#ভোরের_আলো
৪০.
বাবা আর ভাইয়ের মুখোমুখি বসে আছে কৌশিক। আশফাককে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে ঘরে। ডাইনিং রুমে বসে মটরশুঁটির খোসা ছাড়াচ্ছে শিফা আর কৌশিকের মা। তারা দুজন কাজ করছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের সব কথা শুনছে। কৌশিকের মা রাজিয়া আশফাককে ভীষণ ভালোবাসেন। উনার কাছে কৌশিক যা, আশফাকও তা। কখনো দুজনের মাঝে উনি কোনো পার্থক্য করেননি। আজ আশফাকের কথা শুনে যেমন কষ্ট পাচ্ছেন তেমনি রাগও হচ্ছেন। কি করে করলো এমন কাজটা? শাশুড়ীর মুখটা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছে শিফা। সে বুঝতে পারছে শাশুড়ীর মনে আপাতত কি চিন্তা ছোটাছুটি করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,
– মেয়েটার জন্য আপনার বেশি কষ্ট হচ্ছে না মা?
– দুজনের জন্যই। দুজনই তো কষ্ট পাচ্ছে।
– আপনি তো মেয়েটাকে দেখেননি। দেখলে বুঝতে পারতেন। কি যে সুন্দর মেয়েটা! বয়সও অনেক কম।
– হুম। বললো তো কৌশিক। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বয়স আর কত হবে? ২০-২১।
– হ্যাঁ, এমনই হবে। কি করে পারলো আশফাক এমন করতে? মেয়ের জায়গায় তো ও একদম ঠিক। এমন অবস্থায় নিজের হাজবেন্ড কে কখনোই কোনো মেয়ে মেনে নিবে না। আমি হলেও তাই করতাম।
– হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু আশফাকের ব্যাপারটা ভিন্ন। ওর সাথে তো তুমি সবার তুলনা করতে পারো না। ও কেমন ছেলে তা তো আমরা জানি। এবার একটা ভুল করে ফেলেছে। স্বীকার করছে তো। বেচারা বেশ অনুতপ্তও। একটা সুযোগ তো ওকে দেয়া উচিত। যদি এবার ওকে সুযোগ না দেয়া হয় ও হয়তোবা ভবিষ্যৎ-এ আরো খারাপ হতে পারে। মনে করে দেখো তো, ওর বাবা ওকে ঘর থেকে বের করার পর কিন্তু ও রাত্রির কাছে গিয়েছিলো। ঐ মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো। রাত্রি ফিরিয়ে দেবার পরেই আশফাক খারাপ হয়ে গেলো। তার পরিনাম তো দেখছোই। ওর যেই অবস্থা শুনছি, শুনে তো মনে হচ্ছে রাত্রির চেয়েও আরো কয়েক গুন বেশি অর্পিতার প্রতি উইক। এখন যদি এই মেয়েও চলে যায় তাহলে ও মারাই যাবে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে আরো খারাপ হয়ে যাবে।
তারউপর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।
– তা ঠিক। এখন কথা হচ্ছে মেয়ের ফ্যামিলি জেনে শুনে আশফাকের কাছে মেয়ে দিবে কি না।
– তোমার শ্বশুর তো যাবে ওখানে। মেয়ের বাবার সাথে কথা বলুক। দেখা যাক ঐ বাড়ির মানুুষ কি বলে।
– বাবা তো যাওয়ার কথা কিছু বললো না। উনি তো মন দিয়ে নিউজ দেখছে টিভিতে। কৌশিকের কথা কি বাবা কিছু শুনছে?
– সবই শুনছে। খবরটা শেষ হোক। এরপর কথা বলবে।
টিভি নিউজ শেষ হওয়া মাত্রই কৌশিকের দিকে তাকালেন কবির সাহেব৷
– আচ্ছা কৌশিক তোর কাছে মনে হচ্ছে না তুই অযৌক্তিক তর্ক করছিস অর্পিতার সাথে?
– তো! করছি না আবার! আমার তর্ক পুরোটাই অযৌক্তিক। আশফাক যেই কাজ করেছে এটা কখনোই মেনে নেয়ার মতো না। আমি অর্পিতার জায়গায় থাকলে এতক্ষণে আশফাককে মেরেই ফেলতাম। এই মেয়ে তো তবুও ভালো যে এমন কিছুই করেনি। অর্পিতা ওর জায়গায় একদম ঠিক। তবু আমি জোর গলায় তর্ক করছি শুধু আশফাকের মুখের দিকে তাকিয়ে। ওকে আমি আর কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। ওকে এভাবে দেখতে আমার আর ভালো লাগছে না। এমন হাসিখুশি মানুষ যদি মরার মত সারাদিন ঘরে পরে থাকে তাহলে হয়? দুইদিন দেখেছি ব্লাড হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে৷ কখন কি করে বসে কে জানে? এভাবে হচ্ছে না৷ দ্রুত এটার সমাধান করা উচিত।
– গরু ছাগলের মত তর্ক করলে কখনোই সমাধান হবে না৷ তর্ক করতে হবে যুক্তি দেখিয়ে ঠান্ডা মাথায়।
– এক্স্যাটলি। বাবার কথাটাই আমি তোকে বলতে চাচ্ছিলাম। তুই যে বারবার ঐ মেয়েকে বলছিস ডিভোর্স দিতে পারবে না। কেনো পারবে না? ও ডিভোর্স দিবে কি দিবে না সেটা ওর খুশি। আশফাক যেই কাজ করেছে এতে ওকে ডিভোর্স দিতে চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তারউপর তুই মেয়ের ভাইকে থ্রেট দিচ্ছিস। কেনো? এমনিতেই দোষ আমাদের ছেলের। আমাদের উচিত এখন যতটা সম্ভব নম্রভাবে তাদের সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সেটা অন্য বিষয়। যদি দেখতি কোনোভাবেই উনাদেরকে ম্যানেজ করা যাচ্ছে না তখন নাহয় থ্রেট দিতে পারতি। তুই সেসব না করেই হুমকি ধমকি শুরু করে দিলি। গলা ফাটিয়ে তর্ক করলেই হয় না। তর্ক করতে হবে মাথা খাটিয়ে। এমন সব যু্ক্তি দাঁড় করাতে হয় যেটা শুনে সামনেরজন চুপ হয়ে যাবে। আমার দেয়া অপশন ছাড়া আর কোনো অপশন তার কাছে থাকবে না।
– তোর উচিত ছিলো আমাকে আরো আগেই জানানো। আমজাদ ভাইয়ের সাথে তাহলে আরো আগেই কথা বলতে পারতাম। বেচারা আশফাক। বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে। এক কাজ কর। কাল সকালে ওর বাসায় যা। ওদের দুইভাইকে নিয়ে আয় এখানে। সমাধান হওয়ার আগ পর্যন্ত থেকে যাক কিছুদিন। ঐ বাসায় সারাদিন একা থাকে। এখানে সবার মাঝে থাকলে একটু ভালো লাগবে।
– আমজাদ আংকেলের সাথে যোগাযোগ থাকলে ভালো হতো। ঐ এলাকা ছেড়ে এসেছি ২২-২৩ বছর তো হবেই। তোমাকে দেখে চিনবে কিনা কে জানে?
– কে বললো যোগাযোগ নেই?
– প্রতি সপ্তাহে দু একবার কথা হয়। মাঝেমধ্যে বাসায়ও যাই।
– কখনো তো বলো নি।
– আমি তো কত মানুষের সাথেই যোগাযোগ করি। এখন কি সবার কথা তোকে লাইন টু লাইন বলবো নাকি?
– কবে কথা বলবে উনার সাথে?
– দশ বারোদিন আগে ফোনে কথা হয়েছিলো। বলেছিলো ইন্ডিয়া যাবে কিনা। দেশে ফিরেছে কিনা ঠিক বলতে পারছি না। অনেক রাত তো হয়েছে। কাল সকালে ফোন করে দেখবো দেশে আছে কি না।
– দেশে থাকলে কিন্তু আমরা কালকেই যাচ্ছি ঐ বাসায়।
– হুম যাচ্ছি। তবে তোকে নিচ্ছি না। আমি কানন আর আশফাক যাবো। যদি রিমন যেতে চায় তো ওকে নিয়ে যাবো।
– আমি গেলে কি সমস্যা?
– তোর মাথা গরম। সেখানে কি থেকে কি বলে বসবি তার কোনো ঠিক নেই। তুই বাসায় বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবি।
রাত ১১.৫০,,,,,,
ড্রইংরুম থেকে পাখির গলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
– চাচী দেইখা যান,,, চাচায় আইসা পড়ছে।
যার যার রুম থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। ড্রইংরুমের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন আমজাদ সাহেব। আবিদ বেশ কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– আব্বু! এত জলদি চলে এলে যে! তোমার না আরো পরে আসার কথা ছিলো?
– হ্যাঁ ছিলো তো৷ কেমন যেনো ছটফট লাগছিলো বাসার জন্য। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে এখানে। বড় কিছু। বিশেষ করে অর্পিতার কথা বারবার মাথায় ঘুরছিলো। কোনোভাবেই মন শান্ত করতে পারছিলাম না৷ হাবিব কে দায়িত্ব দিয়ে আমি চলে এলাম।
চার ভাইবোন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সময় তাহলে হয়েই গেলো আমজাদ সাহেবের সামনে সত্যিটা বলার।
(চলবে)