#ভ্যাম্পেয়ার_রাজ্য
#লেখিকাঃ_মার্জিয়া_রহমান_হিমা
#পর্বঃ ০২
মনে হাজার ভয় আর আশংকা নিয়ে প্রিসাকে বিদায় জানায় শ্রেয়া আর প্রান্ত। সেই রাজ্যে নতুন কি খেলা শুরু হবে কেউ জানে না। রাজ্যের আনাচেকানাচে যে প্রিশার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে সেই সম্পর্কেই অবগত তারা।
প্রিশার গাড়ি চোখের আড়াল হতেই শ্রেয়া ছলছল চোখে প্রান্তর পানে তাকায়। প্রান্ত শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রেখে শান্তনা বাণীতে বললো
” চিন্তা করো না। প্রিশা সুস্থ এবং সশরীরে আমাদের কাছে ফিরে আসবে। প্রিশার জন্য দোয়া করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
প্রিশা চলে যাওয়ায় নওমির ভিষণ মন খারাপ হয়েছে কিন্তু মাম্মা আর পাপাকে এতো চিন্তিত দেখে নওমি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো
” হোয়াট হ্যাপেন্ড পাপা ?”
প্রান্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে সব চিন্তা আর ভয় লুকিয়ে নেয়। ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে বললো
” নাথিং,পাপা। চলো আজকে আমরা ঘুরতে যাবো।” নওমি খুশি হয়ে মাথা নাড়ায়। শ্রেয়া সকল ভয় নিজের মধ্যে রেখে বাবা আর মেয়েকে দেখে হাসলো।
চলতি গাড়ির মধ্যে প্রিশা শান্ত হয়ে বসে রয়েছে। তার হেডফোনে গান বেজে চললেও প্রিশা বাইরের দিকে তাকিয়ে তার ভাবনায় মগ্ন হয়ে রয়েছে। ড্রাইভারকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেনি তাদের গন্তব্য কোথায়। তবে ধরে নিচ্ছে লন্ডনেরই ত্রিসীমানায় তার গন্তব্য। কিন্তু তার মনে অনেক প্রশ্নের ঝুলি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এতো কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তার মাম্মি বা পাপার মুখে তার নানা-নানীর কথা উচ্চারণ করতে দেখেনি। ছোট থেকে কোনোদিন ফোনেও কথা বলেছে বলে তার মনে হয়না। প্রিশা শুধু তার মাম্মির ছোটবেলা সম্পর্কেই গল্প শুনেছেই বড় হয়েছে। কখনো সাক্ষাৎ বা কথাও বলেনি। এতো এতো কৌতূহল তার মাঝে। কি করে সব উত্তর পাবে সেসব ভাবছে সে।
প্রিশা ভাবতে ভাবতে তার চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করে। ঘুম কাতুরে প্রিশা মিনিটের মাঝেই সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
উৎসব মুখর বাড়ির মতো সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে। সিদ্ধার্থ হেল্ড সহ বাড়ির প্রত্যেকে ছুটোছুটি করছে। যে কোনো সময়েই তাদের গেস্ট চলে আসবে। দিদার হেল্ড, রিনা, শায়ানের মা পাখি আর বোন সাইরা। তাদের খুশি যেনো ধরে না। সবার এতো খুশি আনন্দের মাঝে শুভ্র আর শায়ান হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে আর সবাইকে দেখছে। তাদের কাছে এসব রং তামাসা মনে হচ্ছে। খুবই বিরক্ত তারা দুজন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার দাদা আর দাদিমনির আদেশ পালন করতে বসে বসে মসা মারছে বলা চলে। ভার্সিটি বন্ধ তাই অন্য কোনো অজুহাতও দেখাতে পারেনি। শায়ান ফোন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।
সৈকত হেল্ড এসে শুভ্রদের সামনের সোফায় বসতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
” বাবা স্পেশাল গেস্ট টা কে ? সবার এতো আনন্দ দেখে আমার মনে হচ্ছে আকাশের চাঁদ নেমে আসছে আমাদের বাড়িতে।” সৈকত হেসে উঠলো শুভ্রর কথা শুনে। হাসতে হাসতে বললো
” চাঁদই তো নেমে আসছে আমাদের বাড়িতে। আমাদের চাঁদটা আমাদের কাছে অমূল্য রতনের মতোই তাই সবাই এতো খুশি। কে আসছে তুমি এখনও বুঝতে পারোনি?”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। সেই অমূল্য রতন টা কে বুঝতে উঠতে সক্ষম হয়নি সে। শুভ্র অধৈর্য হয়ে বললো
” বাবা বলো তো কে আসছে ! আমার কিন্তু এসব বিরক্ত লাগছে।”
সৈকত হেসে বললো
” তোমারে শ্রেয়া ফুপ্পির মেয়ে আসছে।” শুভ্র চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সৈকতের কথা শুনে। শুভ্র অবাক স্বরে বললো
” শ্রেয়া ফুপ্পির মেয়ে? বাবা মজা করছো আমার সাথে ? শ্রেয়া ফুপ্পির মেয়ে আসছে ?”
সৈকত শান্ত গলায় বললো
” তাই তো জানি আমি। এতো অবাক হচ্ছো কেনো তুমি?” শুভ্র অবাক গলায় বললো
” তোমরা কি করে অবাক হচ্ছো না সেটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি।” সৈকত উঠে যেতে যেতে বললো
” অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা কিছু আমাদের জীবনে রয়েছে তাই হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও আসছে সে।”
শুভ্র তার বিস্ময় নিয়েই শায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে শায়ান এখনও ফোনেই ডুবে রয়েছে। শুভ্রর ইচ্ছে করলো একটা থাপ্পড় মারতে কিন্তু শুভ্র তা না করে উঠে চলে গেলো।
গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনতেই বাড়ির সবাই বেরিয়ে আসে। শুভ্র তার রুমের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি এসে থামলেও গাড়ির থেকে কেউ বের হচ্ছে না দেখে শুভ্রর কপালে ভাজ পড়লো। শুভ্র ব্যালকনি থেকে চলে গেলো।
বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রিশাকে দেখার জন্য কিন্তু প্রিশা তো গাড়িতে বসে বসে এখনও ঘুমিয়েই যাচ্ছে। ড্রাইভার প্রিশার দিকে ঘুরে মুখ লটকিয়ে তাকিয়ে থাকে। এতো দূড় পথ পার করে এলো কিন্তু এই মেয়ের ঘুম ভাঙেনি এখনও। ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে। সিদ্ধার্থ হেল্ড আর দিদার হেল্ড এর কাছে গিয়ে বললো
” স্যার ! ম্যাম এখনও গাড়িতে ঘুমাচ্ছে। অনেকবার হর্ণ বাজিয়েছি কিন্তু ঘুম ভাঙেনি তার।” শুভ্র মাত্রই সবার সাথে এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু ড্রাইভারের কথা শুনে হাসি পেলো তার। শায়ান হা হা করে হেসে বলে উঠলো
” কি গেস্টরে বাবা ! কোথাও ঘুরতে যাওয়ার এক্সাইটমেন্টে মানুষ ঘুমায় না আর তার ঘুম ভাঙ্গানো যাচ্ছে না।” শুভ্র ছাড়া সবাই এক সঙ্গে কড়া চোখে তাকাতেই শায়ানের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।
সাইরা এগিয়ে যায় গাড়ির কাছে। ড্রাইভার গিয়ে গাড়ির লক খুলে দিলে সাইরা গাড়ির দরজা খুলে প্রিশার দিকে তাকায়। প্রিশাকে দেখে মুচকি হেসে সাইরা প্রিশাকে ডাকতে থাকে
” প্রিশা ! প্রিশা ! প্রিশা দেখো কোথায় এসেছো তুমি।”
প্রিশা হাই তুলে চোখ খুলে সাইরার দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো
” হু আর ইউ ?” সাইরা হেসে দিলো প্রিশার প্রশ্ন শুনে। সাইরা পানির বোতল এসে প্রিশার হাতে দিয়ে বললো
” চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘুম ভাবটা ছাড়িয়ে নাও। তুমি আমাদের বাড়িতেই এসেছো, বুঝলে পিচ্চি!”
প্রিশা মাথা নেড়ে হ্যা বললো। গাড়ির অন্য দরজা খুলে গিয়ে মুখে কয়েক ঝাপটা পানি দিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। সাইরার কাছে এসে বললো
” তুমি কে হও আমার?” সাইরা মুচকি হেসে প্রিশার দুই বাহু জড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো
” আমি তোমার আপু হই। আমার নাম সাইরা। আমি কিন্তু বয়সে তোমার বড় হই।” প্রিশা হেসে সামনে তাকায়। এতো মানুষ দেখে প্রিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
বাড়ির সবার চোখ যেনো ঝলসে যাচ্ছে। প্রিশার রূপের তুলনা করলেও বোকামি। প্রিশার মুখের হালকা হাসিটা সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শুভ্র বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে প্রিশাকে। শুভ্রর ভাবনার আশেপাশেও ছোঁয়া যাবে না প্রিশাকে।
সিদ্ধার্থ হেল্ড আর দিদার হেল্ড এর চোখ ঝড়ে পানি পড়তে থাকে। প্রিশা সামনে আসতেই দিদার হেল্ড কাঁপাকাঁপা গলায় বললো
” একদমই মায়ের মতো দেখতে তুমি নানুমনি। মনে হচ্ছে শ্রেয়ার প্রতিচ্ছবি দেখছি।”
প্রিশা ভেবে ঠোঁট উল্টে বললো
” কিন্তু মাম্মি আর পাপা বলে আমি মাম্মির থেকেও অনেক সুন্দর।” প্রিশার কথা সবাই হেসে উঠে। প্রিশা সবার হাসি দেখে লজ্জা পেয়ে যায়। মনে হলো উক্ত কথাটা না বললেও ভাল হতো। দিদার হেল্ড হেসে বললো
” হ্যা তুমি তো তোমার মায়ের থেকেও দশগুণ সুন্দর। চলো তোমার নতুন পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।” দিদার হেল্ড একে একে সবার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিলো। সবাই প্রিশাকে দেখে কাঁদলো। প্রিশা কিছুই বলতে পারলো না। কেনো কাঁদছে তারা সেটাও বুঝে উঠতে পারলো না। শায়ানের কাছে আসতেই শায়ান লম্বা করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতে থাকে
” আমি শায়ান বুঝলে ? তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর। তুমি চাইলে আমরা ফ্রেন্ড হতে পারি।”
প্রিশা ফিকফিক করে হেসে দেয়। সাইরা এসে শায়ানের মাথায় গাট্টা মারে। প্রিশা হেসে হেন্ডশেক করে। শুভ্র তাদের কথার মাঝে দুই পা পিছিয়ে আড়ালে চলে গেলো। সবাই প্রিশাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসে। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই প্রিশার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে আর পুরো শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠে। প্রিশা কিছু বুঝলো না এমন হওয়ার কারণ
সবাই প্রিশাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে।
শুভ্র উপর থেকেই সবই দেখতে থাকে। তার এক দৃষ্টি পুরোটা জুড়েই প্রিশার উপর রয়েছে। প্রিশার সব কিছুই সে লক্ষ করছে।
লাঞ্চ টাইম অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে কিন্তু প্রিশার আসতে লেট হওয়ায় আর এতোক্ষণ গল্প করায় আরো দেড়ি হয়ে যায়। প্রিশা রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতেই সবাই তাকে নিয়ে টেবিলে বসলো। মায়ের ডাকে উপর থেকে শুভ্রও আসতে থাকে শিস বাজাতে বাজাতে। প্রিশা একবার তাকিয়ে আবার সাইরাদের সাথে গল্প করতে থাকে। শুভ্র এসে নিজের চেয়ার রেখে প্রিশার পাশে এসে বসলো। সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। সার্ভেন্টরাও গভীর ভাবে শুভ্রর বসার ব্যাপারটা দেখলো।
দিদার হেল্ড আলতো হাসে। শুভ্র প্রিশার দিকে তাকালো না একবারও। খাবার সার্ভ করলে সবাই খেতে থাকে। খেতে খেতে খেয়াল করলো সাইরা বারবার প্রিশাকে পিচ্ছি বলে সম্মোধন করছে।
আরেকবার কথার মাঝে পিচ্চি ডাকতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে
” আপু তুই বারবার ওকে পিচ্চি ডাকছিস কেনো ? এতো বড় মেয়েকে পিচ্চি ডাকে কেউ ?” প্রিশা শুভ্রর মুখের পানে তাকিয়ে আবার সাইরার দিকে তাকায়। সাইরা মুখ কুঁচকে বললো
” যা ইচ্ছে তাই বলবো তোর কি? আর কলেজে জাস্ট ভর্তি হয়েছে আমাদের প্রিশা। ওকে তো পিচ্চিই বলবো।” সাইরার কথা শুনে বিষম খেয়ে শুভ্রর মুখ থেকে খাবার বেরিয়ে গেলো। প্রিশা হেসে দেয়। রিনা এসে শুভ্রকে পানি দিতে দিতে ধমকের সাথে বলে
” সুন্দর করে খেতে পারিস না ? কি করছিস এসব? আর খাওয়ার সময় এতো কথা বলছিস কেনো ?” শুভ্র পানি খেয়ে বিরবির করে বললো
” এতো পিচ্চি মেয়ে ? ফুপ্পির মেয়ে এতো ছোট হলে কি করে হবে ? আমি বিয়ে করবো কখন তাহলে ?”
রাতে প্রিশা নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে সারাদিনের কথা ভাবতে থাকে। আর মুচকি মুচকি হাসতে থাকে আর সারাদিনের কথা ভাবতে থাকে। সবার সাথে খুব ভালো সময় কাটিয়েছে প্রিশা। মা, বাবার ফোনে ট্রাই করেও তাদের পেলো না। না পেয়ে প্রিশার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘুমিয়ে গেলো।
মাঝরাতে হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হয়। ব্যালকনির দরজা খুলে হুরহুর করে রুমে বাতাস প্রবেশ করতে থাকে। বাতাসের সঙ্গে কেউ একজন ঝড়ের গতিতে প্রিশার রুমের ভেতরে ঢুকলো।
চলবে……….