#ভোরের_আলো
পর্ব-১২
আশফাক বাসায় ফিরেছে ঘন্টা দেড়েক হলো। বাসায় ফিরে গোসল সেড়ে মাত্রই ডিনার শেষ করেছে। বেডরুমে লাইট অফ করে শুয়ে আছে সে। লো ভলিউমে গান শুনছে,
কারা যেন ভালবেসে আলো জ্বেলেছিলো
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিলো।
নিজের ছায়ার পিছে ঘুরে ঘুরে মরি মিছে
একদিন চেয়ে দেখি আমি তুমি হারা, আমি তুমি হারা।
দরজার লক খুলে ভিতরে এলো রিমন। ঘরে ঢুকেই লাইট জ্বালালো। লাইট জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে চোখজোড়া ঢেকে ফেললো আশফাক। বিরক্তভরা কন্ঠে বললো,
– লাইট জ্বালিয়েছিস কেনো?
– তুমি কি করছো দেখতে এসেছিলাম।
-এজন্য লাইট জ্বালাতে হয় নাকি? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো কি করছি?
– স্যরি।
– লাইট অফ কর।
কথা বাড়ালো না রিমন। লাইট অফ করে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে।আশফাক চোখের পানি আড়াল করতেই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলেছে তা অজানা নেই রিমনের। লুকিয়ে লাইট অফ করে কান্নার অভ্যাস আজকের নতুন না৷ আশফাকের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই এমনটা দেখে আসছে। শুরুতে বাঁধা দিতো। আশফাককে বিভিন্নভাবে বুঝাতো। তখন ছোট ছিলো তাই হয়তো আশফাকের ভিতরের কষ্টগুলো উপলব্ধি করতে পারতো না। আজকাল আর আশফাককে আটকায় না রিমন৷ কাঁদুক৷ কাঁদলে মন হালকা হয়। সারাদিন যতই রঙ ঢঙ করে বেড়াক না কেনো দিনশেষে মানুষটা একা। বড্ড একা। উহুম, একা বললে ভুল হবে। মানুষটার সাথে কিছু তিক্ত স্মৃতি আছে যা মানুষটাকে খুব বাজেভাবে ভোগায়। অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। একটা পরী দরকার। একরাশ আলো নিয়ে আসা পরী।আশফাকের জীবনের কানায় কানায় আলো ভরিয়ে তুলবে। সুখের আলো। স্নিগ্ধ শীতল আলো।
বিয়েবাড়িতে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অর্পিতা। এত ব্যস্ততার মাঝেও ঐ লোকটার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষটার কন্ঠস্বর কানে বেজেই যাচ্ছে। কি যেনো নেশা আছে ঐ কন্ঠস্বরে। ইচ্ছে হয় নীরবে কোথাও বসে লোকটার কন্ঠস্বর খুব মন দিয়ে একটানা শুনতেই থাকুক। সে বলেছিলো বাসায় ফিরে ফোন দিতে। বাসায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না অর্পিতার। দুইমিনিটের জন্য হলেও তার সাথে কথা বলতে হবে। নয়তো শান্তি মিলবে না। সবার চোখের আড়াল হয়ে কমিউনিটি সেন্টারের বাহিরে এলো অর্পিতা। হাতে থাকা ছোট্ট পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে আশফাকের নাম্বারে ডায়াল করলো।
কল এসেছে আশফাকের মোবাইলে। ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোনটা রাখা আছে। এই মূহুর্তে শোয়া থেকে উঠে কল রিসিভ করার মুড একদম নেই। যে খুশি ফোন করুক। আপাতত কারও সাথে কথা বলবে না সে।
অর্পিতা পরপর তিনবার কল করেছে আশফাকের নাম্বারে। অপরপাশের মানুষটা কল রিসিভ করেনি বলে মূহূর্ত্বেই মুখে কালো ছায়া নেমে এসেছে অর্পিতার। কমিউনিটি সেন্টারের দরজা ঠেলে ভেতরে যেতেই সামনে এসে হাজির হলো অর্পিতার মা লিপি।
– কোথায় ছিলি?
– ঐ তো ভার্সিটির প্রফেসর কল করেছিলো। ভিতরে কিছু বুঝা যাচ্ছিলো না। তাই বাহিরে গিয়েছিলাম।
– ওহ্। আচ্ছা শোন, শিলা আর জামাইকে খাবার টেবিলে বসাবে। তোর ফুপ্পি তোকে খুঁজছে। শিগগির ওদের টেবিলে যা।
– হুম যাচ্ছি। তুমিও আসো।
– না। ছেলের খালা মামারা খেতে বসবে এখন। আমি ঐখানটা দেখবো।
– আচ্ছা, যাও। আম্মু,,,,, আম্মু শুনো,,,,
– কি?
– আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বললে না তো?
– খুবই সুন্দর। জুয়েলারীগুলো তোকে বেশ মানিয়েছে।
– আর শাড়ীটা?
– তোকে তো শাড়ীতে সবসময়ই সুন্দর দেখা যায়।
অর্পিতার এখন খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে,
– আচ্ছা মা, আমাকে কতটা সুন্দর লাগছে? আশফাকের চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর?
কথাটা ঠোঁট অব্দি এনেও আবার চুপ করে রইলো। নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে এই মূহুর্ত্বে। কি ভাবছে না ভাবছে কিছুই মাথায় আসছে না। প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে অর্পিতার। মা কে এই কথা জিজ্ঞেস করার খেয়াল কি করে এলো মাথায়? ছিঃ!
চোখের দুপাশ আঠালো লাগছে। গান শুনতে আর ভালো লাগছে না। অনেক হয়েছে নীরব দুঃখবিলাস। এবার একটু দখিন হাওয়া গায়ে লাগানো প্রয়োজন। বিছানা ছেড়ে বারান্দার দিকে যাওয়ার পথে ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা হাতে নিলো আশফাক। অর্পিতা কল করেছিলো তখন। বাসায় ফিরেছে বোধহয়। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে অর্পিতার নাম্বারে ডায়াল করলো আশফাক।
পাত্রের হাত ধোঁয়ানো নিয়ে তুমুল বাক বিতন্ডা হচ্ছে দুই পক্ষের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। পার্সটা পাখির হাতে দিয়ে খেতে বসেছিলো অর্পিতা। এখন পর্যন্ত ওর হাত থেকে নেয়া হয়নি। অর্পিতার ফোন বাজছে। পিছন থেকে কয়েকদফা পাখি ডাকা সত্ত্বেও কোনো শুনতে পায়নি অর্পিতা। দুইবার কল দেয়ার পর থেমে গেলো আশফাক। হয়তোবা মেয়েটা কোনো কারনবশত ব্যস্ত আছে। ফ্রি হলে নিজেই কল করবে।
অর্পিতার চোখের পানির কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না আশফাক। নাটক এতো নিখুঁত কিভাবে হয়? হেঁচকি তুলে কাঁদা কিভাবে সম্ভব? এই মেয়ের কান্না দেখলে তো যে কেও ইমোশনাল হয়ে যাবে। এমনকি কিছুক্ষণের জন্য সে নিজেও ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলো। অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো মনের ভিতর। ওর কাছ থেকে সরে আসার পর আবেগ কাটিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসতে পেরেছে আশফাক। মেয়েটা মিথ্যুক এবং ছলনাময়ী। এই চরম সত্যিটা কখনোই মাথা থেকে সরতে দেয়া যাবে না। তবে মেয়েটা খুব সুন্দর করে কাঁদে। একদম আহ্লাদি টাইপ কান্না৷ দেখলেই আদর করে দিতে ইচ্ছে হয়।
নগদ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে ঝগড়ার ইতি ঘটলো বিয়েবাড়িতে। ঝগড়া শেষে মুক্তা আর অর্পিতা মিলে পানি খাচ্ছে। এতক্ষণ চেঁচামেচি করে গলা একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সামনে এসে দাঁড়ালো পাখি। পার্সটা অর্পিতার দিকে এগিয়ে বললো,
– আপা, আপনার ফোন আসছিলো।
– কে করেছিলো?
– জানি না।
মোবাইলটা বের করে কল হিস্টোরিতে যেয়ে দেখলো আশফাকের দুইটা মিসডকল। খানিকটা উত্তেজিত হয়ে অর্পিতা বললো,
– তুই আমাকে ডাকলি না কেনো?
– পাঁচ ছয়বার ডাকছি। আপনি তো শুনেন নাই।
– ধুর,,,,
ফোনটা হাতে নিয়ে আবারো সেন্টারের বাহিরে চলে গেলো অর্পিতা। পাখি খানিকটা অবাক হয়ে অর্পিতার চলে যাওয়া দেখছে। মুক্তা আয়েশ করে বসে বোরহানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।
– মুক্তা আপা…..
– হুমম…৷
– অর্পি আপা কি প্রেম করে?
– কেনো?
– আপা তো এমন ছিলো না। কেমন জানি বদলায়া গেছে। আপার মধ্যে নাই নাই ভাব।
– মানে?
– মানে ঘরে থাইকাও সে নাই। শরীর এক জায়গায় মন আরেক জায়গায়। প্রেমে পড়ার লক্ষ্মণ। এখন আবার দেখেন ফোনটা ধরতে পারে নাই দেখে রাগ করলো। মনে হয় আমাদের দুলাভাই ফোন করছিলো।
– হা হা হা,,,,,তোর ভাব দেখলে মনে হয় প্রেমের উপর পি এইচ ডি করেছিস।
– আপা কথাটা কিন্তু সিরিয়াস। হাইসা উড়ায়া দিবেন না বুঝছেন।
– হুম বুঝলাম। অনেক চিন্তা করেছিস। চিন্তা করতে করতে বোধহয় গলা শুকিয়ে গেছে তোর। আয়, বস এখানে। বোরহানি খা।
চেয়ার টেনে মুক্তার মুখোমুখি বসলো পাখি। চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
– আপনে জানেন সব।
– কি জানি?
– অর্পি আপার প্রেমকথা।
– ও প্রেম টেম করে না। এসব ভুয়া চিন্তা বাদ দে।
– আপা, আপনারা কি আমারে অবিশ্বাস করেন? ছোটবেলা থেইকা আপনাদের সামনে বড় হইছি। আমারে বিশ্বাস করতে পারতাছেন না আপা?
– শুনতেই হবে? না শুনলে হয় না?
– না শুনলে পেটের খাবার হজম হইবো না।
– তাহলে তো মুশকিল। তোকে তো তাহলে বলতেই হয়।
– বলেন না…
– কেও যেনো না জানে। ঠিকাছে?
– আচ্ছা।
– অর্পিতা যদি শুনে তুই এই কথা কারও কাছে বলেছিস তাহলে কিন্তু মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলবে।
– বিশ্বাস করেন। কিচ্ছু বলমু না।
– অর্পিতাকে একজন পছন্দ করে। এতদিন অর্পিতা উনাকে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। আজকে এখানে আসার পথে লোকটাকে হ্যাঁ বলে এসেছে।
– ওম্মা, তাইলে অতি শীঘ্রই অর্পি আপারও বিয়ে।
– আস্তে বল, মানুষ শুনবে।
– খুশি লাগতাছে। ইশশ! কখন যে পাত্র দেখমু!
– বাসায় যেয়ে তোকে ছবি দেখাবো। ঠিকাছে?
– একশো-একশো ঠিকাছে।
(চলবে)
-মিম