মনের_অন্দরমহলে আনিশা_সাবিহা পর্ব ১০

মনের_অন্দরমহলে
আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০

আয়াশের কর্মকান্ড বিচলিত করে তুলল আমায়। হাত তুলে ইশারা করে উনাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললাম….
–“দেখুন, আপনি এটা করবেন না। এই পাগলামি করে কোনো লাভ নেই। আপনি ছুরিটা ফেলে দিন। আমরা তো বসেও কথা বলতে পারি তাই না?”

–“সেই। আমি তো শান্তভাবে বসে ধীরস্থিরভাবে সবটা করতে চাইছিলাম। তুমি আমায় ঠকালে কেন? কেন করলে এমনটা?” (চিৎকার দিয়ে)

–“ওকে। আই এম সরি। আর এমনটা হবে না। প্লিজ আপনি ফেলে দিয়ে শান্ত হন।”

আমার কথায় যেন আয়াশের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। চিৎকার দিয়ে পাগলের মতো বললেন……
–“মানুষ জীবনে সুযোগ একবারই পায়। তুমিও পেয়েছো। কাজে লাগাওনি। সবটা যখন শান্তভাবে হলো না তখন আমার মতো করেই হক। তোমায় আমি এভাবে হারাতে দিতে পারি না। যতই হোক, আয়াশ রায়হান এতো সহজে নিজের প্রিয় মানুষকে হারাতে পারে না। আমি শুধু একটাই কথা শুনতে চাই, তুমি বিয়ে করবে? হ্যাঁ কি না?”

–“মি. রায়হান, নিজের হাত থেকে ছুরিটা ফেলুন। আপনি এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন না। এতে আপনাকে এরেস্ট করতে বাধ্য হবো আমরা।”

পুলিশের কথায় হু হা একটা কথাও বললেন না আয়াশ। উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল। এতোক্ষণ চুপ থাকতে থাকতে মুখ খুললেন আয়াশের বাবা। অশান্ত হয়ে বললেন…..
–“হোয়াট ইট দিস আয়াশ? সিনক্রিয়েট কেন করছো? তুমি না এই বাড়ির ছেলে? এসব সিনক্রিয়েট তোমাকে মানায় না। তুমি চাইলে এর থেকে আরো অনেক ভালো মেয়েকে এনে দেব। এর জন্য নিজের ক্ষতি অন্তত করো না নিজের।”

–“হুঁশশ! আমার লাইফের সিদ্ধান্ত আমি একা নিতে জানি সাহাদ রায়হান। আমি অন্য কোনো মেয়ে চাই না। আই ওয়ান্ট দিস গার্ল! যদি আমার এতোই ভালো চান তাহলে বলুন ওকে এই মূহুর্তে যেন আমায় বিয়ে করে।”

আয়াশের একরোখা মনোভাব। পুলিশের লোকেরা চেয়েও কিছু করতে পারছেন না। বার বার হুমকি দিলে আয়াশ উল্টে তাদের হুমকি দিয়ে চলেছে। একসময় আমার ডান হাত আবদ্ধ করে একটা ছোট্ট হাতের মালিক তুষার। আমার হাত ঝাঁকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলে…..
–“আপু, জিজুর হাত থেকে রক্ত পড়ছে।”

দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। মা আমাকে চেপে ধরেছে। আমার কানে কানে বলল…..
–“এমন পাগল ছেলেকে বিয়ে করার কোনো দরকার নেই। তুই যখন পুলিশ ডেকেছিস তখন ওদের সাহায্য নিয়ে চল এখান থেকে যাই। এবার বুঝতে পারছি কতবড় ভুল করে ফেলেছি।”

–“কিন্তু মা উনি যদি কিছু করে বসেন? তাহলে তো এর জন্য দায়ি আমি হবো তাই না?”

বিভ্রান্ত হয়ে বললাম আমি। মা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল…..
–“তুই এখনো এই ছেলের ব্যাপারে ভাবছিস?”

আমার ভাবনায় টনক নড়ে। এতোকিছুর পরেও অজান্তেই উনার কথা ভাবতে হচ্ছে আমায়। বলা বাহুল্য, উনার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যেন।
–“কি হলো? বলো আমায় বিয়ে করবে না?”

হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করলেন আয়াশ। হঠাৎ আমার সামনে কারো উপস্থিতি টের পাই আমি। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। আমায় অবাক করে দিয়ে আয়াশের বাবা অনুনয়ের সুরে বলে ওঠেন….
–“দেখো, হয়ত তুমি বিয়ে করতে চাও না। কিন্তু বাবা হিসেবে আমি তোমার কাছে একটা রিকুয়েষ্ট করছি। আয়াশকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও প্লিজ! আমার মনে হচ্ছে না আয়াশকে থামানোর আর কোনো রাস্তা আছে। ও নিজের ক্ষতি করতে দুইবার ভাববে না। ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে অনর্থ ঘটে যাবে এই পরিবারে।”

দোটানায় ভুগতে থাকলাম আমি। আমার বিয়ে করা আর না করাতে আয়াশের প্রাণ নির্ভর করছে। আর যাই হোক উনার ভয়াবহতার প্রমাণ আমি এর আগেও দেখেছি। একবার হাতের শিরা কেটে গেলে সবটা শেষ হয়ে যাবে আমার সামনে। অতিরিক্ত মাথায় চাপ পড়ছে আমার। মাথাটা ব্যাথা করতে শুরু করে দিয়েছে। এরইমাঝে ফুলকি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল…..
–“আরে স্যারের হাত থেকে রক্ত বের হইতেছে। স্যার আস্তে আস্তে ছুরি নিজের হাতে চাপ দিয়ে ধরতেছে। কেউ কিছু করেন।”

মাথা আর কাজ করছে না। কপালের দুইধারে হাত দিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে এক চিৎকারে বললাম…..
–“বিয়েটা আমি করব। এমন কিছু করবেন না আয়াশ দোহাই লাগে।”

–“সত্যি?”
আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠেন আয়াশ। সকলেই আমার সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত হয়েছে সেটা জানি। মা আমার হাত চেপে ধরল সঙ্গে সঙ্গে। আমায় চাপা সুরে প্রশ্ন করল…..
–“তুই কি পাগল হলি আনিশা? ওর সঙ্গে আমি তোর বিয়ে দিতে দিব না। এখনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি।”

–“মা তোমার কি মনে হয় না যে পুলিশও এখন হতভম্ব হয়ে রয়েছেন? উনাদের করার মতো কিছুই নেই? আয়াশ চাইলেই ওদের টাকা খাইয়ে চুপ করিয়ে দিতে পারবে মা। মূলকথা, আয়াশ তো একজন আইনজীবী কিনা!”

–“কিন্তু….. ”

মাকে থামিয়ে দিলাম আমি। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম…..
–“ভরসা রাখো। তোমার মেয়ের কিছু হবে না। এখন যদি বিয়েটা না করি এর প্রভাব শুধু আয়াশের ওপর নয় আমাদের সকলের ওপর পড়তে পারে। আয়াশের কিছু হলে উনার বাবা উল্টে যদি আমাদের বিরুদ্ধে কেস করে দেয় তাহলে কিন্তু অনেক বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। তুমি বোঝার চেষ্টা করো আর চুপ থাকো।”

বলেই সরে এলাম আমি। কান সজাগ করে বললাম….
–“আয়াশ? আপনি কি হাত থেকে ছুরিটা ফেলেছেন? ফেলে দিন। আর এখানে আসুন। শান্ত হয়ে বসুন।”

–“তুমি যদি মত পাল্টে ফেলো? তখন? আমি ছুরি ফেলব না। তুমি বরণ আগে বিয়েটা করে নাও তারপর ফেলব। গুড গার্লের মতো বিয়েটা করে নাও।”

–“আমি বললাম তো বিয়েটা করব। তবে একটা শর্ত আছে। আমি শুধু কাবিন করে রাখতে চাই। একেবারে ধর্মীয় মতে বিয়েটা করতে চাই না। এটা তখনই হবে যেদিন আমার ১৮ বছর পূর্ণ হবে। আপনি জানেন আমার বয়স।”

আয়াশ চুপ করে গেলেন। চট করে আবার রাগ নিয়ে বলে উঠলেন…..
–“তার মানে তুমি আমায় বিয়ে করবে না? তাই তো?”

–“কখন বললাম এটা? কাবিন করব তো! কিন্তু ধর্মীয় ভাবে বিয়ে না করায় সংসার করতে পারব না আমরা। তবে আমরা অবশ্যই বিবাহিত হবো। আমি আপনার স্ত্রী হবো লিগ্যালি। কিন্তু ধর্মীয়ভাবে নয়। এসব বিষয়ে বিষয়ে আমার থেকে তো আপনি বেশি জানেন। আপনি ভেবে দেখুন। আমরা যদি এভাবে বিয়ে করি তাহলে লোকে কি বলবে? আমার থেকে আপনার বেশি রেপুটেশন নষ্ট হবে।”

আমার কথায় হয়ত কনফিউজড হয়ে পড়েছেন আয়াশ। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকার পরে আচমকা উনি পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন…..
–“আপনারা এখনো দাঁড়িয়ে কি করছেন? আনিশা বলেছে না? ও বিয়েটা করতে রাজি। তাও এখনো কি করছেন? চলে যান।”

–“কিন্তু আপনি এটা ঠিক করেননি মি. রায়হান! ওই মেয়েটি চাইলে আপনার বিরুদ্ধে এফআইআর করতেই পারে। এখন যদি উনি চান তবেই আমরা যাব।”

আয়াশ হয়ত পুলিশকে আরো কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিল তার আগেই আমি পরিস্থিতি সামলাতে শান্ত হয়ে বললাম….
–“তার আর কোনো দরকার নেই। আপনি আসুন।”

–“উঁহু না। চাইলে উনারা বিয়েতে উপস্থিতও থাকতে পারে। আমারও সাক্ষী লাগবে। আর পুলিশের থেকে বড় সাক্ষী কে হতে পারে। এম আই রাইট পুলিশ অফিসার? যখন বিনা দাওয়াতে চলেই এসেছেন তখন বিয়েতে উপস্থিত থেকেই যান।”

অবশেষে আয়াশের জেদই জিতে গেল। কারো কোনোরকম জারিজুরি খাটলো না উনার ওপর। উনি আমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। একটা কাগজ দেখিয়ে দেওয়া হলো আমায়। সাইন করতে বলা হলো সেখানে। নিজের সব চেষ্টা পানিতে পড়ে গেল আমার। অদম্য মনোবল নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করে দিতে হলো সেখানে। ব্যাস….বিবাহিত নামক ট্যাগ লেগে গেল আমার সঙ্গে। তবে শর্ত একটাই ধর্মীয়ভাবে কোনো অনুমতি পাইনি আমরা। পেলেও বা কি? শেষমেশ আয়াশকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে হবে আমায়। এখনো মন একটা ভাবনাতেই পড়ে রয়েছে যাকে আয়াশ দয়া করেন তাকে বিয়ে করার জন্য এতো বড় স্টেপ কেন নেবেন? এই তবে ছিল আমার নিয়তি??

দুপুর হয়ে এসেছে। আমি মায়ের কোলে শুয়ে আছি। চুলগুলো আমার ভিজে। আমার ভিজে চুল নেড়ে দিচ্ছে মা। মনটা আমার বিষন্ন। সেই বিষন্ন মনটাকে আঘাত হেনে মা বলে বসল…..
–“এটা তুই কেমন সিদ্ধান্ত নিলি বল তো? তোকে এখানে কিভাবে রেখে যাব? তোর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি? আয়াশের প্রতি কি তুই দুর্বল?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মায়ের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলাম। আসলে মায়ের প্রশ্নের উত্তর আমার নিজেরই জানা নেই। মাকে উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পাচ্ছিও না। মা আমার মাথা ধরে নাড়া দিতেই খেয়াল হলো আমার।
–“মা আজ আয়াশ বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছিলেন। বাধ্য হয়েছি আমি একপ্রকার। এর চেয়ে বেশি কিছুই নয়।”

–“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তুই কি আয়াশের প্রতি দুর্বল?”

–“এসব কেমন প্রশ্ন? আমার ভালো লাগছে না কথা বলতে। এখন উনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি না থাকলেও ভবিষ্যতে উনার সঙ্গেই আমার সংসার করতে হবে। অনুভূতি তৈরি হলে খারাপ কি?”

–“খারাপ নয়? তাহলে নীলাদ্রের কি হবে?”
মায়ের থমথমে গলা শুনে উঠে বসলাম আমি। হঠাৎ করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম…..
–“ওর কথা বলছো যে? যখন ওকে চেয়েছিলাম তখন তো সায় দাওনি। যাকে আজ তুমি পাগল বলে সম্মোধন করছো তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমরা উঠেপড়ে লেগেছিলে। ওর কথা বলেও কি আর কোনো লাভ আছে?”

মা তাৎক্ষণিক ডুকরে কেঁদে উঠলেন। চমকে উঠলাম আমি। মা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও আগলে নিতেই মা কাঁদতে কাঁদতে বলল….
–“আমায় ক্ষমা করে দে আনিশা। আমাদের দোষেই তোকে আজ ভুগতে হচ্ছে। সকলে বলে মা-বাবা সন্তানের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিতেই পারে না। কিন্তু আজ বুঝছি মা-বাবাও ভুল সিদ্ধান্ত নেয় যার কারণে সন্তানের জীবন তছনছ হয়ে যেতে পারে। আজ তাই হচ্ছে। আমায় ক্ষমা কর তুই।”

–“মা, এভাবে বলতে নেই। হয়ত ভুল একটা হয়েছে। ভুল তো মানুষ মাত্র হয় তাই না? ভুলটাকে শুধরে নেওয়া যায় না?”

মা সরে বসল। আমার বাহু ধরে আগ্রহ নিয়ে বলল….
–“কিভাবে শুধরবো এই ভুল? বল?”
–“বিয়ে হওয়ার ভুল তো শুধরে নেওয়া যাবে না। আয়াশ যদি কখনো শুধরে যান? তাহলে কেমন হবে মা?”

–“ও শুধরাবে? কি করে? মনগড়া কি কথা বলছিস?”
–“জানি না। তবে কোথাও একটা কিছু আছে। যা আয়াশ কাউকে বলে না। নিজের মাঝে সবসময় গোপন। এতোদিনে আমি এতটুকু বুঝেছি যে ছোটবেলায় উনি নিজের মাকে হারানোর পর যেসব ভুল ধারণা নিজের মনে গড়েছেন সেসব ভুল ধারণায় উনাকে এমন করে রেখেছে। যদি ওসব কোনোভাবে কাটানো যেতো তাহলে হয়তবা উনার মাঝে পরিবর্তন ঘটতো!”

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। জানি না ভাগ্য আবার আমায় কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা সত্যি নাকি মিথ্যে?

দুপুরে খেয়েদেয়ে আমারও বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে মা-বাবা আর তুষার। আমায় ওরা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আয়াশের ফের জেদের জন্য সফল হয়নি। উনি হুটহাট করে রেগে যাচ্ছেন। উনার রাগ সামলাতে আমিও যাওয়ার জন্য জেদ করিনি। পরিস্থিতি যত অনুকূলে থাকবে ততই ভালো!

বেলকনিতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। পিহুকে এখানেই এনে রেখেছি। পিহু বার বার ডেকে চলেছে একাধারে। একটা সময় বললাম….
–“এই পিহু? জানিস আমার বিয়ে হয়েছে।”

–“পিহু পি…..হু!”

–“অন্যকিছুও তো বলতে শিখ। সারাদিন নিজের নাম বলতে ক্লান্ত হয়ে যাস না? আচ্ছা শোন তোর কি মনে হয়? আয়াশ কেমন? মন থেকে উনি কেমন?”

পিহুর আর কোনো উত্তর এলো না । তাতে মুখ ফুলিয়ে ভেংচি কাটলাম আমি। তৎক্ষনাৎ কোমড়ে পেলাম কারো ঠান্ডা স্পর্শ। কাঁধে পড়ল কারো গরম নিঃশ্বাস। শরীর যেন অবশ হয়ে এলো আমার।

চলবে…….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here