#ভোরের_আলো
পর্ব-১১
বাসায় এসেই সোফায় গা এলিয়ে বসলো আশফাক। মাথাটা এখনো ব্যথা করছে। রিমন কোমড়ে হাত দিয়ে আশফাকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
– এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? খেয়ে ফেলবি আমাকে?
– তুমি এটা কি করলে?
– কি?
– রাত্রিকে এতো ইমপরট্যান্স কেনো দাও তুমি?
– ইমপরট্যান্স কোথায় দিলাম?
– তাহলে ওকে রেখে চলে আসলে না কেনো। মেয়েটা তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।
– এখানে রাত্রি কোনো ব্যাপার না। মূল কথা হচ্ছে ওর প্যানপ্যানানি শোনার মুডে আমি নেই। সবসময় ন্যাকামী সহ্য হয় না।
– কি করেছে ও?
– গতকাল বললো আমার সম্পর্কে জানতে চায়। ভালো কথা। বাসা অফিসের এড্রেস দিলাম আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। আমি কি করি, কোত্থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি সব বলেছি৷ আমি ওকে বলেছিলাম আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আজকের মধ্যে রেজাল্ট জানাও। ও কি করলো? সকালে ফোন দিয়ে বললো ও আমাকে এখন কিছু জানাবে না৷ কি নাকি সমস্যা আছে। ওর আরো সময় চাই৷ এখন কি আমি ওর পিছনে ছয়মাস লাগিয়ে ঘুরবো ওর মুখ থেকে হ্যাঁ শোনার জন্য?
– এই কারনে তুমি ওর সাথে দেখা করলে না?
– হ্যাঁ।
– ওর তো সমস্যা থাকতেই পারে।
– কোনো সমস্যা নেই। আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে এখনো ব্রেকআপ হয়নি। ব্রেকআপ করে এরপর আমাকে ধরবে।
– ভাইয়া অর্পিতা এমন না।
– ঘ্যানঘ্যান করিস না তো। অসহ্য লাগছে।
– তুমি যে আসতে চাচ্ছো না এটা ও বুঝে ফেলেছে । আমি কথা বলার সময় শুনেছে। রাগ করে বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। মনে হয়না তোমার সাথে ও আর এগোবে।
– ভালো হয়েছে শুনেছে। একটা অর্পিতা গেছে৷ দশটা আসবে।
– ও অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে। ওকে আঁকড়ে ধরো ভাইয়া। তোমার জীবনটা ও গুছিয়ে দিবে।
– চুপ কর তো। ভালো লাগছে না আমার। মাথা ব্যাথা করছে।
রিমন বুঝতে পারছে আশফাকের সামনে এসব বলে লাভ নেই। ওর কানের কাছে সারাদিন ধরে এসব বললেও লাভ হবে না। তবে সে মনে প্রানে চাচ্ছে অর্পিতার সাথে আশফাকের সম্পর্ক এগিয়ে যাক। মেয়েটার সাথে জড়ালেই আশফাক টের পাবে অর্পিতা খুব ভালো।
গত দুদিন যাবৎ অর্পিতার নাম্বারে লাগাতার কল করেই গেছে আশফাক। কখনো সুইচ অফ পেয়েছে। কখনো অর্পিতা কল রিসিভ করেনি। কখনোবা কল কেটে দিয়েছে। অর্পিতার বাসার সামনেও গিয়েছিলো। কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি। সজীবকে দিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারলো অর্পিতারা বাসায় নেই। স্বপরিবারে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। গত পরশু সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে নতুন ভাবনার উদয় হয়েছে আশফাকের। এত সুন্দর মেয়েটাকে হাতছাড়া করা হবে নেহায়েৎ বোকামি। তাছাড়া এই মাথাব্যথাটা শুরু হলে সমস্ত কিছু অসহ্য লাগে আশফাকের। তাই অর্পিতার সঙ্গে এমন আচরন করেছিলো। নয়তো কখনোই এমন করতো না। তাছাড়া অর্পিতার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য একপ্রকার রোখ চেপে গেছে আশফাকের মাথায়। গত দুদিন যাবৎ মেয়েটা ওকে প্রচন্ড রকমে ইগনোর করছে৷ এই নিয়ে আশফাকের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। এতো কিসের অহংকার এই মেয়ের? ওকে ভালোভাবে নিজের কব্জায় এনে অহংকারটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিবে সে।
রাতের দিকে ধানমন্ডি থেকে কি একটা কাজ শেষে বাসার দিকে ফিরছিলো আশফাক। রাস্তার সাইডে একটা গাড়ি থেকে অর্পিতাকে নামতে দেখলো৷ বেশ সাজগোজ করে আছে। পড়নে একটা সাদা জামদানী। খুব দ্রুত গাড়িটা রাস্তার সাইডে রেখে দৌঁড়ে এসে অর্পিতার পিছনে দাঁড়ালো। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে অর্পিতা।
– আপুর মেকআপ এখনও হয়নি?
-………
– তোর হয়েছে?
-………….
– আমি নিচে আছি। তোরা নেমে আয়।
ফোনটা কাটতেই পিছন থেকে ডাকলো আশফাক।
– অর্পিতা…..
প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অর্পিতা। কন্ঠ শুনেই বুঝে গিয়েছিলো আশফাক ওর পিছনে৷ কেনো যেনো আশফাককে দেখে ওর কান্না পাচ্ছে। কিন্তু আশফাকের সামনে অর্পিতা কাঁদতে নারাজ। চোখে পানি ছলছল করছে ঠিকই। কিন্তু চোখের বাহিরে যাতে পানি না আসে প্রানপনে সেই চেষ্টা চালাচ্ছে ।
– এত রাগ তোমার?
কাঁপা কন্ঠে অর্পিতা উত্তর দিলো
– রাগের কি দেখলেন?
– তোমাকে ভালোবাসি বলে কি রাস্তার কুকুরের মতো দূর দূর করবে আমাকে?
– দূর দূর কে করেছে? আমি?
– আর নয়তো কে? গত দুটা দিন ধরে তোমার কন্ঠটা যাস্ট একটাবার শোনার জন্য কতটা কষ্ট পাচ্ছি জানো? কতবার তোমাকে কল করছি। অথচ একটা বার আমার কল রিসিভ করলে না। আমি কি এতটা অপমান পাওয়ার যোগ্য অর্পিতা? তোমার মনে কি তিল পরিমান স্থান নেই আমার? আমি কি তোমার এতটাই অযোগ্য?
চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছে না অর্পিতা। দুগাল বেয়ে অঝোরে পানি ঝড়ছে৷ আশফাকের প্রতিটা কথার উত্তর দিতে হবে৷ কিন্তু জিহ্বায় জড়তা কাজ করছে। তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলতে শুরু করলো অর্পিতা।
– আ… আমি অপমান ক… ক… রেছি আপ..পনাকে? আমি ক.. রিনি। আপ.. নি করেছ..ছেন।
– পানি খাবে?
– না। আ…মি কথা বল…ছি না?
– আচ্ছা বলছো তো। পানি খেয়ে এরপর কথা বলো।
পার্লার থেকে বেরিয়ে এসেছে মুক্তা আর অর্পিতার মেজো ফুফুর মেয়ে শিলা। আজ শিলার বিয়ে। এখানে এসেছিলো সাজতে। পার্লার থেকে বেরিয়ে নিচে নামার আগ পর্যন্ত নিজেদের মেকআাপ নিয়ে প্রচন্ড এক্সাইটেড ছিলো মুক্তা আর শিলা। বারবার নিজেদেরকে সেল্ফি ক্যামেরায় দেখছিলো। নিচে এসে অর্পিতাকে দেখার পর সমস্ত এক্সাইটমেন্ট হাওয়া হয়ে গেছে দুজনের। দুজনই অর্পিতা আশফাকের দিকে হা হয়ে দেখছে। তবে বেশি অবাক হচ্ছে শিলা। অর্পিতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটাকে ও চিনে না। কে উনি? উনার সাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছে কেনো? লোকটা ওকে পানি সাধছে। তারমানে লোকটা পরিচিত। কিন্তু কি হয় অর্পিতার?
– আ… আপ… নি আমাকে ভা.. লোবাসেন ন.. আ। বাসলে কখনো..ই এভ..আবে আমাকে ব..ব্লক করে রা..আখতেন না।
– সরি।
– আমার ব..বলা শেষ হয়.. নি। আমি আপন.. আর বাসায় গি.. য়েছি। আপ.. নি বা.. বাসার কাছে ছিলে..ন। অথচ আ..আপনি আসেন… নি। এতটা অপ..,মান পাও..য়ার যোগ্য কি আ..মি ছি.. ছিলাম? এক..টা মেয়ে আপনার সাথে এ..একটু কথা বল..আর জন্য আপ..নার বাসা পর্যন্ত চ..লে এসেছে। আ…পনি বুঝেন না কে..কেনো এসেছে? ভেঙে বল..তে হবে? আপ..নাকে ভালো..বাসি তাই গি..য়েছিলাম।
কথাটা বলে আশফাকের দিকে অপলক তাকিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদছে অর্পিতা। অর্পিতার চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না আশফাক৷ অজানা কোনো কারনে অর্পিতাকে কাঁদতে দেখে কষ্ট পাচ্ছে সে। কোনো কথা না বলে খুব শক্ত করে অর্পিতাকে বুকে চেপে ধরলো আশফাক। চুপ করে আশফাকের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে অর্পিতা। ওর বুকের বা পাশটা ভিজে যাচ্ছে অর্পিতার চোখের পানিতে। শিলার মনে হচ্ছে ও এখুনি জ্ঞান হারাবে। শিলা ওদের দুজনকে এত আদর করে। অথচ ওরা কেও ওকে কিছু বললো না এই লোকটা সম্পর্কে? চোখ বড় করে মুক্তার দিকে তাকিয়ে আছে শিলা।
– নিজে থেকে কিছু বলবি? নাকি তোকে থাপ্পর দিবো?
– পরে বলি?
– এখন কি সমস্যা?
– বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। চোখের সামনে ট্রেইলার চলছে। আপাতত ওটা দেখো। পরে নাহয় পুরো কাহিনী শোনাবো।
– ট্রেইলার তো রাস্তার সবাই দেখছে। লেগে আছে একটা আরেকটার সাথে। ওদেরকে ছুটা।
মুক্তা এগিয়ে যেয়ে আশফাককে বললো,
– ভাইয়া, লোকজন দেখছে।
-………
– ভাইয়া….
– হুসসসসস! চুপ করো।
– সেন্টারে সবাই ওয়েট করছে। আপুর আজ বিয়ে। বরপক্ষ এসে পড়বে।
– ওহ্!
খুব ধীরে নিজের বুক থেকে অর্পিতাকে সরালো আশফাক। অর্পিতার গাল মুছে দিয়ে বললো,
– সবাই অপেক্ষা করছে৷ যাও।
-হুম।
– আর শোনো, একদম কাঁদবেনা। আমি এমন পাগলই। হুটহাট ক্ষেপে যাই। এই পাগলকে সহ্য করতে হবে। সেইসাথে পাগলের পাগলামিও।
– হুম।
– বাসায় যেয়েই আমাকে কল করবে। ঠিকাছে?
– হুম।
– চেহারার তো বারোটা বেজে গেছে। পার্সে মেকআপের কিছু এনেছো?
– হুম।
– গাড়িতে বসে সাজটা ঠিক করে নিও।
– আচ্ছা।
– যাও। পরে কথা হবে।
শিলা আশফাককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে দেখতে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
– আমার বিয়ের দিন এমন সাংঘাতিক সারপ্রাইজ না দিলেও পারতি অর্পিতা। বিয়ের যত এক্সাইটমেন্ট ছিলো সব ঠুস হয়ে গেছে।
– আপু, তোমার বিয়ে। তাই তোমাকে কিছু জানাইনি।
– হ্যাঁ জানাসনি। একদম লাইভ টেলিকাস্ট দেখিয়ে দিয়েছিস।
– সরি আপু।
– গল্প শুরু কর।
– উনার সাথে কিছুদিন আগে রেস্টুরেন্টে…….
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারের দিকে। অর্পিতা গল্প শোনাচ্ছে শিলাকে। শিলা ভীষন মনোযোগে গল্প শুনছে।
(চলবে)
-মিম