ভোরের_আলো পর্ব-২৪

0
945

#ভোরের_আলো
পর্ব-২৪

আশফাকের বাসার কলিংবেল বাজছে। রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে দরজা খুললো হুমায়ূন। দরজায় অর্পিতা দাঁড়িয়ে। বেশ আতংকিত নজরে অর্পিতাকে দেখছে সে।

– কি ব্যাপার হুমায়ূন ভাই? এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? দেখি, সরুন তো। ভিতরে যেতে দিন।
-…………….
– কি ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? কোনো সমস্যা?

সমস্যা মানে! বলে কি এই মেয়ে! ভিতরে তো বিশাল সমস্যা। এই সমস্যা কি তাকে বলার মতো!

– হুমায়ূন ভাই….
– হুঁ সমস্যা।
– কি সমস্যা?
– না, নাহ্। নাই তো। কোনো সমস্যা নাই।
– ভিতরে যেতে দিন আমাকে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেট ছেড়ে দাঁড়ালো হুমায়ূন। মনে মনে দুরূদ পড়ছে সে। আজ আশফাকের কপালে কতবড় তুফান আছে সেটা এ মূহূর্ত্বে সে ধারনা করতে পারছে না। কথায় আছে না, ‘ চোরের দশ দিন, আর গৃহস্থের একদিন।’
আপাতত হুমায়ূনের নজরে আশফাক একজন চোর আর অর্পিতা হচ্ছে গৃহস্থ।

বেশ ধীর পায়ে আশফাকের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো অর্পিতা। ভিতর থেকে কারো অদ্ভুত রকমের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকটা গোঙানোর মত শব্দ। দরজার লক খোলাই ছিলো। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই বাহির থেকে দরজা খুলে দাঁড়ালো অর্পিতা।

অর্ধনগ্ন একজন মেয়েকে আশফাক খুব শক্ত করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে কানে পাগলের মত চুমু খাচ্ছে। গলায় সমস্ত কামুকতা ঢেলে শীৎকার করছে মেয়েটি।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা। মনে হচ্ছে যেনো নিঃশ্বাসটা আটকে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাও যেনো শেষ হয়ে গেছে। অর্পিতাকে দেখা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো আশফাক,

– শীট! তুমি এখানে কি করো?

তড়িঘড়ি করে বিছানার উপর পরে থাকা ট্রাউজার টা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো আশফাক। সেই সাথে দ্রুত গায়ে কাপড় জড়ানোর তোড়জোড় প্রচেষ্টা চলছে রাত্রির।

লাগেজ নিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকছে রিমন। মেইন ডোর খোলা পেয়ে বেশ অবাক। বাসার মেইন ডোর তো কখনোই এমন খোলা থাকে না। ড্রইং রুমেও কাওকে দেখা যাচ্ছে না। ডাইনিংস্পেসের দিকে এগুতেই দেখতে পেলো হুমায়ূন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার বিশাল আতংক। এর কিছু সামনে আশফাকের রুমের দরজায় ভিতরমুখী হয়ে অর্পিতা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে কারো চেঁচানোর আওয়াজ আসছে।

– কমনসেন্স নেই? এভাবে কেও কারো বেডরুমে আসে? স্টুপিড। কে তুমি হ্যাঁ?

ধুপ করে মাটিতে বসে পড়েছে অর্পিতা। কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে রাত্রি কথাগুলো বলছে। খুব দ্রুত পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো রিমন। রাত্রিকে কাপড়-চোপড় ঠিক করতে দেখে যা বুঝার সে বুঝে নিয়েছে।

২৫.

বেসিনের উপর দুহাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক। আয়নায় নিজের মুখটা দেখছে। খুব ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে যেনো চেহারায় একটা কালচে ভাব এসেছে। অপরাধের কালো রঙটা চেহারায় লেপ্টে গেছে।

অর্পিতার কাঁধ ধরে দাঁড় করালো রিমন। ওর হাত ধরে ওকে ড্রইংরুমে এনে বসালো। অর্পিতার হাল বিশেষ সুবিধাজনক ঠেকছে না রিমনের কাছে। মাথা ঘুরে পড়ে-টড়ে যায় কি না কে জানে? এক গ্লাস পানি কি সাঁধা উচিত? লজ্জায় মনে হচ্ছে যেনো জিহ্বাটা আটকে গেছে। ঠোঁট ভেদ করে কথা বেরুচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। চোখজোড়া বড্ড শান্ত দেখাচ্ছে ওর। অতি কষ্টে বোধহয় মানুষ কাঁদতে ভুলে যায়। আপাতত অর্পিতাকে দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে রিমনের।

আশফাকের রুম থেকে চেঁচানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাত্রি আশফাকের সাথে চেঁচাচ্ছে।

– এগুলো কার সাথে প্রেম করো শুনি? নূন্যতম কমনসেন্স নেই। আমার মুডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তোমাকে না বলেছি আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করার সময় অন্য কেও যেনো ডিস্টার্ব না করে। আমাকে ডেকে আনলে আবার এই মেয়েকেও কেনো?
– প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলছো তুমি। যাও, বিদায় হও বাসা থেকে।

বেডরুম থেকে ভেসে আসা আওয়াজগুলো অর্পিতার কানে ঘন্টার মতো বাজছে। নিজেকে ডাস্টবিনে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট মনে হচ্ছে। আশফাক………. জীবনের প্রথম পুরুষ। তার প্রথম স্পর্শ। আজ এখানে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটা স্পর্শের স্মৃতিগুলো ছিলো স্বর্গীয়। কিন্তু এখন! এর চেয়ে জঘন্য স্মৃতি বোধহয় আর হয় না। মানুষটা গতকাল তাহলে সত্যিই বলেছিলো। বিয়েটা সত্যিই হয়নি৷ যে স্পর্শ, সঙ্গমকে পৃথিবীর পবিত্রতম স্পর্শ বলে জেনেছিলো, মূহুর্ত্বেই সেগুলো হয়ে গেলো পাপ। ঘোর পাপ। নিজেকে বড্ড অপবিত্র মনে হচ্ছে। লোমে লোমে যেনো পাপগুলো লেপ্টে আছে।

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অর্পিতা। নিজের শরীরের ভার আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে। পা দুটো আজ আর শরীরের ভারটুকু বহন করতে পারছে না। খুব ধীর পায়ে দরজার দিকে এগুচ্ছে অর্পিতা। পিছন থেকে এসে অর্পিতার হাত ধরলো রিমন।

– কোথায় যাচ্ছো?
– বাসায় যাবো।
– আমি তোমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসবো। চলো।

কোনো উত্তর দিলো না অর্পিতা। চুপচাপ নিজের মতো করে এগিয়ে যেতে লাগলো। অর্পিতার পিছুপিছু যাচ্ছে রিমন।

মাত্রই বাসায় ফিরেছে অর্পিতা। বাসার বাহিরের গেইট অব্দি রিমন ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। বাসায় ফিরেই সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে অর্পিতা। দরজা খুলেছে পর থেকে পাখি একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে ।

– আপা, মুক্তাপা নিশিপার সাথে কি কাজে যেনো বাহিরে গেছে। চাচা-চাচী ছোট খালার বাড়ি পৌঁছাইছে আরো ঘন্টাখানেক আগে। মুক্তাপা বইলা গেছে তার আসতে একটু দেরী হবে। আপা তো এটাও বলছিলো আপনারও নাকি আসতে দেরী হবে৷ আপনে যে এত জলদি আইসা পড়লেন?
-…………….
– আপা, আপনার মন খারাপ?
-……………..
– আপা, কিছু হইছে?
– না।
– ও আল্লাহ, আমি তো ভুইলাই গেছিলাম। চুলায় তো মাছ ভাজি বসায়া আসছি।

রান্নাঘরে ছুটে গেলো পাখি।

জিহ্বা গলা প্রচন্ড রকমে শুকিয়ে আসছে অর্পিতার। একটু পানি খাওয়া প্রয়োজন। খুব ধীর পায়ে হেলে দুলে ডাইনিংরুমে গেলো সে। গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ার টেনে বসতেই টেবিলের উপর থাকা ছুরীর দিকে নজর গেলো। একটু একটু করে পানি খাচ্ছে আর ছুরীটার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবছে সে। ভয়ানক কষ্টের দিনগুলোতে বোধহয় ছুরী জাতীয় ধারালো বস্তুগুলোকেই আপন মনে হয়। কাছে টেনে নেয়ার প্রবল আগ্রহ জাগে। অর্পিতারও আগ্রহ জাগছে৷ ইচ্ছে হচ্ছে গোটা শরীরটা ছুরী দিয়ে কেঁটে ফালাফালা করতে। পাপ লেগে আছে তো গায়ে। কাউকে ভালোবাসার পাপ৷ কাউকে নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করার পাপ। কাউকে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পাপ। পাপগুলো মুছতে হবে তো। খুব দ্রুত মুছতে হবে। চোখের সামনে পরিবারের মানুষগুলোর মুখ এক এক করে ভেসে উঠছে। যারা ওকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছিলো৷ সেই সাথে পরম প্রিয় প্রতারকটারও৷ যাকে ও নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে ছিলো। সীমাহীন ভালোবাসা। ডুকরে কেঁদে উঠলো অর্পিতা।

দূরে পাড়ি জমাতে হবে। অনেক দূরে। যেখানে আশফাকের অস্তিত্ব নেই। যেখানে ভালোবাসাটা আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না। যেখানে গেলে অপবিত্র শরীর নিয়ে বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে হবে না।

বাম হাতের কব্জিতে একটা লালচে তিল আছে৷ তিলটা ঠিক রগের সাথে লাগোয়া। খুব প্রিয় ছিলো আশফাকের৷ প্রায়ই আহ্লাদ করে চুমু খেতো তিলটাতে৷ পাপ মোচন না হয় এখান থেকেই শুরু হোক।

গাড়িতে পার্স রেখে গেছে অর্পিতা। অনেকটা রাস্তা চলে যাওয়ার পর পার্সটা চোখে পড়লো রিমনের। লক্ষ্য করতেই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার অর্পিতার বাসার কাছে গেলো। পকেট গেটটা হালকা করে ভেজানো। গেট খুলে উঁকি দিয়ে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলো না। ভিতরে যাবে কি যাবে না সেটা নিয়ে ব্যাপক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। ভিতরে ওর বাবা মা থাকতে পারে। হুট করে একটা ছেলেকে বাসায় আসতে দেখলে বিভিন্ন প্রশ্ন তাদের মনে জাগাটা খুব স্বাভাবিক। তারউপর আজ যা ঘটেছে এরপরে অর্পিতার বা কিন্তু পার্স ফেরত দেয়াটাও তো জরুরী। বাসার মেইন ডোর খুলে চিৎকার করতে করতে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো।

– ও আল্লাহ, আল্লাহ….. ফজল মামা জলদি আসেন। অর্পি আপা হাত কাটছে। মরতে চাইতাছে।

সাত পাঁচ না ভেবে বাসার ভিতরে ছুটলো রিমন। অপরিচিত একজনকে দৌঁড়ে ভিতরে আসতে দেখে পথ আগলে দাঁড়ালো পাখি।

– এই, এই আপনে কে?
– সেসব কথা পরে হবে। আগে অর্পিতাকে বাঁচানো জরুরী। সরো এখান থেকে।

পাখিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকলো রিমন। ড্রইংরুম বরাবর ডাইনিংরুমের ফ্লোরে অর্পিতা শুয়ে আছে দেখা যাচ্ছে৷ অর্পিতার কাছে যেতেই দেখতে পেলো একহাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত রগ বরাবর কয়েকটা কাঁটা দাগ। রক্তে ফ্লোর মাখামাখি অবস্থা। এক মূহূর্ত্ব দেরী না করে অর্পিতাকে কোলে নিয়ে খুব দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে রিমন। বের হওয়ার সময় পাখিকে জিজ্ঞেস করলো

– বাসায় কেও নেই?
– না। মুক্তাপা বাইরে। চাচা চাচী ঢাকার বাইরে।
– মুক্তাকে কল করে বলো অর্পি সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে। আমি ওকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি।

(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here