#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৫
আনোয়ারা দাদির এরূপ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আপুর সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলে বসবেন তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতে না হতেই আমাদের দাদি একপ্রকার হুংকার তুলে বললেন,
“আনোয়ারা, তোমার সাহস তো কম না! আমার নাতনীরে তুমি এসব কইতেছো কোন মুখে? ”
আনোয়ারা দাদি আমাদের দাদির কথা শুনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না৷ বরং উল্টো দাপট দেখিয়ে বললেন,
” ঠিক কইছি ভাবী। কম পয়সাওয়ালা বাপের মাইয়া হইয়া অতো বড় বাড়িত যাওনের লাইগা উঠেপড়ে লাগছে, বুঝতাছি তো। এই মাইয়া যে এমন লোভী হে তো আগে জানতাম না। লোভী তো লোভী সাথে বেহায়াও আছে। মাইয়া……”
আনোয়ারা দাদিকে মাঝপথে থামিয়ে তার লাগাম টেনে ধরলো আব্বু। ক্রোধান্বিত স্বরে বললো,
” অনেকে হয়েছে ফুপু। আপনি বড় বলে আপনাকে সম্মান করছি। কিন্তু তাই বলে কি আমার মেয়েকে যাচ্ছেতাই বলে যাবেন! আপনি কি ভেবে ওকে লোভী বলেছেন? ও ইমাদকে পছন্দ করেছে বলে? ইমাদকে ও পছন্দ করে, ইমাদও ওকে পছন্দ করে। এখন যদি ছেলেটা বড়লোক ঘরের হয় তাহলে সেটা কি নাফিসার দোষ? ও…….”
আব্বুর কথা শেষ হতে না হতেই আপু কাঁদতে কাঁদতে রুম হতে চলে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ আপুর পিছু গেলাম না৷ কারণ, এ মূহুর্তে আপুর পিছু পিছু গেলে আপু আমাকে ঠিকই পাঠিয়ে দিবে। এজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম, আপু কিছু সময় কান্না করে খানিক হালকা হয়ে নিলে তারপর আমি যাব। আপাতত আনোয়ারা দাদির মুখের উপর কিছু না বললে স্বস্তি পাবো না আমি৷
আপু যেতেই আব্বু পুনরায় আনোয়ারা দাদির উদ্দেশ্যে বললেন,
” মেয়েটাকে শুধু কষ্ট দিলেন ফুপু৷ যেখানে ওর কোনো দোষই ছিলো না সেখানে ওকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দেবার মানে কি! ”
আব্বুর কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ আনোয়ারা দাদি তার জবান খুলতে নিলেই আমি বেশ দুঃসাহসিকতার সহিত দাদির উদ্দেশ্যে বললাম,
” সম্পূর্ণ কথা না জেনে এভাবে হুটহাট পাগলেরা কথা বলে বসে। কিন্তু আপনি তো একদম সুস্থসবল মানুষ তাই না দাদি? তাহলে আপনি কি চিন্তা করে আপুকে ওসব কথা শোনালেন? আপনি কি একবারও চিন্তা করেছেন, কথা কোথায় শুরু করেছিলেন আর শেষ করলেন কোথায়? বিয়ে বাড়িতে এসেছেন মুরুব্বি হিসেবে, মুরুব্বির মতো থাকবেন। আর না জেনেশুনে এভাবে কথা বলার অভ্যাসটা ত্যাগ করলেই ভালো। ”
এই বলে আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম না। আক্রোশে উল্টে পথে পা বাড়িয়ে রুম হতে বেড়িয়ে এলাম৷ ওদিকে রুমে তখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। আম্মু এবং চাচিরা স্বভাবতই তাদের ফুপু শ্বাশুড়ির সামনে জবান খুলবে না। কারণ মুখ ফসকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বেড়িয়ে গেলেই বাকিটা সময় তাদের নানারূপ কথার সম্মুখীন হতে হবে। তবে তারা নীরব রইলেও আমি এমতাবস্থায় কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারলাম না। ফলে যতটা কথা না বললেই নয় ঠিক ততটাই উনার মুখের উপর বলে এসেছি।
আমি কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই ড্রইং রুমে এসে সোফায় বসে পরলাম। কিছুক্ষন পূর্বের সকল ঘটনা মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি হওয়ায় রাগে, ক্ষোভে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললাম আমি। এ মুহূর্তে আমার মন চাইছে আনোয়ারা দাদির সামনে নিজের জমানো সমস্ত ক্রোধ উগরে ফেলি। আনোয়ারা দাদির চোখে আমরা তিনবোন এবং আমাদের আম্মু কাঁটাস্বরূপ। আমার আম্মু আনোয়ারা দাদির চোখে খারাপ হওয়ার কারণ আম্মু দাদার বংশের বড় এবং প্রথম বউ হওয়া সত্ত্বেও কোনো ছেলে জন্ম দিতে পারেনি৷ আর আমরা তিনবোন খারাপ কারণ আমরা কেউই ছেলে নই। আনোয়ারা দাদির কথা, তিনটি মেয়ে না হয়ে একটি ছেলে হলেই যথেষ্ট ছিলো এবং উনি প্রতিবারের সাক্ষাতে আমাদের এ কথা শুনিয়ে ছাড়েন। আমাদের তিনবোনের মাঝে আনোয়ারা দাদির সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ হলো আমার আপু। কারণ আমার আপু বংশের বড় মেয়ে। আর তার ভাষ্যমতে, বংশের বড় হিসেবে মেয়েদের মানায় না। বরং বংশের বড় হতে হয় ছেলেদের। আমাদের বাসায় এলে উনি এই চিন্তায় বেহুঁশ হোন যে আমার বাবার বংশ কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? কারণ তার কোনো ছেলে নেই। আনোয়ারা দাদির এরূপ কথা শুনে প্রতিবার ক্রোধে আমার সমস্ত শরীর রি রি করে। মন চায়, বেশ কথা শুনিয়ে ছাড়ি উনাকে। কিন্তু আব্বু আম্মুর কথা ভেবে নিশ্চুপ হয়ে থাকি আমরা।
কিছুক্ষণ পর আভা এসে আমার পাশে বসলো। চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” ছোট আপু, তুই বড় আপুর কাছে গিয়েছিলি?”
” এখনো যাইনি। যাব। আপু কি রুমে আছে?”
” আপু কি এমন অবস্থায় কখনো রুমে থাকে না কি! আমি সারাবাড়ি খুঁজে বেড়িয়েছি। আপু এখানে নেই। অর্থাৎ আপু ছাদে গিয়েছে। ”
আভার কথায় আমি আঁতকে উঠে বললাম,
” রাতের এই কনকনে শীতে আপু ছাদে গিয়েছে! উফ, আজ বাদে কাল বিয়ে আর এখন সে ঠাণ্ডা লাগানোর ধান্ধায় আছে। তুই তাসনিমদের সাথে থাক আপাতত। আমি আপুর কাছে যাচ্ছি। বেশিজনের যাওয়ার দরকার নেই। ”
আভা আমার কথার যথাযথ আজ্ঞা করে সোফায় বসে রইলো। এদিকে আমি রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার পরপরই সেখানে তাসনিম এসে উপস্থিত হলো।
আপু এ কনকনে শীতে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই শীতে আমার শরীর শিউরে উঠলো। আমি দ্রুত আমার রুম থেকে একটা শাল নিয়ে শরীরে জড়িয়ে আপুর রুমে গেলাম। আপুর চেয়ারে অগোছালোভাবে থাকা শালটা নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে পা রাখতেই আপুর ফুঁপানোর শব্দ কানে ভেসে এলো আমার। আমি শব্দহীন পা ফেলে আপুর দিকে ধীরেধীরে এগিয়ে গেলাম। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সমস্ত ছাদ আলোকিত হয়ে আছে। সেই সাথে হিম অনলের প্রবাহে সমস্ত ছাদ যেনো ছোটখাট একটা বরফপুরীতে পরিণত হয়েছে। গা হিম করা শীতে সোয়েটার, চাদর দিয়েও শীতকে কাবু করতে না পারায় আমি শিউরে উঠলাম। এতে আপু আমার উপস্থিতি টের পেয়ে খানিক চমকে উঠলো। অভিমানী সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই এখানে এসেছিস কেনো? আমাকে একটু একা থাকতে দে। ”
আমি আপুর পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম,
” অনেকক্ষণ একা থেকেছিস। আর না। কি মারাত্মক শীত পড়েছে দেখেছিস আপু? ”
আমার কথা শুনে আপু তার মলিন মুখখানা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। জ্যোৎস্নার আলোয় আপুর এই মলিন মুখখানা দেখে আমার বুকটা মোচড়ে উঠলো। বেচারির আজ বাদে কাল বিয়ে অথচ এখনই বিয়ের কান্না করে উজাড় করে দিলো। আমি আপুর দিকে শাল এগিয়ে দিয়ে বললাম,
” এই নে গায়ে শালটা জড়িয়ে নে। না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে আপু।”
আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে জেদি সুরে বললো,
” লাগবে না চাদর। নিয়ে যা তুই। ”
আমি তৎক্ষনাৎ আপুর কথার প্রত্যুত্তর দিলাম না৷ কিয়ৎক্ষণ বাদে আমি দুষ্টুমির সুরে আপুকে বললাম,
” আরে নে তো আপু। এতো ঢঙ করিস কেনো? আমি তোর নায়ক না যে তুই জিদ করলে আমি তোর পিছু পরে রইবো। আর ফিল্মি হিরোদের মতো পিছন থেকে একই শাল দিয়ে আমি তোকে জড়িয়ে ধরবো। এসব করার জন্য তো ইমাদ ভাইয়া আছে। ডাকবো না কি ইমাদ ভাইয়াকে? হুম বলো বলো। ”
আমার কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আপুর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠলো। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আপুর এই মিষ্টি হাসি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি।
আরেক দফা আপুর দিকে শাল বাড়িয়ে দিতেই আপু তা নিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলো। আমার দুষ্টুময় কথাগুলোয় আপুর রাগ অভিমান যে গলে গিয়েছে তা ভাবতেই ছোট্ট করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
রাতের স্তব্ধ কনকনে পরিবেশ উপভোগ করতে দুজনে খানিক সময়ের জন্য ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন শীতের সাথে দুজনের একেবারেই লড়াই করার সামর্থ্য রইলো না তখন দুজনে রুমে চলে এলাম।
আপুর রুমে আসতেই দেখি আভা, তাসনিম, লামিয়া এবং আমাদের আরো ছোট ছোট দুটো চাচাতো বোন মিলে খেলাধুলা ও গল্পগুজব করছে। রুমে আমার আর আপুর উপস্থিতি টের পেয়েই আভা, তাসনিম এবং লামিয়া আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। আভা চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” বড় আপু? ঠিক আছো তো?”
আপু প্রশ্নের জবাব স্বরূপ শুধু মৃদুভাবে মাথা দুলালো। অতঃপর নিশ্চুপতার সহিত ক্লান্ত শরীরে বিছানায় বসে পড়লো। আমিও পরনের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে আপুর সামনে একটি চেয়ার এনে বসে পড়লাম। আচমকা আমাদের চমকে দিয়ে আপুর ফোনটা তারস্বরে বেজে উঠলো। আভা আপুর ফোনটা হাতে নিয়েই বললো,
” আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।”
আভার কথা আমার কর্ণাধারে আঘাতপ্রাপ্ত হতেই আমার গলা শুকিয়ে গেলো। আমি ঘাবড়ে গিয়ে আপুর দিকে চেয়ে রইলাম এবং বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আপুও আমার দিকে ত্রস্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো।
®সারা মেহেক(প্রতিদিন শত ব্যস্ততা থাকার মাঝেও কষ্ট করে গল্প লিখি অথচ আপনারা রেসপন্স এবং কমেন্টই করেন না। কেনো?)
#চলবে
(গল্প সম্পর্কে মতামত জানাতে চাইলে এই গ্রুপে এড হতে পারেন সারা’র গল্পকুঞ্জ