#ভুলবশত_প্রেম
#লেখিকা:সারা মেহেক
৪
অজ্ঞাত লোকটির কথা আমার কর্ণধারে তীক্ষ্ণ কিছুর ন্যায় বাড়ি খেলো। লোকটির সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই আমি লাইন কেটে দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ে হাত এবং পা যেনো জমতে শুরু করে দিলো। এমন আকস্মিক ঘটনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ লোকটির সমস্ত কথা এখনো আমার কানে তরঙ্গের ন্যায় প্রতিফলিত হচ্ছে। সে যা যা বললো তার সবটাই কি সত্য? না কি আপুর সাথে কোনো কারণে পূর্ব শত্রুতার রেশ ধরে মিথ্যে কথা বলে আপুর বিয়ে ভাঙতে চাইছে সে? না কি আসলেই আপুর সাথে অজ্ঞাত লোকটির কোনো সম্পর্ক আছে? মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনায় ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। এতো প্রশ্নের বেড়াজালে পড়ে এহেন পরিস্থিতিতে ঠিক কি করা উচিত স্থির করতে পারলাম না আমি।
আপু কি সত্যিই এমনটা করেছে? ভুল করেও আব্বু আম্মু যদি জানতে পারে আপুর অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিলো তাহলে দুজনে সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমি আমার আপুকে ভালোভাবে চিনি। আপু কখনও এমনটা করবে না৷ আব্বু আম্মুকে সে খুব ভালোবাসে। দুজনের মান সম্মান নিয়ে সে নিশ্চয়ই খেলবে না। তাহলে লোকটি কে এবং আপুর নাম্বারই বা পেলো কোথায়?
অতিরিক্ত ভয় এবং চিন্তা করার দরুন আমার হৃদপিণ্ড দ্রিম দ্রিম করে বাজছে। চোখের সামনে বারংবার আব্বু আম্মুর চেহারা ভেসে উঠছে। এতো বড় একটা ধাক্কার সম্মুখীন হওয়ার পর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। এজনঢ় পাশ ফিরে একটা চেয়ার দেখতে পেয়ে ফোন নিয়ে বসে পড়লাম সেখানে। অত্যধিক চিন্তিতপ্রবণ হওয়ার কারণে নানা ধরনের চিন্তা আমার মস্তিষ্ক চেপে বসলো।
” এক্সকিউজ মি, আমি কি এক গ্লাস পানি পেতে পারি?”
আচমকা একটি পুরুষালি কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই আমি আঁতকে উঠলাম৷ ফলস্বরূপ হাত হতে অসাবধানতাবশত আপুর ফোনটি পড়ে গেলো। আমি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে আপুর খালাতো দেবর সাদিককে দেখতে পেলাম।চেহারায় মৃদু অসন্তোষের ছাপ তবে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমি সে মুহূর্তে খানিকটা অন্যমনস্ক থাকায় ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বললেন আপনি?”
সাদিক আমার প্রতিক্রিয়া দেখে মৃদু হেসে দিলেন। অতঃপর বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি আমার হাত হতে পড়ে যাওয়া আপুর ফোনটি তুলে আমায় বললেন,
” আপনি এতো ঘাবড়ে গিয়েছেন কেনো? এনি প্রবলেম?”
আমি উত্তেজিত হয়ে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললাম,
” জি জি না৷ কোনো সমস্যা নেই। ”
সাদিক মৃদু হাসলেন। আন্তরিকতার সহিত বললেন,
” একটু সাবধানে চলবেন। এভাবে হুট করে ঘাবড়ে যাওয়া মানুষকে সকলে কিন্তু আরো ঘাবড়ে দিতে চায়। আর যদি ঘাবড়েও যান সেটা বাহিরে প্রকাশ করবেন না। ”
এই বলে উনি পুনরায় মৃদু হাসলেন। উনার এরূপ আন্তরিক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য উনার দিকে চেয়ে রইলাম। কিন্তু উনার কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমি দ্রুততার সহিত নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু চাইছিলেন আপনি?”
সাদিক পুনরায় স্মিত হেসে বললেন,
” জি, এক গ্লাস পানি পেতে পারি কি? ছাদে পানি খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই বিধায় জিজ্ঞেস করলাম।”
ছাদে পানি খাওয়ার মতো ব্যবস্থা না থাকায় উনার কথায় আমি খানিক বিব্রত বোধ করলাম। তবুও ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাসূচক হাসি এনে বললাম,
” জি জি অবশ্যই। আপনি দাঁড়ান। আমি নিয়ে আসছি।”
এই বলে আমি পা বাড়ালাম। কিন্তু সাদিক আমার পথ রোধ করে বললেন,
” আপনার যদি কোনো প্রবলেম না থাকে তাহলে কি আমি আপনার সাথে নিচে যেতে পারি?”
আমি কোনো চিন্তাভাবনা ব্যতিতই বললাম,
” জি জি অবশ্যই। ”
কথা শেষ হতে না হতেই আমরা দুজনে স্টেজের পিছন হতে এসে রেলিঙের ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম। আচমকা পিছন হতে কে যেনো বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কি রে সাদিক! তুই তো সেই চালু চিজ রে! এতো তাড়াতাড়ি বেয়াইনরে পটায় ফেললি!”
অজ্ঞাত কণ্ঠের অনুসন্ধানে আমি এবং সাদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম আপুসহ প্রত্যেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। ব্যতিক্রম, শুধুমাত্র আদ্রিশের চেহারায় কোনো হাসি দেখলাম না।
জেবা ভাবী আমাদের দেখে ফোড়ন কেটে বললেন,
” তলে তলে টেম্পু চালাও তাই না? এত্তো ফাস্ট হলি কবে থেকে? এসেই মিমকে পটিয়ে ফেললি!”
জেবা ভাবীর কথার সুরে আমি লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। কিন্তু সাদিক তৎক্ষণাৎ জেবা ভাবীকে শুধরে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” ভাবী, আমি পানি খেতে যাচ্ছিলাম নিচে। শুধু শুধু ছোট্ট একটা বিষয়কে নিয়ে তোমরা মেয়েটার মজা নিচ্ছো। আমি পানি খেয়েই চলে আসছি৷ তোমরা রেডি থেকো। আমি আসলেই বেড়িয়ে পড়বো। ”
সাদিকের কথা শুনে আপুর খালাতো ননদ কুহু টিপ্পমী কেটে বলে উঠলো,
” যাও যাও সাদিক ভাই। পানি খেয়েই চলে আসতে হবে না। সময় নাও তুমি। যতোটা সময় লাগে নাও। আমরা ওয়েট করবো। ”
এই বলে কুহুসহ সকলে মিলিত সুরে হেসে উঠলো।
আমি এবং সাদিক আর এক মুহূর্তও সে স্থানে দাঁড়িয়ে না থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এলাম। ডাইনিং এ আসতেই ছোটখাট মাছের বাজার এর ন্যায় চেঁচামেচির শব্দ কানে এসে বাড়ি খেলো। তবে আমার এবং সাদিকের উপস্থিতিতে মুহূর্তেই সকলে চুপচাপ হয়ে গেলো। আম্মু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার? এখানে কেনো তুই?”
আমি সাদিককে দেখিয়ে বললাম,
” আম্মু, উনি আপুর মামাতো দেবর হয়। ছাদে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় নিচে এসেছেন। ”
আমার কথা শোনামাত্রই আম্মু বিলম্ব না করে ডাইনিং হতে একটি গ্লাস বেসিনে নিয়ে ভালোমতো ঘষেমেজে পরিষ্কার করলো। অতঃপর জগ হতে তাতে পানি ঢেলে সাদিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” কিছু মনে করো না বাবা। ছাদে পানির একটা জগ ছিলো। তবে তা অপরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় রুমে নিয়ে আসি। পরে যে আবারো জগ রেখে আসবো তা আর মনে ছিলো। কিছু মনে করো না কেমন?”
আম্মুর কথায় সাদিক চেয়ারে বসতে বসতে আন্তরিকতার সহিত হেসে বললেন,
” আরে আন্টী, এতো প্যানিক হওয়ার কিছু নেই৷ ইটস ওকে। বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা বুঝতে পেরেছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ”
সাদিকের আশ্বাসে আম্মু এবার গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপভাবে আড়চোখে রুমে উপস্থিত প্রত্যেকের চাহনি দেখছি। উপস্থিত সকলের চাহনি স্বাভাবিক মনে হলেও আনোয়ারা দাদির বাঁকা চাহনিতে আমি খানিক ঘাবড়ে গেলাম৷ শুকনো একটা ঢোক গিলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম সাদিক চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়েছেন৷ আমি কোনো প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই উনার পিছু পিছু চলে এলাম ছাদে।
সাদিক চলে আসায় ধীরেধীরে আপুর শ্বশুরবাড়ী হতে আগত সকলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। একে একে সকলে বেড়িয়ে যাবার পর আমি, আভা, তাসনিম মিলে আপুকে নিচে নিয়ে এলাম।
.
রাতে আপু এবং আভাসহ আমরা সকল কাজিনেরা মিলে গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ আব্বুর রুম থেকে শীতল এবং গাম্ভীর্যপূ্র্ণ কণ্ঠে আব্বুর ডাক শুনতে পেলাম। আব্বুর এহেন সুরের ডাক শুনে আমি এবং আভা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। দুজনেই আন্দাজ করে নিলাম, ঘূর্ণিঝড় আসার পূর্বের নীরবতা এটি। আমি, আভা, আপুসহ একে একে সকলে আব্বুর রুমে উপস্থিত হলাম। রুমে পৌঁছে ছোটখাটো একটি পঞ্চায়েত দেখে ভয়ে আমার হাত পা অসার হবার জোগাড় হয়ে এলো। চাচি-চাচু, মামি, খালামনি,আম্মু, দাদি এবং আনোয়ারা দাদি পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আসে। তাদের দেখে আমি শুকনো একটি ঢোক গিলে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমাদের ডেকে পাঠালে যে আব্বু?”
আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আব্বু মুখ খোলার পূর্বেই আনোয়ারা দাদি প্রচণ্ড রাগত স্বরে বললেন,
” শোন তোর মাইয়াদের কাছ থেক, ছাদে কি হইছিলো। সবকয়টা তহন ওহানে ছিলো। জিজ্ঞাস কইরে দেখ, ঐ পোলা নাফিসারে ছুঁইছে না কি। কর জিজ্ঞাস।”
আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতে না হতেই আব্বুর শীতল চাহনি আমাদের উপর পড়লো। তৎক্ষনাৎ আমরা একযোগে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আনোয়ারা দাদি পুনরায় নিজের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,
” কইছিলাম, ওমন বংশে মাইয়ার বিয়া না দিতে। কিন্তু কেডা শোনে কার কথা। তোরা আমার কথাখান আমলেই নিলি না। ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকজন কত্ত বড়লোক দেখছিস? ওতো বড়লোক ঘরে আমাগো মাইয়া গেলে কি ঠিক থাকবো? ওমন মরডার্ন পরিবারে বিয়া দিতে না করছিলাম৷ দেখ অবস্থা এহন। ছিঃ ছিঃ! ”
এই বলে তিনি ক্ষণিকের জন্য থেমে পুনরায় বললেন,
” ওগোর মামি চাচিরাও তো তহন ওহানে ছিলো। ওরা কিছু কয়নি ক্যান? হ্যাঁ? শায়লা আর রেনু কও তো দেহি, তোমরা তো তহন ওহানে ছিলা। তোমরা ঐ পোলারে কিছু কওনি ক্যান?”
আমি কিঞ্চিৎ মাথা উঁচু করে দেখলাম মামি এবং চাচি আনোয়ারা দাদির আচমকা প্রশ্নের আঘাতে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছেন। আনোয়ারা দাদি পুনরায় তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইলে চাচি দাঁড়িয়ে বললেন,
” ফুপু, ঐ ছেলেটা একদম হঠাৎ করে নাফিসার গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলো। এভাবে হঠাৎ করে করায় আমরা আর কিছু বলতে পারিনি৷ ”
আনোয়ার দাদি এবার তেতে উঠলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে বললেন,
” তহন কইবার পারছিলা না তো পরে তো কইবা? না কি তহনও জবানে তালা লাগানো ছিলো? আর ঐ পোলা মাইয়াগো তোমরা ছাদেই বা উঠবার দিছিলা ক্যান? নাশতা খাওইয়া নিচ থেইক্কা বিদায় কইরা দিতা। ”
চাচি নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি পুনরায় লক্ষ্য করে দেখলাম, আম্মু আমাদের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে।
আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতেই আব্বু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আচ্ছা, ফুপু শান্ত হোন। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। শুধু শুধু এখন চিৎকার চেঁচামেচি করে কি লাভ? কাল বাদে পরশু মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আজ অন্তত……… ”
আনোয়ারা দাদি পূ্র্বের সুরেই বললেন,
” তো কি হইছে? মাইয়া চলে যাইবো দেইক্কা হের সব খুন মাফ করুম না কি! তোমাগো তো বুদ্ধিশক্তি সব লোপ পাইছে। মাইয়া নাচতে নাচতে কইলো ঐ বড়লোক পোলারে বিয়া করবো, আর তোমরা তা তে রাজি হইয়া গেলা? ক্যারে নাফিসা? তোর ঐ পোলারে এতো পছন্দ হইছে! ঐ পোলার মধ্যে তুই দেখেছোসটা কি? ট্যাহা পয়সা না কি রূপ। হো বুঝছি, দুইডা দেইক্কাই তুই বিয়েতে রাজি হইছিলি। তাই না?
®সারা মেহেক(সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ, পেজের রিচ অনেক কমে যাওয়ায় প্লিজ সকলে এই পোস্টে লাইক করবেন এবং অন্তত একটি করে শব্দ হলেও কমেন্ট করে যাবেন। প্লিজ প্লিজ। আপনাদের সহযোগিতাতেই পেজের রিচ একটু বাড়বে)
#চলবে
(গল্প সম্পর্কে মতামত জানাতে এই গ্রুপে এড হতে পারেন সারা’র গল্পকুঞ্জ)