মনের মানুষ ❤️ পর্ব-২৯

0
1001

#মনের_মানুষ❤️
#উনত্রিংশ_পর্ব
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸
আহেলি জোর করে চোখদুটো খুলতেই বুঝলো আজ শরীরের অবস্থা অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা…..উঠে বসতে যেতেই মাথাটা বেশ ভারী অনুভূত হলো।নিজেই নিজের মাথায় হাত ঠেকিয়ে বুঝলো তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই …..কাল অফিস থেকে দুপুরে একটা জায়গায় পাঠানো হয়েছিলো আর ফেরার সময় হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামায় ভিজে গেছিলো আহেলি।আর তার ফলে আজকের এমন অবস্থা……শনি,রবি আর সোমবার পেরিয়ে আজ সপ্তাহের দ্বিতীয়দিন।এরম দিনে অফিস কামাই করা যায় না তবে আহেলির শরীরের যা অবস্থা তাতে ও কোনোভাবে আজ বাইরে বেরোতে পারবে না।কোনোরকমে উঠে আহেলি ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো বিছানায়…..থার্মোমিটার অব্দি নেই যে জ্বরটা চেক করবে।তবুও হাত দিয়েই বুঝলো ভালোরকম জ্বর বাঁধিয়েছে….ল্যাপটপে কোনোরকমে একটা সিক লিভ এপ্লিকেশন পাঠালো অফিসের ইমেল আইডিতে।তারপর আবারো শুয়ে পরলো বিছানায়…..অসহ্য গলায় ব্যাথার সাথে মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।এই মুহূর্তে এককাপ গরম চা খাওয়ার মন হতেও আহেলি সেটা তৈরি করার জন্য আর কিচেনে যেতে পারলো না…..উঠে বসে আবারো তলপেট আঁকড়ে শুয়ে পরলো।নিজের শহর থেকে দূরে অচেনা জায়গায় এই প্রথম আহেলি নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে…..চোখ থেকে কয়েকফোটা জল গড়িয়ে পরতেই আহেলি ফোনটা নিলো পাশের টেবিল থেকে।

🌸🌸🌸
সেই যে শেষবার শুক্রবার রাতে আহেলির সাথে কথা বলেছে প্রান্তিক তারপর আর ফোন করেনি….আহেলি কয়েকবার ফোন করলেও তা রিসিভ করেনি প্রান্তিক।হটাৎ করেই তীব্র অভিমান জমা হয়েছে….তবে আহেলির বাবা মায়ের কাছে ফোন করে ওনাদের খবর জানার সাথে সাথে আহেলির কথাটাও জিজ্ঞেস করে নিয়েছে কথার ফাঁকে।তার নাকি অফিসে এতটাই ব্যস্ততা যে রবিবার অব্দি কাজ করতে হয়েছে…..সেইজন্য প্রান্তিককে প্রথমে নিজে থেকে কল করলেও আর করেনি।ম্যাডাম এখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

প্রান্তিক বরাবরের মতোই বিকেলে ফাঁকা সময় পেতেই আহেলির মায়ের কাছে ফোন করলো….ওনার উদ্বিগ্ন গলা শুনে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আহেলির মা জানায় আজ সকাল থেকে আহেলির নাকি জ্বর…..কতটা অসুস্থ্যতা মুখে না বললেও সে যে ভালোই অসুস্থ্য সেটা গলা শুনেই বোঝা গেছে।আহেলি নাকি বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি…..কোনোরকমে জ্বরের ওষুধ আর খাওয়ার অর্ডার দিয়ে খেয়েছে।আহেলির বাবা মা যেতেও পারছে না এদিকে চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে।প্রান্তিক ওনাকে চিন্তা করতে বারন করলো…..সকাল থেকে ব্যস্ততার জন্য প্রান্তিক আহেলির সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি কিন্তু এবার ও সবটা দেখে নেবে বলতে আহেলির মা একটু শান্ত হলেন।তবে যতই হোক মায়ের মন….একে তো দূরে তারওপর অসুস্থ্য চিন্তা তো হবেই।

ফোন রেখেই প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো…..ওর এসিস্টেন্টকে ডেকে কিছু একটা বুঝিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পরলো হসপিটাল থেকে।
🌸🌸🌸

ওষুধ খেয়ে জ্বরটা কমলেও আহেলির শরীরে এমন কোনোপ্রকার ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই যে উঠে বসবে।ফুড এপ থেকে অর্ডার করা খাওয়ারগুলো পরেই আছে…..আহেলিও ক্লান্ত দেহে বালিশে পেট চেপে শুয়ে আছে।রাত প্রায় নটা বাজে…..আহেলি ঠোঁট চিপে শুয়ে আছে।শারীরিক কষ্টের সাথে তীব্র অভিমান মিশে গেছে….মায়ের কাছে জানার পরেও প্রান্তিক একবারও ওকে কল করলো না কথাটা ভাবতেই বেশ কান্না পাচ্ছে।একটু আগেই মাকে মিথ্যে সুস্থ্যতার কথা জানিয়েছে….তাছাড়া আর কি বলতো আহেলি?নাহলে মেয়ের চিন্তায় হয়তো দুটো মানুষের ঘুমই উড়ে যেতো।ওদিকে আরেকজনের তো কোনোপ্রকার হেলদোল নেই….আহেলি বাঁচুক মরুক তাতে তার কি আসে যায়।

আহেলির এসব ভাবনার মাঝেই ডোরবেল বেজে উঠলো….হয়তো দ্বিতীয় দফায় ওষুধ এসেছে এই ভেবে আহেলি উঠে দাঁড়ালো যাহোক করে।অসুস্থ্য শরীরটাকে কোনোমতে দরজা অব্দি টেনে নিয়ে গেলো…..তবে এতরাতে যদি কোনো বিপদ ঘটে যায় তখন আহেলি কিকরে প্রতিরোধ করবে?এসব উদ্ভট চিন্তার মধ্যে দরজাটা হালকা খুললো আহেলি….দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখেই আহেলি অবাক হলো।ডানহাতে চোখ কচলে আবার তাকাতে সেই একই মানুষ দেখে অস্ফুট স্বরে বললো,,,,

“তুমি?”

আহেলির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রান্তিক নিজেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।আহেলির কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলো সাথে সাথে…..আহেলি কিছু বলবে তার আগেই প্রান্তিক গম্ভীর গলায় বললো,,,,

“একটাও ওষুধ খাওয়া হয়নি?চলো ঘরে…”

আহেলি টলমলো পায়ে একটু এগিয়েই দেওয়াল ধরে দাঁড়ালো…..তৎক্ষনাৎ প্রান্তিক হাতের ব্যাগটা রেখে আহেলিকে কোলে তুলে নিলো।আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই প্রান্তিক সেই একইভাবে বললো,,,

“এতো জ্বর বাধিয়ে বসে আবার বলেছে নাকি উনি এখন সুস্থ্য….বাহঃ।দেখছি আমি কতটা সুস্থ্য তুমি।”

সোফায় আহেলি কে বসিয়ে নিজের ব্যাগটা ঘরে আনলো….ব্যাগ থেকে মেডিক্যাল বক্স বের করে আহেলির পাশে বসলো।প্রথমেই থার্মোমিটারে জ্বর চেক করে চিন্তিত সুরে বললো,,,,

“একশো তিন জ্বর!!ঠান্ডা লাগলো কিকরে?”

“ক-কাল অফিসের দ-দরকারে ব-বাইরে গেছিলাম।তখনই বৃষ্টিতে….”

“দারুন ব্যাপার….তোমার তো অল্পতেই ঠান্ডা লাগে তাও বৃষ্টিতে ভিজলে?এখন ভালোলাগছে তো?”

“তু-তুমি এখানে এলে যে?বাড়িতে জানে নাকি?”

“আমার মাথাটা কিন্তু সত্যিই গরম আহেলি….একটাও বাড়তি কথা বলবে না।সকাল থেকে কিছু খেয়েছো?”

প্রান্তিকের প্রশ্নে আহেলি দুদিকে মাথা নারাতেই প্রান্তিক দাঁতে দাঁত চিপে বললো,,,

“আর কি চাই?এভাবেই পরে থাকতে তাহলে তুমি আমি না এলে…..খাওনি কেনো?খালি পেটে ওষুধ খেলে কি হয় জানো?”

“খাবার অর্ডার করেও খেতে পারিনি….টেবিলে তো সবই পরে আছে।একদম মুখে তুলতেই পারিনি।একে তো জ্বর সর্দি আর সাথে আরেক জ্বালাতন।”

ভ্রূ কুঁচকে প্রান্তিক আহেলির দিকে তাকাতেই আহেলি মাথা নামিয়ে নিলো।প্রান্তিক বক্স থেকে দুটো ওষুধ আহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,,

“এগুলো খাওয়ার আগের ওষুধ খেয়ে নাও।আর তারপর বাথরুমে গিয়ে মুখে-চোখে জল দিয়ে এসো।আমি ততক্ষনে কি ব্যবস্থা করা যায় দেখি।”

আহেলি বাধা দিতে গিয়েও প্রান্তিকের রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো…..তৎক্ষনাৎ ওষুধগুলো খেয়ে একটু বসে ওয়াশরুমে গেলো।

চোখে-মুখে জল দিয়ে আহেলি যখন ঘরে ঢুকলো….তখন প্রান্তিক ঘরে নেই।এলোমেলো বিছানার কথা মাথায় আসিতেই সেদিকে কোনোরকমে গেলো আহেলি….সাথে সাথে অবাক হলো।এলোমেলো বিছানাটা একদম পরিপাটি করে গুছানো…পাশের টেবিলে থাকা খাওয়ারের কন্টেনার থেকে ওষুধের পাতা কিছুই নেই।এমনকি বিছানার চাদরটা অব্দি বদলে দেওয়া….চাদর বদলানোর কথা মাথায় আসতেই আহেলির মনে পড়লো চাঁদরে দেখা সকালের দাগটার কথা।বিছানায় বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো আহেলি……অবশেষে প্রান্তিকের কাছে এতটা লজ্জ্বায় পরতে হবে?!

ঘরে পায়ের শব্দ পেয়েই মুখ তুলে তাকালো আহেলি….প্রান্তিক পোশাক বদলে হাতে একটা ট্রে নিয়ে ঘরে এসেছে।ট্রেটা আহেলির সামনে বসাতেই দেখলো একবাটি স্যুপ….ওয়াশরুমে খানিকটা সময় লাগলেও প্রান্তিক এতকিছু করে ফেললো?

“কি হলো খাও…..কোনো বাহানা শুনবো না কিন্তু।এটা পুরোটা খাবে আর তারপরে ওষুধ।নয়তো এভাবেই কষ্ট পাবে।”

মুখের সামনে চামচ ধরে কথাটা বললো প্রান্তিক।আহেলিও বিনা বাক্য-ব্যায়ে স্যুপটা খেয়ে নিলো।পুরোটা না খাওয়ার জন্য প্রান্তিক বকাঝকা করতেই আহেলি বাচ্ছাদের মতো করে তাকাতে আরকিছু বললো না প্রান্তিক…..পরপর কয়েকটা ওষুধ খাইয়ে দিলো।

প্রান্তিক যখন সবশেষে আহেলির মাথার কাছে এসে বসলো তখন আহেলি ঘুমিয়ে পরেছে…..প্রান্তিক জ্বর চেক করে নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।আহেলি কুঁকড়ে শুয়ে আছে দেখে ওর গায়ে ভালো করে চাঁদর চাপা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো….খাটের হেডবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে প্রান্তিক আরো একবার তাকালো আহেলির মুখের দিকে।

মাঝরাতে গরম অনুভব হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো আহেলির….জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় ঘাম হচ্ছে।গা থেকে চাঁদর সরিয়ে পাশে তাকাতেই আহেলি দেখলো প্রান্তিক ওর পাশেই কোনোরকমে শুয়ে আছে…..ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে প্রান্তিকের মাথায় হাত রাখলো আহেলি।বেশ গভীর ঘুমে মগ্ন প্রান্তিক…..এই ছেলেটাই অবুঝের মতোন অভিমান করে ওর সাথে কথা বন্ধ রেখেছিলো আবার আহেলির অসুস্থতার খবর শোনা মাত্রই এখানে চলে এসেছে।কেমন সবটা নিজের হাতে সামলে আহেলিকে আগলে রেখেছে…..আহেলি উঠে বসে ফ্যানের সুইচ ওন করলো।একবার প্রান্তিকের মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে মৃদু হাসলো আহেলি তারপর বেশ বলপ্রয়োগ করে নিজের কাছাকাছি টেনে আনলো।দুজনের গায়ে ভালোকরে চাঁদরটা জড়িয়ে নিয়ে প্রান্তিকের মাথাটা বালিশে রাখলো…..তারপর নিজেও প্রান্তিকের পাশে শুয়ে পরলো।ঘরের হালকা আলোয় ঘুমন্ত প্রান্তিককে কিরকম অন্যরকম লাগছে…..এই ছেলেটা আহেলির জন্য এতটা ভাবে যে সব কাজ ফেলে চেন্নাই যাওয়ার দোহাই দিয়ে এখানে চলে এসেছে?

প্রান্তিকের বুকে মাথা রাখতেই ঘুমের ঘোরে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো….আহেলি মাথা উচিয়ে প্রান্তিকের গালে নিজের ঠোটজোড়া গভীরভাবে ছুইয়ে নিজেও উষ্ণ আর নিরাপদ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করলো।এই প্রথম প্রান্তিকের অনেকটা কাছে আহেলি….তবুও ওরমধ্যে কোনপ্রকার দ্বিধা নেই আছে কেবল একরাশ লজ্জ্বা।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here