবাসি প্রিয়!
(সমাপ্ত)