মনের_অন্দরমহলে পর্ব ২৩

মনের_অন্দরমহলে পর্ব ২৩
#আনিশা_সাবিহা

–“আমাদের এখানে কেন আনা হয়েছে? কি করেছি আমরা? বিনা অপরাধে অযথা পুলিশ কাস্টারিতে ধরে আনার মানে কি?”

পুলিশ কাস্টারির ভেতরে থাকা চারজন ছেলের মাঝে একজন কথাটি সাহস করে বলেই উঠল অবশেষে। চারজনই চেয়ারে বসে জুবুথুবু হয়ে রয়েছে। তারা কিছুটা ভয়েই রয়েছে। তাদের ঠিক বিপরীত দিকে বসে আছে আয়াশ। ডান হাত টেবিলের ওপর রেখে একের পর এক টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে বাড়ি দিয়ে ওদের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

–“আমি আয়াশ রায়হান। তোদের মার্ডারের চার্জ দিয়েছি। যার কারণে তোরা এখন জেলে।”

আয়াশের গম্ভীর কন্ঠ শোনামাত্রই চারজনই কেঁপে ওঠে। আয়াশকে যে তারা চেনে না এমনটা নয়। চেনে বলেই বেশি করে ভয় পাচ্ছে। আজ পর্যন্ত যাকে কেসে হারানো সম্ভব হয়নি সে নিজেই যদি মার্ডার চার্জ দেয় তাহলে তাদের ছাড়া পাওয়া বড়ই মুশকিল হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে একজন জোরে বলে ওঠে…..
–“এসব মিথ্যা চার্জ কেন দিচ্ছেন? আমরা মার্ডার করব কেন? আপনি মিথ্যা অভিযোগ তুলতে পারেন না।”

–“আমি সব পারি। নিজের আর আমার খুব প্রিয় মানুষের জন্য যতটা নিচে নামতে হয় ততটাও নিচে নামতে পারি। আমার মাঝে কোনো আফসোস কাজ করবে না। তাছাড়া আমি তোদের ওপর কোনো মিথ্যে অভিযোগ করিনি। আমার কাছে ভিকটিম রয়েছে। ও সাক্ষী দিতে পারে। তারপর তোদের কি হবে?”

বেশ শান্ত কন্ঠে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেল আয়াশ। তার মাঝে কোনো তাড়াহুড়ো বা হেলদোল নেই। সে এমনভাবে বসে আছে যেন কিছু হয়নি।

–“কিন্তু আমরা তো কাউকে মার্ডার করিনি।”

একে ওপরের দিকে তাকাতাকি করে বলে উঠল ছেলেগুলো। তা জবাবে আয়াশ বুকে দুইহাত গুঁজে বলে…..
–“চেষ্টা করেছিস। এটা প্রায় আড়াই বছরের আগের কেস। যেটা আমি রিওপেন করব।”

ছেলেগুলো সকলে চুপ হয়ে যায়। আয়াশ থুঁতনি বুলাতে বুলাতে পর্যবেক্ষণ করে সবাইকে। ছেলেগুলো মনে করার চেষ্টা করছে কাকে মারার চেষ্টা করেছে ওরা। তখনই পুলিশ অফিসারের আগমন ঘটে কাস্টারির ভেতরে। ছেলেগুলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ওঠেন…..

–“তোদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছিল আনিশা সাবিহা নামের একজন মেয়ে। যার কারণে তোরা মারার চেষ্টা করেছিলি। এখন মনে পড়ছে নাকি দেব কয়েকটা?”

শেষ কথাগুলো হুমকি দিয়ে বলেন পুলিশ অফিসার। ছেলেগুলো কেঁপে ওঠে ভয়ে। তাদের মনে পড়েছে। তবুও তারা দমে না।
–“স্যার আমরা মেরেছি এটার কোনো প্রমাণ নেই। আর এটা মিথ্যে অভিযোগ। যদি আমরা মারার-ই চেষ্টা করতাম তাহলে ওই মেয়েটা সেদিন অভিযোগ করেনি কেন? এতো দিন পর কেন এসব কথা উঠল।”

–“অভিযোগ করেনি কারণ তখন তোদের মতো জানোয়ার ছেলেদের সঙ্গে লড়াই করার মতো ক্ষমতা ওদের ছিলই না। ওরা ভয় পেয়ে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু তারা ছাড়লেও এই বিষয়টা আমি ছাড়ছি না। আর প্রমাণের কথা বলছিস? তাহলে সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে। কোর্টে প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার। আর অফিসার! আপনি বাইরে যান। লইয়ার হিসেবে আমি একান্ত কথা বলতে চাই। আই থিংক আপনি বুঝছেন যে আমি কি বলতে চাইছি?”

অফিসার মাথা নাড়িয়ে দ্রুত গতিতে বাইরে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে সকলে আয়াশের মুখের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে। এই লোকটার থেকে ছাড়া পাওয়ার উপায় কি? তারা সকলে নিজেদের ইশারা করে হুট করে হাতজোড় করে বসে।

–“ও স্যার! ভুল হয়ে গেছে। আমরা শুধু যেতে চাই। আমরা দিব্যি কেটে বলছি কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবোও না। শুধু এসব কেসে ফাঁসাবেন না।”

বেশ স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো শুনল আয়াশ। সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল সে। যেন ছেলেগুলো কোনো মজার কথা বলেছে।
–“ও মাই গড! তোরা দিব্যিও করিস? কিন্তু রাখিস না। যখন এসব ঝামেলা জড়ানোর ইচ্ছা নেই তো চল তোদের একটা বেটার অপশন দিচ্ছি। অপশন এই একটাই। যদি রাজি থাকিস সকলে এখান থেকে ছাড়া পাবে।”

ছেলেগুলো যেন আশার আলো পায়। হম্বিতম্বি করে বলে…..
–“ক….কি অপশন? যেকোনো অপশন মানতে রাজি স্যার।”

–“তোদের চার জনের মধ্যে সবাইকে অন্ধ হতে হবে। আই মিন চোখ ডোনেট করতে হবে।”

চেয়ারে বসে থাকা চারজনই চমকে উঠল। তাদের চোখ কপালে উঠে গেল। আয়াশ কথাগুলো এতটাই স্বাভাবিক ভাবে বলেছে যে কাজটা খুব সোজা! সকলে নিজেদের চোখে হাত বুলিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠল…..
–“কখনোই না। আপনি কি পাগল নাকি? চোখ হারিয়ে অন্ধ হয়ে থাকব নাকি? তার থেকে তো ভালো সারাজীবন জেল খাটা।”

আয়াশ মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়।
–“জেল নয় ফাঁসি! ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলিয়ে দেব।”

–“ফাঁসি কি করে? মার্ডার করলে তো যাবত জীবন জেল হয়। অযথা ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না।”

–“আমি হাওয়ায় কথা উড়াই না। তোরা যেহেতু একটা মেয়েকে মারার চেষ্টা চালাতে পেরেছিস নিশ্চয় আরো কিছু কেসও আছে তোদের নামে। সেসব মিলিয়ে আরো না হয় কয়েকটা কেস যোগ করলাম। আর তোরা আরো অনেক অনৈতিক কাজ যেমন ড্রাগ পেডলারদের সাহায্য নিশ্চয় করিস। এটা তোদের পক্ষে অসম্ভব কিছুই না। সব মিলিয়ে এমন প্যাঁচ লাগাবো তোদের ফাঁসিতে উঠতে হবে। এমন অনেক লোক আছে যাদের আমি ফাঁসিতে এভাবেই ঝুলিয়েছি। তোদের ঝুলানো কোনো ব্যাপার না। এখন বল তোরা কোনটা চাস? চোখ নাকি প্রাণ?”

সকলের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে সেটা তাদের চেহারাতেই ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। বড্ড আকুতি মিনতি করেও আয়াশের মন গলাতে সক্ষম হলো না কেউ। তাদের ক্ষমা চাওয়ার কথাবার্তা শুনে বিরক্ত হয়ে পড়ল আয়াশ। চেয়ার থেকে উঠে পড়ল সে।
–“দেখা হবে কোর্টে!”

পেছন ঘুরে একপা বাড়াতেই তার ডাক পড়ল। আয়াশ জানে তারা ডাকবে। ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকায় সে। তৎক্ষনাৎ ওরা হাতজোড় করে বলে ওঠে….
–“চোখ আমরা দিতে রাজি। কিন্তু প্রাণ নিয়েন না। কিন্তু আমাদের পরিবারের কি হবে?”

–“নাথিং! বরণ তোরা অন্ধ হলে ওরা গর্ববোধ করবে। বিকজ তোদের নোংরা চোখ দিয়ে আর কেউ ধর্ষিত হবে না। ওরা মানসিক প্রশান্ত লাভ করবে। ভরণপোষণ? সেটা নাহয় আমিই দেখে নেব। নো প্রবলেম।”

ছেলেগুলো প্রায় কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। আয়াশের দয়া হচ্ছে না তাদের দেখে বরং খুব আনন্দ হচ্ছে তার। কিন্তু তার একটাই চিন্তা ওদের মধ্যে কারো আই ম্যাচ করবে তো আনিশার সঙ্গে? যদি করে যায় তবে তো কথায় নেই। আর বাকি ডোনেট করা চোখ আয়াশ অন্ধ ছেলেমেয়েদের জন্য হসপিটালে দিয়ে দেবে।

–“আমি কাল আমার এসিস্ট্যান্টের হাতে বন্ড পেপার এনে দেব। সই করে দিলেই অপারেশন শুরু হবে। আর আজকে তোরা ছাড়া পাচ্ছিস না। একেবারে অপারেশনের দিন ছাড়া পাবি।”

বলেই ঘাড় ফিরিয়ে বেরিয়ে আসে আয়াশ। বাড়িতে যাবে। তার মনটা ছটফট করছে। তার নিশাপাখিকে দেখার তৃষ্ণা জেগেছে। তৃষ্ণা না মিটলে ছটফট করতে থাকবে তার মন।

কোনদিকে পা বাড়াব বুঝতেই পারছি না। চলতে চলতে পা থেমে গিয়েছে এক জঙ্গলে। দৃষ্টিহীন মেয়ে আর কতদূর যেতে পারে? ড্রাইভার নামক লোকটা আমায় কোথায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন সেটা বোধগম্য হচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে পাথরের সঙ্গে পা লেগে প্রচন্ড জোরে আঘাত পেয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। মুখ থেকে কাতর সুরে বেরিয়ে এলো…..
–“আয়াশ…..!”

কুকিয়ে উঠে বসলাম আমি। শরীরটা বোধহয় ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে। আসলে এখানে চারিদিকে গাছ। সেই হিসেবে মনে হচ্ছে এটা ঘন জঙ্গল। হাতের কনুইয়ে হাত দিতেই চোখমুখ জড়িয়ে এলো আমার। মনে হচ্ছে কেটে গিয়েছে জায়গাটা। এক পর্যায়ে চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল। অস্ফুটস্বরে আয়াশকে ডাকলাম আমি। এই মূহুর্তে মনটা উনাকেই চাইছে যেন উনি থাকলে আমায় কোনো বিপদ ছুঁতে পারবেই না! উনি নেই বলেই এতো বিপদ হয়ে চলেছে আমার।

–“আয়াশ আপনি কোথায়? এখানে চলে আসুন প্লিজ!”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। এখন মনে হচ্ছে আয়াশই এসব করেছেন। কারণ ড্রাইভার তো উনার নামই বলেছিলেন। কিন্তু কেন আমার সঙ্গে এমনটা করলেন? তবে কি উনি আমায় আর পছন্দ করেন না? সব মোহ কেটেছে আয়াশের? বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে মনটাকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ালাম অনেকটা কষ্টে। খুব কষ্ট হচ্ছে দাঁড়াতে। হাঁটুতেও আঘাত পেয়েছি বেশ।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে এলো গাড়ির শব্দ। মনে হলো সামনেই কোনো রাস্তা আছে। দেরি না করে ছুটলাম সেদিকে। মিনিট দশেক হাঁটতেই গাড়ির আওয়াজ প্রগাঢ় হলো। একসময় পিচঢালা রাস্তায় এসে পৌঁছালাম আমি। গাড়ি চলার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কোনদিকে যাব? আমি তো বুঝতেই পারছি না যে রাস্তার সাইডে নাকি মাঝে দাঁড়িয়ে আছি!

–“এই আপা, সরেন সরেন। মেইন রোড থেকে সরেন। আরে চোখে দেখেন না?”
কথাগুলো কানে আসা মাত্রই চমকে উঠলাম। একটা পুরুষের গলা। লাগাতার হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। কিছু বুঝে উঠে সরে দাঁড়ানোর আগেই গাড়ির ধাক্কা লেগে পড়ে গেলাম মাটিতে। মাথা গিয়ে ঠুকে গেল পাকা রাস্তায়। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। কপালে বাম সাইডে অসম্ভব জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে এই মূহুর্তে। চোখটা বুঁজে আসছে আমার। শুধু কানে এলো চেঁচামেচির আওয়াজ। তাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।

পিটপিট করে চোখ মেললাম আমি। আশেপাশে অন্ধকার। সেটাই হওয়ার কথা। সারা শরীরে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলাম। বিশেষ করে কপালের বাম দিকে। সেখানে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম সেখানে ব্যান্ডেজ লাগানো। আশেপাশে নিস্তব্ধতা! এরই মাঝে একটা মেয়ের মিষ্টি কন্ঠ শুনতে পেলাম।

–“ওমা! তোমার জ্ঞান ফিরেছে? কেমন লাগছে এখন?”

–“কে আপনি?”

–” প্রথমত আমায় তুমি করে বলবা। আমি এতোটাও বুড়ি নই যে আপনি বলতে হবে। আমি মেয়ে আই মিন আমি মৃধা। মনে পড়ছে রাস্তায় ওইযে এক্সিডেন্ট করেছিলে?”

আমি মাথা দুলাতেই আমার মাথায় হাত রাখে মেয়েটা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সে। যেন আমায় সে খুব ভালোভাবে চিনে।
–“আমি তো ওই বাইকওয়ালাকে খুব ঝেড়ে দিয়েছি। কত বড় সাহস! এরা যখন তখন এক্সিডেন্ট করে বসে জানো তো? যেমন আজ তোমার সঙ্গেও করে বসল।”

মৃধার কথায় আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বললাম…..
–“বাইক ওয়ালা লোকটার কোনো দোষ ছিল না। দোষটা আমার। আমি দেখতে পাইনি তাই আর লোকটা তো আর জানতো না আমি অন্ধ! তাই না বুঝেই এক্সিডেন্ট করে ফেলেছে।”

মৃধা অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠল…..
–“কিহহ? তুমি দেখতে পাও না? আই এম সরি!”

–“সরি তো ওই বাইক ওয়ালাকে বলা উচিত তাই না?”

–“আরে হ্যাঁ। কিন্তু উনাকে কোথায় পাব আমি! উফফ….মৃধা? তুইও না একটা পাগল। জীবন ভাইয়া ঠিকই বলে। ধুর।”
মৃধার অসহায় ভঙ্গিতে কথা শুনে হাসি পেলো আমার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হেসেও দিলাম। মেয়েটা ভারি মজার।

চলবে…….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here