#ভুলবশত_প্রেম
#লেখিকা:সারা মেহেক
৩
ইমাদ ভাইয়ার সকল কাজিনরা একে একে এসে আপুর সাথে ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে প্রত্যেকেই মজা করে আপুর গালে এবং নাকে হালকা হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে চলে গেলো। সবার শেষে আদ্রিশ, যিনি কি না ইমাদ ভাইয়ার কোনো আত্মীয় হোন হয়তো, তিনি অতি ভদ্রতার সহিত আপুর গালে হালকা একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন। সবার হলুদ লাগানো শেষে ইমাদ ভাইয়ার একমাত্র ভাবী অর্থাৎ জেবা ভাবী আপুকে, আমাকে ও আভাকে এবং আমাদের ছোটবড় সব কাজিনদের সাথে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ পরিচয়ের মাধ্যমেই জানতে পারলাম সেই পেটুক ছেলেটার তন্ময় এবং সে ইমাদ ভাইয়ার সবচেয়ে ছোট মামাতো ভাই। অর্থাৎ ইমাদ ভাইয়ার কাজিনদের মধ্যে সে সবচেয়ে ছোট। তন্ময় এবার ক্লাস সেভেনে উঠলো মাত্র। অথচ হাবভাব এবং শরীর তার এমন যে মনে হবে মাত্রই কলেজে উঠেছে সে।
ইমাদ ভাইয়ার সব কাজিনদের মধ্যে সাদিক নামের ছেলেটির আচার ব্যবহার দেখে খানিকটা বিস্মিত এবং অভিভূত হলাম আমি। স্পষ্টত, শুধু আমি নয় বরং আমার দুটো চাচাতো বোন লামিয়া এবং তাসনিমও তাকে দেখে অভিভূত হলো। যদিও তাদের দুজনের মুখে পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা সরাসরি শুনিনি৷ কিন্তু আমার পেছনে দুজনের কানাকানি ফিসফিস শুনে ব্যাপারটি ঠিকই ধরতে পেলাম আমি।
ছাদে উপস্থিত সবার মাঝে সেই সাদিক নামের ছেলেটিই সবচেয়ে নম্র ভদ্রভাবে অবস্থান করছেন। অবশ্য উনাকে দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে উনি এতো হৈচৈ দেখে খানিক বিরক্ত। উনার এ বিরক্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবে উনি নিজের চওড়া কপাল এবং লম্বা নাকটা মাঝে মাঝে কুঞ্চিত করছেন। আবার দাড়িবিহীন ফর্সা গালটায় মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে নিচ্ছেন। উনার চেহারার এরূপ প্রতিক্রিয়া যেকোনো মেয়ের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।
আপু সকলের সাথে আপাতত নাম জানার মাধ্যমেই পরিচিত হলো। ঐ বাড়ি হতে আগত সকলের সাথে পরিচিতি হবার পরও আপুর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য একজন মানুষ বাকি ছিলেন এবং তিনি হলেন আদ্রিশ। উনি এতোক্ষণ এদের মাঝে ছিলেন না। বরং ছাদের এক কোনায় রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শত চেঁচামেচির মাঝেও ফোনে মনোযোগী হয়ে কিছু দেখছিলেন উনি। জেবা ভাবী আদ্রিশকে দেখতে পেয়ে হাঁক ছেড়ে বললেন,
” আদ্রিশ? তুই ওখানে কি করছিস? এদিকে আয়।”
জেবা ভাবীর ডাক শুনে আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালেন। স্বল্প সময়ের জন্য এদিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য কিছু ভাবলেন। অতঃপর ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” কি হয়েছে ভাবী? ডাকছো কেনো?”
জেবা ভাবী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“বিয়েতে এসেছিস, মজা করবি। তা না করে সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস কেনো? এদিকে এসে নাফিসাকে নিজের বায়োডাটা শুনিয়ে দিয়ে যা। তুই তো ওকে চিনেছিস। কিন্তু ও তো তোকে চিনেনি। ”
জেবা ভাবীর কথায় আদ্রিশ মুখ ফিরিয়ে মৃদু হেসে দিলেন। অতঃপর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে স্টেজের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। পথে কেমন এক অদ্ভূত চাহনিতে আমার দিকে এক নজর তাকালেন উনি এবং আমার চোখের পলক ফেলতেই উনি নিজের দৃষ্টি আবারো পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলেন। উনার এরূপ চাহনিতে আমি খানিক মিইয়ে গেলাম৷
আদ্রিশ স্টেজের নিকট এসে সামনে অবস্থিত হলুদের বাটি থেকে দু হাতে বেশ খানিকটা হলুদ মাখিয়ে নিলেন। অতঃপর আমাদের সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে আচমকা আপুর দু গালের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। উনার এমন কাণ্ডে আমি বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম এবং আপুসহ বাকি সকলেই একদম থ বনে গেলো। স্পষ্টত, আদ্রিশের এমন কার্যকলাপ কেউই আশা করেনি। এদিকে আপুর অবস্থা দেখে আদ্রিশ ভ্রু নাচিয়ে জেবা ভাবীর উদ্দেশ্যে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” আমার বায়োডাটা দিয়ে নাফিসা ভাবীর কাজ কি? আমায় পছন্দ হয়েছে বুঝি? বিয়েশাদী করার প্ল্যানিং এ আছে না কি?”
এই বলে উনি আপুর দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম একটা গোয়েন্দা ধরণের ভাব নিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি নাফিসা ভাবী? মনে মনে কি চলছে আপনার? আমার বন্ধুকে ছেড়ে আমাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবেন না তো আবার?”
আদ্রিশের এহেন কথায় আমার গাল ঝুলে পড়ার উপক্রম হলো। আমি বিস্মিত চাহনিতে উনাকে দেখছি। উনি যে এরূপ মজা করে বসবেন তা কল্পনা করতে পারিনি। এদিকে উনার এ কাজে জেবা ভাবীসহ সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। কিন্তু আমার আপু আদ্রিশের এমন কাণ্ডে লজ্জায় কাঁদা হয়ে গেলো। সবার হাসাহাসির পর্ব শেষ হতে না হতেই আভা আলতো করে পিছন থেকে আমাকে ডাকলো। আমি ইশারায় ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও ফিসফিস করে বললো,
” ছোট আপু, ওদিকটায় একটু চলো। কথা আছে।”
এই বলে ও আমায় টেনে নিয়ে স্টেজের পিছনে নিয়ে এলো। খানিকটা চিন্তিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
” ছোট আপু, ছোটখাটো, নাহ, বড়সড় একটা বিপদ আসবে মনে হচ্ছে। ”
আভার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি বলছিস? কিসের বিপদ আসবে?”
আভা পূর্বের ন্যায় বললো,
” আব্বুর যে ফুফু আছে না? ঐ যে, বেশি ক্যাটক্যাট করে যে….
আমি মাঝপথে ওর কথা চট করে ধরে বললাম,
” আনোয়ারা দাদি?”
আনোয়ারা দাদির নাম বলতেই আভা পুনরায় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
” হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই আনোয়ারা দাদিই। ঐ যে, আদ্রিশ নামের যে ভাইয়াটা আছে না? উনি যখন আপুর গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো তখন আনোয়ারা দাদি ছাদে আসায় তা দেখে ফেলেছিলো। ওসব দেখেই কেমন নাক সিটকাতে সিটকাতে চলে গেলো। আমার তো এখন টেনশন হচ্ছে। উনি এ নিয়ে আবার আজ হাঙ্গামা না করে বসে।”
আভার কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবুও ওকে সান্ত্বনা দিতে বললাম,
” এতো চিন্তা করিস না তো। কিছুই হবে না। শুধু শুধু এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করে মজা নষ্ট করার দরকার কি? আর এখানে কি শুধু আমরা আছি না কি? আমাদের মামি, চাচিরাও তো আছে। সো নো চিন্তা ডু ফূর্তি। ” এই বলে আমি আভাকে টেনে নিয়ে স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ততক্ষণে আদ্রিশ নিজের হাত হতে এবং আপু নিজের মুখ হতে অতিরিক্ত হলুদ মুছে ফেলেছে। আপু জেবা ভাবীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” উনি কি ইমাদের কোনো কাজিন হয়?”
জেবা ভাবী স্মিত হেসে উত্তর দিলেন,
” ও ইমাদের ছোট্টবেলার বন্ধু। শুধু ইমাদের বন্ধুই নয়, তামিমেরও বন্ধু ও।” এই বলে জেবা ভাবী আদ্রিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে ইশারা করলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম, এই ছেলেটি সেই ছেলেটি যে ড্রইংরুমে আদ্রিশের পাশে বসেছিলেন৷ উনি সম্পর্কে ইমাদ ভাইয়ার ফুপাতো ভাই হোন, সেই সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো আছেই।
জেবা ভাবী আপুর পাশে বসতে বসতে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোমার সাথে খাতির জমাতে আর তোমাকে দেখবে বলে আদ্রিশ ইমাদের কাছ থেকে এখানকার ঠিকানা নিয়ে সকাল সকালই চলে আসে। কিন্তু এখানে এসে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে আমার। ঠিক তো?”
এই বলে জেবা ভাবী আদ্রিশের দিকে ইশারা করলেন। আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ ভীষণ আফসোসের চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,
” আর বলো না জেবা ভাবী। শালা ইমাদ এমন সময়ে বিয়ের ঢোল পিটালো যখন আমার হাতে নতুন প্রজেক্টের কাজ৷ এদিকে কাজের প্রেশার আর ওদিকে ইমাদের বিয়ে। বিশাল ঝামেলার এক সময় পার করছি আমি। এই চারদিনের ছুটি নেওয়ার জন্য বসের কাছে আবেদন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি৷ বস তবুও ছুটি দিলেন না। কারন আমাদের এ প্রজেক্টের কাজ আর একদিন করলেই শেষ হয়ে যাবে। বস বললেন, আজ কাজ করে তারপর ছুটি নিতে। কিন্তু আজ ইমাদের হলুদ ফাংশন বলে কথা! আমি ছুটি না নিয়ে থাকি কি করে। অবশেষে বসকে ছুটির জন্য এই বলে রাজি করালাম যে, আজ টুকটাক ফ্রি সময় পেলে রাতের মধ্যেই বাকি কাজটুকু এক্সট্রা ইফোর্ট দিয়ে শেষ করে প্রজেক্ট সাবমিট করে দিবো। তখন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কাজই করছিলাম আমি। ”
এই বলে আদ্রিশ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আদ্রিশের বাচনভঙ্গি দেখে আপু মুচকি হেসে ফেললো। এদিকে জেবা ভাবী আদ্রিশের মাথায় ছোট্ট একটা চাপড় দিয়ে বললেন,
” ওরে মশাই…..তোর মতো ব্যস্ত মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই বোধহয়। ”
এই বলে উনি আপুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” আদ্রিশকে দেখে খুব ভদ্র মনে হয় তাই না?”
আপু স্মিত হেসে জবাব দিলেন,
” জি। তা তো অবশ্যই।”
আপুর এ সম্মতিতে সেখানে ছোটখাটো একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। জেবা ভাবী হাসিরত অবস্থায় বললেন,
” ও শুধু বাইরে দিয়ে দেখতেই ভদ্র। কিন্তু ভেতরটা দুষ্টুমিতে ভরা। অপরিচিত কারোর সাথে সে বড্ড ফর্মাল একজন মানুষ। কিন্তু কাছের মানুষের সাথে তার ফর্মালিটির বালাইও নেই।
আমাদের বাড়িতে আগে আসো….তারপর দেখতে থাকো এই বিচ্ছুবাহিনীর কাণ্ডকারখানা। আদ্রিশ আর তামিম বাড়িতে আসলে বাড়িটা আর নিজের রূপে থাকে না। পুরোই এই তিন জংলীর দখলে চলে যায়। ”
পুনরায় সেখানে ছোটখাটো হাসির রোল পড়ে গেলো। এদিকে আমি খানিক বিস্মিত হয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
“ভীষণ বিচ্ছু কোয়ালিটির ছেলে মনে হয়। ”
আমার কথা শেষ হতে দেরি তবে আপুর ফোন বাজতে দেরি হলো না। আপুর ফোন আমার হাতে থাকায় রিং হওয়ার সাথে সাথেই আমি টের পেলাম। ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে দেখলাম একটি অপরিচিত নাম্বার হতে কল এসেছে। আপুর ফোনে নাম্বার সেভ না থাকায় আমি ফোন রিসিভ করলাম না। বরং ওভাবেই রেখে দিলাম। এভাবে পর পর দুবার ফোন বাজলো। তৃতীয়বারে আমি খানিক বিরক্তি এবং সংশয় নিয়ে কল রিসিভ করলাম। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে একটি পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” নাফিসা? কল রিসিভ করছো না কেনো? আমার সাথে কথা বলতে মন চায় না? এতো এভয়েড করো কেনো আমাকে? তুমি কি জানো না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? আমার কাছে ফিরে আসো নাফিসা। এক কাজ করো, ঐ বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসো। কিচ্ছু আনতে হবে না সাথে৷ আমার শুধু তোমাকে চাই। আমরা বিয়ে করে ছোট্ট সুন্দর একটা সংসার করবো। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো নাফিসা। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও…….. ”
®সারা মেহেক(গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ)
#চলবে
(গল্পটা অবশ্যই শুধু রোমান্টিক ঘরানার গল্প নয়। সাথে টুইস্ট এণ্ড টার্ন থাকবে😎।
এই প্রথম মিমাদ্রিশ জুটিকে নিয়ে এমন ঘরানার গল্প লিখছি। জানি না কতদূর আপনাদের সাপোর্ট পাবো🙂💔)