ভুলবশত প্রেম পর্ব-২

0
4058

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

আমি খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে আপুর এক পাশে বসলাম। ওপাশ থেকে আভা এসে আপুর অপর পাশে বসলো। আমাদের দুজনের বসে পড়ার পরপরই অনেকেই আমাদের ছবি তুলতে লাগলো । যার মধ্যে পরিচিত মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম এবং অপরিচিত মানুষের সংখ্যা অগণিত। এতো মানুষের ভিড়ে অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে গেলাম আমি। এদিকে কনের বোন হওয়ার খাতিরে এ মূহুর্তে স্টেজ ছেড়ে উঠেও যেতে পারছি না আবার ভদ্রতার খাতিরে ঐ মানুষদের ছবি তুলতে নিষেধও করতে পারছি না। এ যেনো উভয় সংকট! উপায় না পেয়ে চেহারায় বিরক্তি এবং অস্বস্তিকর ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি আমার চেষ্টায় সফল হতে পারলাম না বোধহয়। কারন এখনো ক্যামেরাম্যানসহ দু চারজন ছেলে নানা এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে যাচ্ছে। যেনো আমরা সাক্ষাৎ বলিউড এর কোনো নায়িকা!

” কারোর পারমিশন না নিয়ে ছবি তোলা উচিত না, এটা একটা কমন ম্যানার্স। এখানে কি কারোর সে বিষয়ে জানা নেই?”
আকস্মিকভাবে একটি পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে আমার ডান দিকে তাকালাম আমি। সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। কারণ উক্ত বচনের মালিক আর কেউ নন বরং সেই অভদ্র যুবকটি! আমি নগন্য সময়ের জন্য বিস্মিত চাহনিতে যুবকটির দিকে চেয়ে রইলাম এবং লক্ষ্য করলাম, শুধু আমি নয় বরং ছাদের মোটামুটি অর্ধেক জনগোষ্ঠী অভদ্র সেই যুবকটির পানে তাকিয়ে আছে। যুবকটি এ মুহূর্তে ফোন চালাতে ব্যস্ত। অর্থাৎ সে হয়তো ফোন চালাতে চালাতেই কথাগুলো বলেছে।

যুবকটি এবার অতি সন্তর্পণে পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে মাথা তুলে তাকালো এবং আমাকে আরেক দফা বিস্মিত করে সে এতো মানুষের প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অতি স্বাভাবিকভাবেই বললো,
” ভুল কিছু বলেছি বলে মনে হয় না আমার। হ্যাঁ, বিয়ে বাড়ি এটা, ছবি তোলা স্বাভাবিক। তবে চিনি না জানি না এমন মানুষের ছবি তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার পারমিশন নিয়ে ছবি তোলা উচিত। এই যে, যেমন ঐ ছেলেগুলো যতদূর সম্ভব কনের এবং কনের বোনগুলোর পরিচিত কেউ না। তা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাদের ছবি নিজেদের পার্সোনাল ফোনে তোলার আগে এটলিস্ট পারমিশন নেওয়া উচিত। এই মিনিমাম ভদ্রতাটুকু থাকা দরকার, অন্তত আমার মনে হয় এমনটা।”
এই বলে সে ঐ ছেলেদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিষ্টিভাবে আদেশ দিয়ে পুনরায় বললো,
” আপনারা ভদ্র ঘরের ছেলে বলে মনে হচ্ছে। সো এ পর্যন্ত উনাদের যা যা ছবি তুলেছেন তা ডিলিট করে দিলে ভালো হয়। ”
যুবকটির হেন কথায় ছেলেগুলো একদম থ বনে গেলো। তারা হয়তো আশা করতে পারেনি যে ছবি তোলার জন্য এভাবে তাদের অপমান হতে হবে!

অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবকটি আবারো পকেট থেকে ফোন বের করলো এবং আপুর হলুদের স্টেজ থেকে যৎসামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আপুর উদ্দেশ্যে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” ভাবী? আমি কি আপনার একটি ছবি তুলতে পারি?”

যুবকটির এহেন কাণ্ডে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম এবং খেয়াল করে দেখলাম শুধু আমিই নয় বরং আপুসহ অনেকেই তাঁর এ কাণ্ডে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে।
আপুর হতবুদ্ধি অবস্থা হতে বের হবার পূর্বেই যুবকটি আপুর কাছ থেকে আরেকদফা অনুমতি চাইলো। আপু এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো। তবে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জোরপূর্বক মাথা নাড়িয়ে বললো,
” জি অবশ্যই। ”

ব্যস, আপুর অনুমতি পাবার পরপরই যুবকটি আমাদের তিনজনের কয়েকটি ছবি তুলে হেলেদুলে চলে গেলো। আমি এখনও অজ্ঞাত যুবকটির হেন কাজে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায় হতে যেনো নামতে পারছি না।

আমি খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার পর আপুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এটা কে? চিনো আপু?”

আপু না সূচক মাথা নাড়িয়ে তার জবাব দিলো। অর্থাৎ আপু যুবকটিকে চিনে না। কিন্তু যুবকটি আসলে কে এবং আপুকে কেনো ভাবী বলে ডেকেছিলো তা সম্পর্কে অবগত না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না৷ অন্তত এটা জানি যে, যুবকটি ইমাদ ভাইয়ার আপন ভাই নয়। তবে কি কাজিন ব্রাদার?

আমি আপুকে রেখে রুমে যাবার বাহানায় স্টেজ ছেড়ে উঠে এলাম। পিছনে শুনতে পেলাম যুবকটিকে নিয়ে সকলের মাঝেই টুকটাক চাপা গুঞ্জন চলছে।

.

ছেলেদের বাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। এ তত্ত্ব এনেছে ইমাদ ভাইয়ার বোন, ভাবী এবং কাজিনরা। তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ইমাদ ভাইয়ার আপন বড় ভাবি এবং আপন ছোট বোন বাদে সবাই কাজিন ৷ ফুপাতো ভাইবোন, মামাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন আরো কতো! ইমাদ ভাইয়ার কাজিনের সংখ্যা যে এতো হবে তা আমার কল্পনাতীত ছিলো এবং মেয়েপক্ষকে তাদের জনসংখ্যার ভারিক্কি বোঝাতেই হয়তো এতো মানুষ এসেছে। মেয়েরা এসেছে মূলত তত্ত্ব সাথে নিয়ে এবং আপুকে দেখতে। আর ছেলেরা এসেছে শুধুমাত্র আপুকে দেখতে।

ইমাদ ভাইয়ার পরিবার বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উনার দাদার যেমন সম্পদ এবং প্রতাপ ছিলো, বংশ পরম্পরায় উনার বাবাও তা পেয়েছে। ইমাদ ভাইয়ার বাবার নিজস্ব তিনটি ফ্যাক্টরি আছে এবং উনার মা একজন জাজ।

ইমাদ ভাইয়া আর আপুর পরিচয় হয় সাধারণভাবেই। তারা দুজন একই ভার্সিটিতে ছিলো। তফাৎ একটাই ছিলো দুজনের মাঝে। তা হলো একজন ভার্সিটির ছাত্রী এবং অপরজন নব্য শিক্ষক। ইমাদ ভাইয়া খুব ভালো ছাত্র ছিলেন বিধায় পড়াশোনা শেষে সেই ভার্সিটিতেই পরে শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। আপুর সাথে তার দেখা সেই সিএসই ক্লাসেই। ইমাদ ভাইয়ার ভাষ্যমতে, আপু যখন সদ্য ভার্সিটিতে পা রাখে তখন ইমাদ ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিবে। সেসময় ভার্সিটির ক্যান্টিনে আপুকে প্রথম দেখায় তার ভালো লেগে যায়। ব্যস তখন থেকে ধীরেধীরে তিনি আপুকে ভালোবাসতে শুরু করে। আপু অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। সে এ ব্যাপারে সেদিন জানলো যেদিন ইমাদ ভাইয়ার বাবা মা আপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।

ইমাদ ভাইয়াদের পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আব্বু আম্মু প্রথমে বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করেছিলো। কারণ তাদের অবস্থা আর আমাদের অবস্থার ঢের পার্থক্য রয়েছে। এমতাবস্থায় এমন ধনী পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়ানোর অর্থ নিজ দায়িত্বে নানা বিপদ ডেকে আনা।
আপু প্রথমে মনে মনে বিয়ের স্বপ্ন বুনে ফেললেও আব্বু আম্মুর মতামত শোনার পর আপু পিছু হটে যায়। সে ইমাদ ভাইয়াকে সরাসরি না বলে দেয়। কিন্তু ইমাদ ভাইয়া আপুর পিছু ছাড়লো না। একদম নাছোড়বান্দার মতো যেমন আপুর পিছে পড়ে রইলেন তিনি তেমন আব্বু আম্মুকেও এ বিয়েতে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। অতঃপর আব্বু আম্মু নানা চিন্তাভাবনা করে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন।

.

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর ড্রইংরুমে এসে দেখলাম রুমটি লোকে লোকারণ্য হয় উঠেছে এবং রুমের প্রতিটি সদস্যই ইমাদ ভাইয়ার বাড়ি হতে আগত। তারা প্রত্যেকে এখন মুখের ভেতর চা নাস্তা ঠুসে নিতে ব্যস্ত। এদের মাঝে মোটাসোটা গোছের একটি ছেলেকে দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড় হয়ে এলো। কম বয়সী ছেলেটি ভীষণ আরামে বসে গোগ্রাসে নিজের সামনে থাকা নাস্তাগুলো গিলছে। ছেলেটির এ ভক্ষক রূপ দেখে আমার মুখ থেকে আপনাআপনি ‘মস্ত বড় খাদক’ শব্দগুলো বেড়িয়ে এলো। ছেলেটির এতো খাবার ঠুসা দেখে বেশ রাগ এবং বিরক্ত লাগলো আমার। বয়সে তো নিশ্চয়ই একেবারে ছোট নয় সে। সুতরাং একজনের বাড়িতে এসেছে আদবের সহিত কিভাবে খেতে হয় এবং কতটুকু খেতে হয় তা জানে না কেনো সে। অদ্ভুত!

মন চাইছে ছেলেটিকে বলি, ‘ এই যে খাদক, আপনি যে এতোগুলা খাবার ঠুসে ঠুসে খাচ্ছেন, এগুলোর টাকা কে জোগাড় করে দিয়েছি শুনি? আমার আব্বু কি বিয়েতে শুধু আপনার এবং আপনার মতো খাদকদের জন্য খাবারে আয়োজন করেছে না কি!’
হঠাৎ আম্মুর ডাক শুনে মনের আশা মনেই কবর দিয়ে ঘাড় ঘুরে তাকালাম। আম্মু আমাকে কিছু না বলেই হুট করে আমার হাতে মিষ্টির বাটির ট্রে ধরিয়ে বললো,
” যা, এটা ওদের সামনে দিয়ে আয়। আরেক ট্রেতেও নিতে হবে তো। এটা দিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।”

এতোগুলো মানুষের সামনে মোটেও আম্মুর এ আদেশ পালন করতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এ আদেশ পালন না করেও উপায় খুঁজে পেলাম না। কারন আম্মু আমাকে ট্রে হাতে ধরিয়েই আবারো রান্নাঘরে ছুট দিয়েছে এবং আমার আশেপাশে এমন কেউও নেই যার হাতে ট্রেটি ধরিয়ে দিবো আমি। অগত্যা বলেন বিগড়ে যাওয়া মনমেজাজ নিয়ে ট্রেটি সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে গেলাম আমি। মিষ্টির ট্রেটি সেন্টার টেবিলে রাখার সাথে সাথে আমার দৃষ্টি চলে গেলো সেই যুবকটির উপর। সোফায় বসে ভারী ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন টিপছে সে। আশেপাশের কোনোকিছুর প্রতিই যেনো এখন তার খাতির নেই।
হঠাৎ যুবকটির পাশে বসে থাকা ইমাদ ভাইয়ার এক কাজিন যুবকটির দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আদ্রিশ, দোস্ত এই অ্যাপটা দেখ তো। এটা সমস্যা করছে খুব।”
ইমাদ ভাইয়ার সেই কাজিনের সুবাদেই এতোক্ষণ পর অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবকটির নাম জানতে পারলাম আমি।

এ মুহুূর্তে সেখানে কোনো কাজ না থাকায় আর এক মুহূর্তও দেরি না করে উল্টো পথে দরজার দিকে পা বাড়ালাম আমি। যেতে যেতে ভ্রুজোড়া প্রসারিত করে স্বগোতক্তি করে বললাম,
” অদ্ভুত নাম! এমন আনকমন নাম এর আগে কোথাও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। অদ্ভুত নামের কিম্ভূতকিমাকার মানুষ।”
®সারা মেহেক(গ্রুপ সারা’র গল্পকুঞ্জ)
পর্ব :১ https://www.facebook.com/615626882415008/posts/945936962717330/?app=fbl
#চলবে
(গল্পের রেসপন্স দেখে আমি যারপরনাই হতাশ🙂। আপনারা যারা গল্পটি পড়ছেন প্লিজ প্লিজ তারা রেসপন্স করবেন ও এক শব্দ হলেও কমেন্ট করে যাবেন। আর আজকের পর্বটা কেমন লেগেছে তা অবশ্যই জানাবেন। না জানালে কিন্তু নেক্সট পর্ব দিতে দেরি করবো😒
আর ‘নব্য দিনের সূচনা ‘ গল্পটি আগামীকাল পেয়ে যাবেন। হ্যাপি রিডিং❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here