#ভোরের_আলো
৩৩.
আজ দুপুর দেড়টার দিকে অর্পিতাকে লাস্ট কল করেছিলো আশফাক। কলটা ও রিসিভ করেনি। সেদিন অর্পিতার ঘুম ভাঙার পর বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছে সে৷ মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয়নি অর্পিতার। নিঃশব্দে শুধু চোখের পানি ফেলেছে। অর্পিতাকে কিছুক্ষণ আগে কল দেয়ার পর বুঝতে পারলো তার নাম্বারটা ব্লক করে দেয়া হয়েছে। মেসেঞ্জারে লগ ইন করে দেখলো সেখানেও ব্লকড। অর্পিতার খোঁজ নেয়ার জন্য কল করলো মুক্তার ফোনে।
ফোন বাজছে মুক্তার। মুখোমুখি বসে আছে আবিদ। পরপর দু’বার কল কেটে দিয়েছে সে। তৃতীয়বারের কলটা কাটতেই আবিদ উৎসুক নজরে মুক্তার দিকে তাকালো।
– ফোন কাটছিস কেনো বারবার? কে ফোন দিচ্ছে?
– আশফাক।
– কেনো?
– অর্পিতাকে কল করে পাচ্ছে না তাই হয়তো ফোন দিচ্ছে।
মুক্তার কথা শুনে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আবিদ। মুক্তার ফোন থেকে নিজের ফোনে নাম্বারটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ছাদে যেয়ে আশফাকের নাম্বারে ডায়াল করলো সে।
আশফাকের ফোন বাজছে। আননোন নাম্বার। এমনিতেই অর্পিতার খোঁজ পাচ্ছে না এটা নিয়ে মাথা বেশ গরম হয়ে আছে। তারউপর এটা আবার মাঝখানে কে কল করলো? কিঞ্চিৎ বিরক্ত আশফাক। একবার ভেবেছিলো কলটা রিসিভ করবে না। পরক্ষনেই কি ভেবে আবার কলটা রিসিভ করলো।
– হ্যালো…..
– হ্যালো…….
– কে?
– আশফাক ভাই?
– জ্বি। আপনি কে?
– আবিদ। চিনতে পেরেছো?
– কোন আবিদ?
– ব্যাচ ২০০৪।
– ওহ্ হ্যাঁ,,,,, হ্যাঁ। চিনি না মানে? অবশ্যই চিনি। কত্তদিন পর তোমার সাথে কথা হচ্ছে! বিশ্বাস হচ্ছে না আবিদ। তুমি? তুমি সত্যিই আমাকে কল করেছো? মনে রেখেছো তুমি আমাকে?
– তোমাকে কি করে ভুলি বলো তো? তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা কি ছিলো সেটা কি আমি ভুলে গেছি? একটা সময় খুব কাছের মানুষ ছিলে তুমি আমার।
– কাছের মানুষ,,,,,,,
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশফাক। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এরপর আবার বলতে শুরু করলো,
– কাছের মানুষ যেহেতু ভাবো তাহলে এতগুলো বছরে কি একবারও মনে হয়নি আশফাক ভাইয়ের সাথে একবার যোগাযোগ করি?
– তুমি সেদিন বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবার পর অনেক খুঁজেছি তোমাকে। কোথাও তোমার খোঁজ পাইনি। তুমি তো একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন তোমার খোঁজ আমরা কেও পাইনি তখন ভেবেছিলাম এতগুলো ধাক্কা হয়তো মেনে নিতে পারোনি। মরে গেছো হয়তো। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না তোমাকে না পেয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি৷ অনেক,,,, অনেক। বারবার মনে হচ্ছিলো ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে তো কি হয়েছে আমি, তুহিন, সাকিব আমরা তো ছিলাম। কৌশিক ভাই, হাবিব ভাই, রাজু ভাই তো ছিলো। আমাদের কাছে কি একবার আসা যেতো না৷ আমরা কি তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিতাম? আমরা কি আমাদের কাছে রাখতে পারতাম না? আমরা তো তোমার আপন ছিলাম। তোমার সমস্ত কষ্টের দিনগুলোতে আমরাই তোমাকে সাপোর্ট দিয়েছি যে যেভাবে পেরেছি। কেও মেন্টালি বা কেও ফিন্যান্সিয়ালি। আমাদের সাথে কি তুমি থাকতে পারতে না? পুরো দুবছর পর আমি বিদেশ যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে সাকিবের কাছে খোঁজ পেলাম তোমার। এই শহরেই নাকি আছো৷ কৌশিক ভাই তোমার সব খবর জানতো শুরু থেকে অথচ আমাদের ও কিছু জানায়নি৷ এত যে তোমাকে খুঁজলাম, তোমাকে নিয়ে আমাদের এত হাহাকার তবু উনি আমাদের কিচ্ছু বললো না। চেয়েছিলাম বিদেশ যাওয়ার আগে একটাবার তোমার সাথে দেখা করে যাই। তোমার সাথে একটু কথা বলে যাই৷ সাকিব বললো তুমি কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে চাও না। কারো সাথে না মানে, কারো সাথেই না। তুমি এই সিদ্ধান্ত কেনো নিয়েছিলে তা আমি জানিনা। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো একটাবার, জাস্ট একটাবার তোমার সাথে কথা বলি৷ পরে ভেবে দেখলাম যে যেভাবে ভালো থাকতে চায় তাকে সেভাবে থাকতে দেয়া উচিত। দূর থেকে সবসময়ই তোমার খোঁজ নিতাম। তোমার আইডিতে সপ্তাহে একদিন হলেও ঢুঁ মারি। অথচ তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো। একটাবার আমার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করোনি। কোনেদিন জানতে ইচ্ছে হয়নি আবিদ কেমন আছে
– সত্যি কথা বলতে আবিদ, আমার সাথে যা ঘটেছে তা তো জানোই। ঐ ঘটনার পর আমি আর অতীতের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। বলতে পারো অতীত থেকে প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ রামপুরার বাসা ছেড়ে আসার পর থেকে ঐ এলাকায় আমি আর কখনো পা রাখিনি। আমার স্কুল কলেজের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। একমাত্র কৌশিকের সাথে যোগাযোগ আছে।
– আমরা কি দোষ করেছিলাম বলতে পারো? কেনো এভাবে আমাদের বাদ দিয়ে দিলে? একটাবারও কি মনে হলো না আমাদের সাথে সম্পর্কের গভীরতাটু্ুকু কতটা ছিলো?
– সেদিন রাতের পর আপাদমস্তক বদলে গেছি আবিদ। মায়া-টান, ভালোবাসা সেগুলো এই চৌদ্দটা বছর সেভাবে আমাকে আর টানেনি।এতগুলো বছর শুধু নিজেকে ভালোবেসেছি। নিজের সুখকে ভালোবেসেছি।
– হুম জানি। অনেক বদলে গেছো। যা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি৷ নিজের সুখটাকে আপন করতে গেয়ে বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছো আশফাক ভাই। নিজে সুখী হয়ে আমার বোনটাকে শেষ করে দিয়েছো। চাঁদের গায়ে দাগ লাগিয়ে দিয়েছো।
– মানে?
– আশফাক ভাই, অর্পিতা আমার ছোট বোন।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো আশফাক। আবিদের কথা শুনে ইজি চেয়ারটাতে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে শরীর এলিয়ে দিলো আশফাক। কান ঝিমঝিম করছে তার৷ ভীষণ রকমে ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে।
– হ্যালো,,,,, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
– হু,,,,, হুম শুনতে পাচ্ছি।
– তুমি এটা কিভাবে করলে ভাইয়া? একটাবার কি মনে হলো না আবিদের বোনের দিকে কিভাবে হাত বাড়াই?
– ট্রাস্ট মি ভাই, আমি সত্যি জানতাম না অর্পিতা তোমার বোন।
– তুমি ওকে আগে দেখেছো। আর তুমি বলছো ওকে চিনতে পারোনি?
– এটা কেমন অযৌক্তিক প্রশ্ন করলে আবিদ? ও তখন ছোট ছিলো। ওকে দেখেছি শেষবার দেখেছি চৌদ্দ বছর আগের কথা৷ এতগুলো বছর পর দেখলে ওকে আমি চিনবো কি করে?
– ওর কাছে কি কখনো আমার ছবিও দেখোনি?
– না। আমি তোমার নাম শুনেছি ওর মুখে। কিন্তু তখন ভাবিনি এটা তুমি। এমনকি আমি কখনো তোমাদের বাবা মায়ের ছবিও দেখিনি ওর কাছে। যদি উনাদেরকেও দেখতাম তাহলেও বুঝতাম এটা কোন অর্পিতা। বিশ্বাস করো আবিদ আমি জানতাম না অর্পিতা তোমার বোন।
– অর্পিতা আমাকে সব বলেছে। তোমার সাথে রিলেশন থেকে শুরু করে তোমার বেডরুমে অন্য মেয়ের কাহীনিসহ সবটুকু। আমি সব জানি। তোমাকে আমি কল করতাম না। আজকে কল করেছি শুধুমাত্র আমার বোনের কারণে। দেখো, যা হওয়ার হয়েছে। আমি চাইনা আমার বোন তোমার ধোঁকার মাঝে পড়ে থাকুক। ঘটনার ইতি এখানেই হোক। তুমি আর কখনো আমার বোন বা আমার বাসার কোনো মেম্বারকে ফোন করো না। তুমি এভাবে ফোন দিতে থাকলে আমার বোনের তোমাকে ভুলতে কষ্ট হবে।
– আমাকে ভুলে যাবে মানে? কি বলতে চাও তুমি?
– তুমি নিজেই ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছো। এখন আবার ওর পিছু নিয়েছো৷ কেনো নিয়েছো তা জানি না। হতে পারি ওর প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস আছে বা অন্য কোনো ঘটনাও হতে পারে। যাই হোক না কেনো, তোমার ওর প্রতি ফিলিংস থাকুক আর না থাকুক আমি চাইনা তোমার সাথে আমার বোন জড়াক।
– কেনো? সমস্যা কি?
– এতকিছু হওয়ার পরও জিজ্ঞেস করছো কেনো?
– হ্যাঁ করছি।
– তুমি নষ্ট হয়ে গেছো আশফাক ভাই। যে হাত বিভিন্ন মেয়েদের নগ্ন শরীর হাতড়ায় সেই হাতে বোনের দায়িত্ব কিভাবে তুলে দেই?
– আমি বদলে গেছি আবিদ৷ হ্যাঁ আমি খারাপ কাজ করেছি। এখন আমার মাথায় অর্পিতা ছাড়া আর কিছু আসে না৷ আর আমি এমন ছিলামও না। পরিস্থিতি আমাকে এমন করেছে।
– হ্যাঁ তুমি এমন ছিলে না৷ পরিস্থিতি তোমাকে এমন করেছে। তোমার প্রতি আমার মনে বরাবরই একটা সফট কর্নার ছিলো, আর সেটা এখনো আছে। কিন্তু সেটা আমার বোনের চেয়ে বেশি না। তোমার চেয়ে কয়েকশো গুন বেশি আমি আমার বোনকে ভালোবাসি৷ ওর কাছে তোমার প্রতি ভালোবাসা তুচ্ছ। আর তুমি যে বলছো তুমি বদলে গেছো, হ্যাঁ হয়তোবা তুমি বদলেছো৷ কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব কতদিন তা আমি জানি না। আপাতত অর্পিতার প্রতি তোমার ফিলিংস এসেছে। হয়তোবা মাস ছয়েক পর সেটা থাকবে না৷ কারন তোমার মাথায় মেয়েলোকের বিষ ঢুকেছে৷ এই বিষ সাময়িক ভাবে কাঁটলেও পুরোপুরি কখনো কাঁটে না।
– তোমার বোন আমার বিয়ে করা বউ। চাইলেই তুমি ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারো না।
– বিয়েটা নকল। সেটা তুমি নিজেই স্বীকার করেছো৷ অতএব মিথ্যা বলা বন্ধ করো। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ৷ সামনে এক পা এগোনোর আগে বহু বিচার বিবেচনা করে আগাও সেটা আমি জানি। অর্পিতার সামনে ওর বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে আমি শুধু আমার বোনের বড় ভাই, আশফাকের ছোট ভাই না৷ অর্পিতার ভাই আশফাককে চিনে না। আশা করি আমার বোনের দিকে পা বাড়ানোর আগেও দশবার বিবেচনা করে নিবে৷
আশফাককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেঁটে দিলো আবিদ৷ আশফাক ছুটলো রিমনের রুমের দিকে। মাথা আর ঘাড়ে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে তার৷ সেদিন অর্পিতা সুইসাইড এটেম্পট নেয়ার পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয়েছে৷ থেমে থেমে ব্যাথাটা হয়। কোনোকিছু নিয়ে একটু বাড়তি চিন্তা করলেই ব্যাথাটা জেঁকে বসে৷ আবিদের কথা শুনে ব্যাথাটা আবার শুরু হয়ে গেছে৷ পাগলের মতো রিমনের আলমারী ঘাটাঘাটি করছে আশফাক৷ বিয়ের কাবিননামা বের করতে হবে৷ আবিদকে দেখাতে হবে৷ ওকে বুঝিয়ে সব বলতে হবে। বিশাল বড় মিসআন্ডাস্ট্যান্ডিং তৈরী হয়েছে৷ সেটা ক্লিয়ার করতে হবে। এক্ষুনি করতে হবে।
(চলবে)