#ভোরের_আলো
৪৮.
সারারাত ঘুমায়নি অর্পিতা৷ পুরো রাত জুড়ে কেঁদেই গেছে৷ অর্পিতার পাশেই চুপচাপ বসে ছিলো আশফাক। কখনো প্রচন্ড কষ্টে কেঁদেছে, কখনোবা প্রচন্ড অনুশোচনায় মাথা নিচু করে একের পর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। মুখ ফুটে কিছু বলার মত কথা খু্ঁজে পাচ্ছিলো না সে। অপরাধবোধটা বাজেভাবে জেঁকে ধরেছিলো।
সকাল নয়টা৷ সারারাত কান্নাকাটি করে ভোরের দিকে এসে বিছানায় গা এলিয়েছিলো অর্পিতা৷ এর কিছুক্ষণ বাদেই ঘুমিয়ে গেলো। ঘুম আসেনি আশফাকের৷ ফ্লোরে বিছানার পাশে এসে বসে আছে সেই ভোর থেকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে অর্পিতাকে দেখছে সে। কতদিন হলো অর্পিতাকে মনভরে দেখা হয় না৷ আজ সুযোগ পেয়ে নয়ন তৃষ্ণাটুকু মিটিয়ে নিচ্ছে সে। মেয়েটার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। ঠোঁটজোড়া শুষ্ক হয়ে বেশ কুঁচকে আছে৷ লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর গলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ চেহারায় মলিনতা স্পষ্ট৷ তবুও মেয়েটাকে পরীর মতই মনে হচ্ছে আশফাকের কাছে। আলো ছড়ানো পরী।
কলিংবেল বাজছে বাসার। বেলের শব্দে ঘোর কাটলো আশফাকের। ধীরপায়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো কৌশিকের মা আর ভাবী দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো আশফাক। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বেশ উৎসুক কন্ঠে রাজিয়া আশফাককে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি রে? বউ কোথায়?
– ঘুমায়।
– নাস্তা এনেছি। যা বউকে ডেকে তোল।
– আরেকটু ঘুমাক। সারারাত ঘুমায়নি।
– কেনো?
– কেঁদেছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন রাজিয়া। ডাইনিংয়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রসঙ্গ পাল্টে আশফাককে জিজ্ঞেস করলেন,
– ডিম আছে না?
– হুম।
– শিফা, ডিম ভাজো তো৷ আমি মাংস, পরোটা আর ফল নিয়ে এসেছি ডিমটা ভাজিনি৷ ডিম ভাজা গরম গরম না খেলে তো আবার ভালো লাগে না। পরোটাগুলোও তো ভাজতে হবে। ওগুলো ভেজে আনিনি বুঝলি৷ ঠান্ডা হয়ে যাবে তো। তুই ওকে ডেকে তোল৷ ফ্রেশ হয়ে নাস্তাটা খেয়ে নিক৷ আমরাও তোদের খাওয়া হলে চলে যাবো। এরপর নাহয় ও আবার যতক্ষণ খুশি ঘুমিয়ে নিবে। তুইও মনে হচ্ছে ঘুমাসনি তাই না?
– হুম।
– চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে৷ যা ওকে ডেকে তোল।
আশফাকের ডাকে ঘুম ভাঙলো অর্পিতার৷ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই ডিম ভাজার গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বমি পাচ্ছে তার। হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো সে৷ পিছন পিছন ছুটলো আশফাক।
মাত্রই অর্পিতা বমি করে রুমে এসে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এখনো অস্থির লাগছে তার। পুরো ঘর জুড়ে এখনো ডিম ভাজার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে আছে৷ অর্পিতার পাশেই পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক। মাথার কাছে বসে আছে রাজিয়া। অর্পিতার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন,
– পানিটা খাও একটু।
– বাসায় এয়ার ফ্রেশনার আছে?
– কি রে আছে বাসায়?
– আছে তো।
– স্প্রে কর তাড়াতাড়ি।
বেড সাইড টেবিলের উপর পানির গ্লাসটা রেখে নিজের রুমে গেলো আশফাক৷ শোয়া থেকে উঠে বসলো অর্পিতা। একটু একটু করে পানি খাচ্ছে সে।
– তোমার যে ডিম ভাজা পছন্দ না আমি তো জানতাম না৷ আশফাকও তো কিছু বললো না৷ জানলে তো শিফাকে ভাজতে বলতাম না।
– না, না। ডিম ভাজা তো আমি খাই৷ কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবৎ কেনো যেনো ডিমের স্মেল একদম সহ্য হচ্ছে না৷ নাকে ডিমের গন্ধ লাগলেই বমি করে দেই৷ মাঝেমধ্যে তো খাবার দেখলেও বমি আসে।
– ওহ্ আচ্ছা। তোমরা দুজনে যে বিয়ে করেছো কতদিন যেনো হলো?
– এইতো,,,, একমাস তেইশদিন। কেনো আন্টি?
– নাহ্ এমনি। জ্বর-টর আছে গায়ে?
– না, জ্বর নেই তো।
পুরো ঘরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করছে আশফাক। খানিকটা ভ্রুঁ কুঁচকে অর্পিতাকে বললো,
– তুমি না ডিম কত পছন্দ করো! হঠাৎ কি হলো বলো তো?
– বলাবলি পরে হবে৷ নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে৷ আয় আগে নাস্তাটা সেড়ে নে।
– হুম। অর্পিতা তুমি যাও খালাম্মার সাথে। আমি আসছি একটু পরে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অর্পিতা। রাজিয়ার পিছন পিছন ডাইনিংরুমের দিকে যাচ্ছে সে। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে শিফা। অর্পিতাকে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করলো,
– এখনো কি ডিমের গন্ধ নাকে লাগছে?
– না ভাবী।
– তাহলে ঠিকাছে। নাও, টেবিলে বসে পড়ো৷
– আপনারাও বসুন। আমি একা খাবো নাকি?
– হুম আমি তো বসবোই। তোমার সাথে খাবো বলে বাসা থেকে না খেয়ে বেরিয়েছি৷
– আন্টি আপনি খাবেন না?
– না, আমি খেয়ে এসেছি। এক কাপ চা খাবো শুধু।
– একটু হলেও খাবেন।
অর্পিতা রাজিয়ার দিকে প্লেট এগিয়ে দিতেই ওর হাত ধরে বাঁধ সাধলো রাজিয়া।
– আমি খাবো না৷ একদম ক্ষুধা নেই। আমি শুধুই চা খাবো।
– আমরা খাবো আপনি বসে থাকবেন এটা কেমন কথা!
– ব্যাপার না। আমি না খেয়ে আসলে সেটা অন্য কথা ছিলো। তুমি খাও।
অর্পিতা আর শিফার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন রাজিয়া৷ এক পর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন,
– অর্পিতা,,,,,
– জ্বি?
– এইমাসে কি ডেট মিস হয়েছে?
– মানে?
– গতকাল অনুষ্ঠানের মাঝে তোমার আম্মু একবার বললো তুমি নাকি বেশ কিছুদিন যাবৎ খেতে পারছো না৷ এজন্য নাকি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছো। মাথা নাকি ঘুরায়। আজকে আবার তুমি বললে ইদানীং খাবার দেখলে বমি আসে৷ আবার সকালে বমিও করলে। মনে তো হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট। তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।
গলায় খাবার আটকে গেছে অর্পিতার৷ বিভিন্ন টেনশনে এই কথাটা তো একদমই মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিলো৷ খেয়ালেই আসেনি৷ দুশ্চিন্তা যেনো আরো গাঢ় হচ্ছে! মাথা নিচু করে প্লেটের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অর্পিতা৷ অজানা কোনো ভয় তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন রাজিয়া৷ অর্পিতার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– টেস্ট করিয়ে ফেলো৷
-………..।
– অর্পিতা…..
– হুম?
– কি ভাবছো?
– কিছু না৷
– আশফাককে কি কথাটা তুমি বলবে নাকি শিফাকে বলতে বলবো?
– ওকে জানানোর দরকার নেই। আমি মুক্তাকে নিয়ে টেস্ট করে আসবো।
– এটা কেমন কথা? আশফাক থাকতে তুমি মুক্তাকে নিয়ে কেনো যাবে? তাছাড়া ও তোমার হাজবেন্ড। ওকে কথাটা তুমি জানাবে না?
– কি কথা খালাম্মা?
আশফাকের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন রাজিয়া৷ শিফা বেশ উৎসুক কন্ঠে আশফাককে বললো,
– অর্পিতা বোধ হয় প্রেগন্যান্ট।
– কে বললো?
– মায়ের সন্দেহ হচ্ছে আরকি৷ তুমি কালই ওর টেস্টটা করিয়ে আনবে।
হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়ছে আশফাকের। ক্ষীন আশার আলো উঁকি দিচ্ছে তার মনে৷ সম্পর্কটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চাবিটা বোধ হয় এবার অবশেষে খুঁজে পাওয়া যাবে।
(চলবে)