মনের কোণে🥀
#পর্ব_৫
আফনান লারা
.
রাত বারোটার কিণারা ছুঁই ছুঁই,গোটা ছাত্রাবাসের কেউ কেউ ঘুমায়,কেউ বা উদ্যমে পড়ে যাচ্ছে।আর কেউ ফোন টিপতে ব্যাতিব্যস্ত।
এর মাঝে জুনায়েদ,রামিশ সহ আরও দুজন ছেলে সুযোগের অপেক্ষায় আছে ঐ যে মতিন মিয়ার বলা কথা।রাত্রিকালীন সুবিধা।
জুনায়েদ জোর করে নাবিলকে ধরে রেখেছে তাদের সাথে চলার জন্য।
লুকিয়ে গেট দিয়ে তারা বের হয়ে গেলো অনায়াসেই।নাবিল জানতে চাইছে কি করে সম্ভব।
ছেলেরা যাতে গভীর রাত পর্যন্ত বাহিরে না থাকে তার জন্য গেটে তালা দেওয়া থাকে।তাহলে তারা কি করে বের হতে পেরেছে।গেট খুললোই বা কে?
জুনায়েদ জানালো চাবি মতিনের কাছে ও আছে।দারোয়ান মতিনের আপন ভাই হয়।ওর থেকে চাবি আত্নসাৎ করা দু মিনিটের ব্যাপার।এমনটা করার জন্য তাকে ছেলেরা পে ও করে।
‘সব তো বুঝলাম।টাকা দিয়ে এত রাতে বের হবার কারণ কি?কই যাবে এখন তোমরা?’
‘আমরা যাব ঘুরতে’
‘সারাদিনই তো ঘুরো।এখন আবার কি ঘুরবে?পড়ালেখা নেই তোমাদের??’
‘ওহে ভৎস!!
পড়ালেখা দিয়া কি করিবে?
যদি জীবনে নাই ঘুরো,নাই তামাশা করো
জীবন রেখে তবে কি লাভ?তবে মরো’
জুনায়েদ খিলখিল করে হাসছে রামিশের কবিতা শুনে
হাসি আটকে শেষে বললো,’পড়ালেখা আছে তবে এখননা।আমাদের পরীক্ষা পরশু শেষ হয়েছে।এখন সময় আনন্দ করবো।আর আমরা ব্রাইট স্টুডেন্টনা না যে গড়গড় করে পড়া শুরু করবো পরীক্ষা শেষ হবার পরেরদিন থেকে।আমরা হলাম ব্যাকবেঞ্চার।আচ্ছা তোমার ব্যাপারে তো কিছুই জানা হলোনা।কিসে পড়ো তুমি?’
‘পড়াশুনা শেষ,গ্র্যাজুয়েট’
‘ওয়াও!তবে ছাত্রাবাসে কেন?এখন তো তোমার চাকরির পেছনে দৌড়ানো উচিত’
‘সেটাই,তবে বাবা রাজিনা।বাবা চায় আমি যেন বিদেশে গিয়ে বাকি পড়াশুনা চালিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হই তারপর ওখানেই সেটেল হয়ে যাই।’
‘এটা তো দারুণ।তা না করে এখানে কেন?’
‘আমার পছন্দ না।আমার ইচ্ছে দেশেই কিছু করবো।আর তাই বাবা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে যার কারণে পালিয়ে এখানে আসা’
‘বাহহহহ।এত কিছু ঘটে গেলো আর তুমি আমাদের এখন বলছো?’
‘আমি কথা কম বলি আসলে’
—-
জুনায়েদ আর রামিশ মনের আনন্দে হাঁটছে আর নাবিল ওদের পিছু পিছু পকেটে হাত ঢুকিয়ে শুকনো পথে চুপচাপ চলছিল।রাতের বেলা বের হবার অভ্যাস তার নেই,এ সময়ে বাড়িতে থাকলে সে গেমস খেলতো কম্পিউটারে।হাঁটতে ভাল লাগেনা তার।এসময়টায় নাহিদকে প্রচণ্ড মিস করছে।একবার আম্মুকে কল করে ওর সাথে কথা বললে মন্দ হতোনা,কিন্তু এখন সে ঘুমে।কাল সকালে কথা বলা যাবে।নিজেকে এত একা আর কখনও লাগেনি।পালিয়ে আসার পরের পরিস্থিতি অনেক কষ্টদায়ক।এক প্রকার বাধ্য হয়ে আসা এখানে।জানতাম সবাইকে প্রচণ্ড মিস করবো।
—–
রাত দুইটা পনেরো মিনিট।জুনায়েদ,রামিশ আর নাবিল ফিরে এসেছে ছাত্রাবাসে।এখন তারা ছাদে।কোকাকোলা আর পপকর্ণ খেতে খেতে গানের আসর জমিয়েছে কজন মিলে।রিফাত নামের ছেলেটা গিটার বাজিয়ে খালি গলায় গান ধরেছে।
রামিশ দূরবীন হাতে গার্লস হোস্টেলের দিকে উঁকি মারছিল।নাবিল ফোন বের করার পর লিখিকে ডিস্টার্ব করার দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসায় কোকাকোলার বোতলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফোন করলো ওর নাম্বারে।ওমা সে নাম্বার ব্লক করে রেখেছে।নাবিল এবার রামিশের থেকে ওর ফোনটা চেয়ে লিখিকে ফোন দিলো।ও তখন ঘুমাচ্ছিল।তারপরেও তাদের রুমে আলো জ্বলছিল,কারণ হেনা পড়ছে।
দূরবীন হাতে নাবিল কিণরায় এসে দাঁড়িয়েছে।বালিশ থেকে মাথা তুলে লিখি ফোন কানে ধরে হ্যালো বললো।
‘শ্রদ্ধেয় চোর আপু,ঘুমাচ্ছেন?’
‘আপনি!!আরেক নাম্বার এটা?’
‘হুম,কেন আশ্চর্য হলে?’
লিখি উঠে বসে মাথার চুল টানতে টানতে একবার হেনার দিলে তাকালো তারপর বিরক্তি সুরে বললো,’আমি টাকা জমিয়ে আপনাকে ফোন কিনে দিব তাও আমায় এমন ভাবে জ্বালাবেন না। আমার কাছে আমার ঘুম অনেক প্রিয়।কেউ সেটাতে ডিস্টার্ব করুক সেটা আমার পছন্দ না’
‘আমার ফ্যামিলি আমার অনেক প্রিয়,তাদের স্মৃতি আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয় এই মূহুর্তে।কেউ সেই স্মৃতি মুছে দিলে তাকে আমার কি করা উচিত?’
‘আমি কি জানতাম আপনার ফোনে আপনার কলিজার টুকরা আছে?এখন কি আজীবন এমন জ্বালাবেন?আপনার আর কাজ নেই?পড়াশুনা নেই?’
‘নাই।ফোন যতদিন না পাচ্ছি ততদিন তোমার ফ্রিডমের বারোটা আমি বাজিয়ে ছাড়বো।এখন এই নাম্বারে ব্লক দিবে তাই না?কাল দেখা হচ্ছে।সামনে দাঁড় করিয়ে নাম্বার সব আনব্লক করাবো।আর সাথে করে পুলিশ ষ্টেশন ও নিয়ে যাব।সেটা সম্ভব না হলে মাঝরাতে এভাবে ফোন করে ঘুম থেকে তুলিয়ে বিছানা ছেড়ে নামিয়ে দিতে বাধ্য করবো’
লিখি কিছু বলতে যাবার আগেই নাবিল লাইন কেটে দিয়েছে।সে যে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমেছে এটা নাবিল কি করে জানলো?
হন্তদন্ত হয়ে লিখি জানালার দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে।সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায়না।হোস্টেলের সামনের মাঠটাতে পিলারে বাতি জ্বলে।পুরো মাঠ খালি স্পষ্ট দেখা যায়।তবে নাবিল কোথা থেকে দেখলো?নাকি সবই আন্দাজ?
—
ভার্সিটিতে যেতে হবে সকাল নয়টায়।লিখি সাতটার দিকে বেরিয়ে পড়েছে।সে জানে প্রতিদিনকার সময়ে বের হলেই নাবিল সামনে এসে দাঁড়াবে।তাই বুদ্ধি করে আগেভাগে বেরিয়ে পড়েছে।প্রফুল্ল মনে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে সে যাচ্ছে ভার্সিটির দিকে।সে জানেও না নাবিল ঠিক কই থাকে।ভয় হলো প্রথম প্রথম।পরে মনে হলো এত সকালে পাকড়াও করতে আসবেনা।
আপন মনে তাই হাঁটার গতি কমালো সে।
‘চোর ম্যাডাম একটু দাঁড়ান’
লিখি জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।নাবিল কোথা থেকে এসে হাজির।সে জানতোনা লিখি বুদ্ধি করে এত সকাল বের হবে।সে তো জগিং করতে বেরিয়েছিল।লিখিকে পেয়ে গেলো এর চেয়ে খুশির সংবাদ এই মূহুর্তে আর কি হতে পারে।দাঁত কেলিয়ে ওর সমনে এসে দাঁড়ালো নাবিল।লিখি মাথা তুলে তাকাচ্ছেনা।নাবিল ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে ফোন বের করে নাম্বার সব আনব্লক করে আবার ফোন ফেরত দিয়ে বললো,’চলো পুলিশ ষ্টেশন ঘুরতে যাবো’
‘আপনি এমন কেন করছেন??কিসের শত্রুতা??ফোনে কটা ছবি ছিল বলে এমন করবেন?আর কাজ নাই?’
‘আপাতত নাই।পড়াশুনা শেষ হলে একটু জিরোতে হয়।ধরে নাও আমি জিরোচ্ছি’
নাবিল কথা বলতে বলতে লিখির ওড়না ধরে ফেলেছে।রিকশা একটাও ডেকে ফেলেছে।তারপর ইশারা করে উঠতে বললো ওকে।
আজ আর কোনো বুদ্ধি লিখির কাজে লাগেনি।ওকে সত্যি সত্যি পুলিশ ষ্টেশনে এনেই ছেড়েছে।সমস্যা হলো পুলিশ অফিসার এখনও আসেননি।দারোগা যে আছে সে জিডি করাবেনা।করাবে অফিসার।তার আসতে অল্প সময় লাগবে তাই ওদের অপেক্ষা করতে বলে দিলো দারোগা।
নাবিল লিখির ওড়নাকে চেয়ারের সাথে ডাবল গিট্টু দিয়ে বেঁধে ওর ব্যাগ থেকে ছুরি নিয়ে বাহিরে গেছে হাঁটতে।
দারোগা পাশেই বসে পাহারা দিচ্ছিল।লিখির এমন করুণ অবস্থা দেখে কিজ্ঞেস করলো,’উনি আপনাকে এমন মজার শাস্তি কেন দিলো?কি করেছেন আপনি?’
লিখি কপাল কুঁচকে বললো,’বিশ্বাস করুন,আমি কিছু করতে পারি?আমার মতন একটা মেয়ে চুরি করতে পারে?এটা মিথ্যা আরোপ ছাড়া আর কিছুইনা।আপনি বলুন এমন চেহারার কেউ চোর হতে পারে?’
‘আমার মেয়ের স্কুলে তার সুন্দর পানির বোতলটা এক মেয়ে নিয়ে গেছে।অথচ আমি তারে নামকরা স্কুলে পড়াই।
২০০টাকা দিয়ে কিনে দিছিলাম বোতলটা।
এখনকার মেয়েদের বিশ্বাস করা যায়না।তাই আপনার চেহারার উপর নির্ভর কর আমি বিচার করতে পারলাম না।’
‘এই ভাইয়া’
নাবিল পেছনে তাকিয়ে বললো,’যদি বলো ওয়াশরুমে যাবে তাও দিবনা।চুপচাপ বসে থাকো’
‘আচ্ছা আমি পালাবোনা।আমি একটু পানি খাব।পানির ব্যবস্থা করেন’
নাবিল ফেরত এসে চেয়ার টেনে ওর সামনে বসে দারোগাকে কিছু টাকা দিয়ে বলেছে পানি আনতে।
লিখি গাল ফুলিয়ে বললো,’আপনি পানি আনলে কি হতো?’
‘কি আর হতো।এই দারোগার মুখে চকমা দিয়ে তুমি পালাতে।তোমার স্বভাব আমার জানা আছে।
ঘুঘু দেখেছো,ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি!
আজ তোমায় আমি জেলের ভাত খাওয়াবো,পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচের সাথে।নাহলে আমার নাম!!’
‘রাক্ষস না!আচ্ছা আপনি কি পুলিশের কিছু হোন?আসলে এমন স্বভাব তো সাধারণ মানুষের হতে পারেনা।ফোন খোয়া গেলে মানুষ এক দুদিন কান্নাকাটি করে তারপর ভুলে যায়।আর আপনি ১ম দিন থেকে আমার পিছনে লেগে আছেন।যেন আমি মানুষ গুম করেছি’
চলবে♥