মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৯
#আনিশা_সাবিহা
–“তুমি এমন কেন? আমাকে না বলে চলে এলে নিজের হবু বরের সঙ্গে। আমি তোমায় সারাদিন জ্বালাই বলে এভাবে প্রতিশোধ নিবে?”
তুষারের মিষ্টি কন্ঠে কিছুক্ষণের জন্য যেন কষ্ট অপসারণ হয়ে এলো। নাক টেনে ওর হাত ধরে কাছে নিয়ে এসে বেডে বসালাম। অসহায় কন্ঠে বললাম…..
–“বিশ্বাস কর, আমি এখানে নিজ ইচ্ছায় আসিনি। ওইযে আয়াশ আছে না? আমায় জোর করে নিয়ে এসেছে।”
–“নিয়ে আসলেই আসবে কেন? পালিয়ে আসবে আমাদের কাছে। জানো তো? ওই আয়াশ জিজু আমার সঙ্গে খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিল তোমার বিয়ের দিন। কিন্তু তুমি যেই পালিয়ে গেলে তখনই কত রেগে রেগে কথা বলছিল। বুঝতেই পারলাম না উনি ভালো না খারাপ।”
–“আমি এতদিন উনাকে কাছ থেকে দেখেও বুঝতে পারলাম না আর তুই একদিনে কি করে বুঝবি বল তো তুষার? এটা সত্যিই ভাবার বিষয় যে একটা মানুষের দুটো পার্সোনালিটি কি করে হতে পারে?”
–“পার্সোনালিটি মানে কি আপু?”
তুষারের প্রশ্নে হেসে উত্তর দিয়ে বললাম….
–“ব্যক্তিত্ব! তুই এসব বুঝবি না। বাদ দে। এখন বল তোরা কখন এলি? আর মা-বাবা? ওরা কোথায়?”
–“ওরা তো নিচে। আমি তোমার জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।”
ভ্রু কুঁচকালাম আমি। একটু ভেবে বললাম…..
–“কি?”
তুষার জোরে জোরে ডেকে উঠল…..
–“পিহু! এই পিহু!”
আমার টিয়াপাখি পিহু নিজ ছন্দে শব্দ করে উঠল। আমার হাসি প্রসারিত হলো। পিহুকে কতদিন দেখা হয় না। ওর সঙ্গে কথা বলা হয় না। আমি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললাম…..
–“পিহুকে এনেছিস? পিহু?”
আমার ডাকে সাড়া দেয় পিহু। ও নিজের নাম ছাড়া কিছুই বলতে জানে না। সারাদিন নিজের নাম উচ্চারণ করে। তুষারের কথায় ওর দিকে মন দিই আমি।
–“হু এনেছি তো। জিজু বলল যে পিহুকে আনতে তোমার জন্য।”
আয়াশের নাম শুনে মুখটা মলিন হয়ে হলো আমার সঙ্গে খানিকটা অবাকও হলাম। হতবিহ্বল হয়ে বললাম…..
–“আয়াশ? উনি কি করে জানলেন পিহুর কথা?”
–“তোমার ওই বিয়ের দিন জিজুর সঙ্গে অনেক গল্প করেছি তখন বলেছিলাম পিহুর কথা।”
–“ওহ।”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। কথাটুকুও বলার শক্তি পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ আগে আয়াশের বলা কথাগুলো মাথা খারাপ করে দিচ্ছে আমার। ভাবতে ভাবতে চারিপাশটা বিষাক্ত লাগছে। আমি খুব করে চাইছি আয়াশ নামক ব্যক্তিটা আমার সামনে আর না আসুক।
এতটুকু ভাবতে ভাবতেই যেটা চাইছি না সেটাই হলো। ভেসে এলো এক স্বচ্ছ মিষ্টি গলা।
–“তুষার!! বোনকে পেয়েই একেবারে গল্পের আসর বসিয়েছো? আমার সঙ্গে গল্প করবে না?”
উনার কন্ঠ শুনে ঢক গিলে তুষারকে চেপে ধরে বসলাম। তুষার একটু ভয় পেয়ে বলে উঠল…..
–“আপনি যদি আবার রেগে যান সেদিনের মতো?”
আয়াশ হাসেন। উনার হাসির শব্দটা চমৎকার। মাঝে মাঝে নিজের চোখ দিয়ে উনাকে দেখার ইচ্ছে জাগে। কথাবার্তা বলার অঙ্গিভঙ্গি যার অসাধারণ দেখতেও হয়ত অসাধারণই হবেন।
–“সেদিন তোমার বোন পালিয়ে গেছিল বলে রেগে গিয়েছিলাম। আজ তো সেই স্কোপ নেই। সুতরাং রেগেও যাচ্ছি না।”
আয়াশের কথায় হালকা চোখ ছোট করলাম। কথাগুলো আমাকে ঠেস মেরে বললেন সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। আজ যে পালিয়ে যাওয়ার থেকেও ভয়ানক কিছু ঘটাতে চলেছি সেটা আয়াশের আন্দাজের বাহিরে। উনি আবারও তুষারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন…..
–“তুষার? একটু পর তোমার আপুর বিয়ে। ওকে রেডি হতে দিবে না?”
–“হ্যাঁ তো আমি যাচ্ছি। আপু? আমি তোমার পিহুকে নিচে রেখে দিলাম। আর যাচ্ছি। তুমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চলে এসো।”
আমার কোনোরকম কথা না শুনে বাইরে দৌড় দিল তুষার। আমি ঘরে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। কারণ এখনো আয়াশ ঘরেই আছেন। উনার প্রতি রাগ লাগছে আমার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকায় উনি আমার হাত ধরে বললেন….
–“এখনো বসে আছো? অবশ্য তুমি একা তো শাড়ি পড়ে রেডি হতে পারবে না। আমি ফুলকি কে পাঠাচ্ছি। আই এম ওয়েটিং ফর ইউ।”
–“কেন করছেন এইসব? কি লাভ?”
থমথমে গলায় প্রশ্নটা এবার করেই ফেললাম আমি। আমি আর এই দ্বন্দ্ব নিয়ে থাকতে পারছি না। ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। দয়া বিষয়টা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আয়াশ আমার প্রশ্নে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বললেন…..
–“কাল রাতে আমার সকল অনুভূতি উজাড় করে দেওয়ার পরেও এই প্রশ্নটা কি করে করতে পারছো তুমি? আমি মানছি তুমি ছোট। কিন্তু এতোটাও ছোট নও যে অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”
–“আপনি একজন মানুষ মনে হয় যার প্রাণ একটি কিন্তু অস্তিত্ব দুইটি। যার শরীর একটা কিন্তু পার্সোনালিটি দুটো। একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এতো এতো কনফিউশান আপনার পার্সোনালিটি তৈরি করছে আমার মনে।”
আয়াশ আমার প্রতিত্তোরে শুধু বড় বড় শ্বাস নিলেন। মনে হচ্ছে উনি নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টায় আছেন। রেগে যাচ্ছেন। তাতে আমার কি? রাগলেই যে আমায় চুপ হয়ে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। হঠাৎ উনি তেতিয়ে বলে উঠলেন…..
–“হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি কি ইনিয়েবিনিয়ে এটা বলতে চাইছো যে আমি অসুস্থ? আমার পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে?”
–“আমি সেটা কখন বললাম? আমি শুধু নিজের মনে থাকা প্রশ্নগুলো করলাম।”
হতভম্ব হয়ে জবাব দিলাম আমি। লোকটা একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ের টেনে নিয়ে যেতে মাহির। লইয়ার কিনা! আচমকা আমার চুলের নিচে হাত দিয়ে ঢুকিয়ে ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরলেন আয়াশ। আমায় আধশোয়া করে ক্রোধের সঙ্গে বলে উঠলেন…..
–“তোমার সব প্রশ্নের একটাই উত্তর। আমার মনে দুটো কেন হাজারটা অস্তিত্ব বা পার্সোনালিটি থাকলেও সেই হাজারটা অস্তিত্বই তোমায় চায়। শুধু তোমাকে এবং তোমাকেই ওরা চায়।”
বলেই ছেড়ে দিতেই নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে শুয়ে পড়লাম আমি। আমার দুই গালে একজোড়া ঠোঁটের গভীর স্পর্শ পেলাম। মস্তিষ্ক আর কোনো ভাবনা নিতে পারছে না। ফলাফলস্বরূপ আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছি। ভাবলেশহীন হয়ে স্থির হয়ে শুয়েই রয়েছি। চোখের পলকও ফেলছি না। আয়াশ গম্ভীরতার সঙ্গে বললেন….
–“তোমার পিহু আনা হয়েছে ঠিক আছে। বাট ওয়ান মোর থিং! আমার চেয়ে এই পাখিকে বেশি ইম্পর্টেন্স দিলে এই পাখিকে মেরে ফেলতে দুই মিনিটও লাগবে না।”
চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। উনার ভয়াবহতা কতখানি সেটা পরিমাণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। পায়ের ধাপ ফেলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। উনি হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। উঠে বসলাম আমি। কি করব সেটা ভাবতে ভাবতে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। এটা যদি দয়া হয় তবে প্রতিটা পদে পদে যেসব ভালোবাসার পরশ দেন সেসব কি??
কিছুক্ষণ পর পরই ফুলকি এলো ব্রেকফাস্ট নিয়ে। সকালের খাবারের শেষে আমাকে রেডি করানো শুরু করল সে। বেনারসি গায়ে জড়িয়ে নিলাম দ্বিতীয় বারের মতো। কিন্তু এবারও আমার বিয়ে করার কোনো ইটেনশন নেই। আমার হাতে একটা একটা করে চুড়ি পরিয়ে দিল ফুলকি। আমি রোবটের মতোই অন্যের ইচ্ছে অনুযায়ী চলছি এবং কাজ করছি। নাকে নথ আর মাথায় টিকলি ও টায়রা পরিয়ে দিয়ে ক্ষ্যান্ত হয় ফুলকি। ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ে উত্তেজিত হয়ে বলে…..
–“আপনি দেখতে সত্যিই সুন্দর। ওইযে কি যেন একটা বলে না? ন্যাচরাল বিউটি নাকি! ওইটা হচ্ছেন আপনি। আগে স্যার বিদেশি মেয়েদের সঙ্গে মিশত। কি শান্তি পেতো কে জানে! আপনাকে দেখে হয়ত বুঝেছে দেশি মেয়েদের মধ্যেও সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। আর সেটা উপলব্ধি করতে পারলে সকলে মায়ায় পড়ে যাবে।”
–“তার মানে উনি আগে অন্যসব মেয়েদের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন কথাটা ঠিক?”
রোবটের মতো জিজ্ঞেস করলাম আমি। ফুলকি হয়ত থতমত খেলো। একটু ভেবে বলল…..
–“সরি ম্যাম। আপনাকে এসব বলতে চাইনি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
–“সত্যি কথা কোনো না কোনোভাবে বেরিয়েই আসে ফুলকি। যাই হোক আমার একটা হেল্প করতে পারবে?”
–“কি হেল্প?”
–“তোমার ফোনটা আমায় দেবে? একটা কল করব।”
ফুলকি ভয় পেয়ে যায়। ভয়ার্ত স্বরে বলে…..
–“কিন্তু ছোট স্যার জানতে পারলে আমার আস্ত থাকবে না।”
ওর কথায় ভ্রু উঁচিয়ে বিরক্ত হয়ে বললাম….
–“উনাকে কে বলতে যাচ্ছে। আমার খুব দরকার। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”
ফুলকি রাজি হয়। কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দেয় তার বাটন ফোন। খুব সাবধানে একটা নম্বর ডায়াল করে ফোনটা কানে ধরলাম আমি।
–“হ্যালো, পুলিশ স্টেশন? আই নিড হেল্প।”
সকাল ১০ টা বাজে প্রায়। বউ সেজে বসে আছি ঘরে। কখন জানি ডাক পড়বে তার ঠিক নেই। মনে চলছে যুদ্ধ। এসি চলা সত্ত্বেও দরদর করে ঘেমে চলেছি আমি। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই একটু কেঁপে উঠলাম। এই বুঝি ডাক এলো! কিন্তু তা ভুল প্রমাণ করলেন আয়াশের মা।
–“বিয়েটা অবশেষে করছো?”
আমি চুপ করে রইলাম ভদ্রতার খাতিরে। মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উনি আবার দম্ভ নিয়ে বললেন….
–“রায়হান বাড়ির বউ কিনা অন্ধ! হাউ রিডিকিউলাস। প্রথমে তো বিয়ে করবে না বলে পালিয়ে গেলে। তুমি নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসো! কোথায় গেল তোমার সেই লাভার? নাকি টাকা দেখে তুমি আরো অন্ধ হয়ে গেলে?”
এবার আর নিরব থাকতে পারলাম না। নিরবতা ভেঙে কাঠ কাঠ গলায় বললাম…..
–“আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে আমি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত একটা ছেলেকে বিয়ে করব। টাকায় আমার কিছু যায় আসে না। আমি তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য তো আমার সঙ্গে অন্যরকম খেলা খেলল। অন্ধ করে দিল। তবুও হাল ছাড়িনি। আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই নেই।”
–“তাহলে চলে যাচ্ছো না কেন? পালিয়ে যেতে পারতে? আমায় বলতে পারতে আমি সাহায্য করতাম। সিরিয়াসলি, আমি জাস্ট মানতে পারছি না যে এই বাড়ির বউ অন্ধ আর গরীব ঘরের হবে। আয়াশের পছন্দের প্রশংসা না করে পারছি না। ছেলেটা সত্যিই পাগল। ওর বাবা যেমন প্রথমে অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করেছিল ঠিক ছেলেও হয়েছে তেমন!”
অন্যের বাড়িতে আসিনি নিজের ইচ্ছায়। বিয়েও করছি না নিজের ইচ্ছায়। তবুও এতো অপমান আমায় সইতে হচ্ছে। আমি কিছু বলতে উদ্বুদ্ধ হলেই আয়াশের কড়া গলা কানে আসে।
–“আপনার এই স্বভাব কোনোদিনও যাবে না মিসেস. মালিহা রায়হান? আমার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে এতোটা ভাবতে হবে না আপনাকে। আর সব থেকে বড় কথা আপনি আমার প্রোপার্টিতে কি করছেন? আপনি তো এটা জানেন বাড়ির অর্ধেকটা আয়াশ রায়হানের। আমি নিজের টাকা দিয়ে আপনার স্বামীর থেকে এটা কিনে নিয়েছি। আপনি জানেন না? আর স্পষ্ট ভাষায় সেদিনই বলে দিয়েছিলাম আমার প্রোপার্টিতে আপনাদের মতো নোংরা মানুষদের যেন না দেখি। তাহলে কেন এসেছেন? হুয়াই?”
শেষ কথাটা বলে হুংকার ছাড়লেন আয়াশ। উনার মা বৃথা বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন…..
–“দেখো আয়াশ, আমি জাস্ট তোমার ভালোর জন্য….”
–“ভালো? আমি আপনাকে আমার ভালো চাইতে বলেছি? নিজের সন্তান হয়নি বলে এতোটা দরদ আমার প্রতি উপচে পড়ছে আপনার। আজ যদি আপনার গর্ভ থেকে একটা উত্তরাধিকারী আসত তাহলে আমার স্থানটা রাস্তায় হতো। এটা আমি খুব ভালো করে জানি। গেট আউট ফ্রম হেয়ার!”
কিছু একটা ভাঙার আওয়াজে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আয়াশের মা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিছানার চাদর চেপে ধরে বসে রইলাম চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ করে আমায় কোলে তুলে নিলেন আয়াশ। বিছানার চাদর ধরে থাকায় সেটাও উঠে এলো।
–“কি হলো? এমন করছো কেন? ভয় পাচ্ছো আমায়?”
–“কিছু না নার্ভাস লাগছে। আ…আপনি এমন করে আমার কাছাকাছি আসবেন না প্লিজ। নামিয়ে দিন আমায়।”
–“তোমার পায়ে চোট লেগেছে নিশাপাখি। তাও দুই দুইবার। এভাবে সিঁড়ির নিচ পর্যন্ত তুমি যেতে পারবে না। কাছাকাছি আমি যাইনি এখনো। লিগ্যালি না হলে যাবও না। নো টেনশন।”
আমার একটা হাত উনার গালে থাকায় বুঝতে পারলাম উনি নিঃশব্দে হাসছেন। আমি দ্রুততার সঙ্গে বললাম…..
–“আ…আপনি কি এখন সকলের সামনে আমায় এভাবে…? না না। নিচে নামান। সকলে দেখলে কি ভাববে? ছি! নিচে নামান।”
আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমায় আরো জোরে নিজের সঙ্গে চেপে ধরেন আয়াশ। আমি বারবার বলা সত্ত্বেও নিচে নামালেন না উনি। উনি তো জানেনই না এই পা দিয়ে আমি হেঁটে অনেক কিছু শুনে নিয়েছি। আমার জেদের থেকে দশগুন উনার জেদটা বেশি। উনার জেদ হাতি হলে আমি নিতান্তই পিঁপড়ে। উনি হাঁটতে শুরু করলেন।
–“আশা করছি এবার পালানোর বৃথা চেষ্টা করবে না। প্রথমবার পালিয়ে যা ভুল করেছো এবার তা করবে না আশা করি।”
বেশ শক্ত গলায় কথাটা বলে নিচে নামলেন উনি। আমি এই মূহুর্তে নিজের মুখ দেখানোর অবস্থায় নেই। মনে হচ্ছে যেটুকু মানসম্মান বাকি ছিল তাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আয়াশের শেরওয়ানি টেনে ধরে মুখ লুকিয়ে ফেললাম আমি। আয়াশ ফিসফিসিয়ে বললেন…..
–“বুক ছিঁড়ে ঢুকে যাবে নাকি?”
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে আয়াশের বুকে চিমটিও কেটে দিলাম। আয়াশ একটু নড়েচড়ে উঠলেও কিছু বললেন না। আমায় সোজা নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলেন। চোখমুখ লাল করে মাথা নুইয়ে বসে আছি।
–“কেমন আছিস মা?”
মায়ের কন্ঠ শুনে মাথা তুললাম। মায়ের হাত চেপে ধরলাম। মূহুর্তেই চোখে এলো পানি। যেন মায়ের থেকে কত বছর দূরে ছিলাম। মাকে জড়িয়ে ধরলাম আবেগপ্লুত হয়ে। বিড়বিড়িয়ে বললাম…..
–“আমি দয়া চাই না মা। আমি দয়া চাই না।”
–“কি বলছিস তুই?”
আমি তার উত্তর আর দিলাম না। বিয়ে শুরু হলো বলে! মায়ের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতেই অচেনা কিছু কন্ঠ কানে এলো।
–“এটা মি. আয়াশ রায়হানের বাড়ি?”
মাকে ছেড়ে বসলাম আমি। আয়াশ সম্মতি জানিয়ে বললেন….
–“পুলিশ অফিসার। আমি আয়াশ রায়হান। হঠাৎ আপনি এখানে?”
–“আপনার থেকে এটা আমরা আশা করিনি মি. রায়হান। একজন নামি-দামি লইয়ার হয়ে এতো বড় ভুল কি করে করতে পারছেন? আইনের নিয়ম তো আপনার জানা থাকা দরকার। ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকে বিয়ে করছেন। আমরা এই ইনফরমেশন পেয়েছি।”
আয়াশ চিল্লিয়ে বলে উঠলেন…..
–“হোয়াট? এই বাড়িতে কার এতো সাহস? মি. মালিহা রায়হান?”
–“দেখো আয়াশ! সবসময় আমায় ব্লেম করবে না। আমি এমন কিছুই করিনি।”
সোজাসাপটা জবাব দিলেন আয়াশের মা। আমি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছি না। ভয় লাগছে খুব। পুলিশ অফিসার এবার একটা নম্বর বললেন।
–“এই নম্বর থেকে ফোন এসেছে। দেখুন কে করেছে সেটা তো জানি না। তবে আপনি সত্যিই অন্যায় করছেন।”
ফুলকি বোধহয় সেখানেই উপস্থিত ছিল। আয়াশ চিৎকার দিয়ে ফুলকির নাম দিয়ে ডাকতেই ফুলকি ভয়ে বলে দিল…..
–“আনিশা ম্যাম আমার ফোন নিয়েছিল স্যার। আমি কিছু জানি না। আমি এসব জানলে উনাকে কখনো ফোন দিতাম না। দয়া করে এই কাজ থেকে আমায় বের করে দেবেন না।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সবাই বলাবলি শুরু করল। মাও পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল…..
–“আনিশা তুই এসব কি করেছিস?”
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে আয়াশ আমায় বাহু ধরে দাঁড় করালেন। আমার গাল চেপে ধরে বললেন…..
–“আবারও বিশ্বাসঘাতকতা? তাও আমার সাথে? তুমি পুলিশ ডেকেছো? কতটা কেয়ার করি তোমার। তুমি তো দেখছি তার যোগ্যই নও।”
আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন…..
–“আমাদের সামনে একটা মেয়েকে জোরজবরি করার মানেটা জানেন তো মি. রায়হান?”
এরপর কি হলো জানি না। তবে পায়ের ধুপধাপ শব্দ হলো। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে? আচমকা তুষার বলে উঠল…..
–“আপু আপু! আয়াশ জিজু নিজের হাতে ছুরি ধরেছে।”
আঁতকে উঠলাম আমি। পুলিশ অফিসারও কি বলবেন তা ভেবে কূল না পেয়ে বললেন…..
–“এসব কি করছেন মি. রায়হান? পাগলামি করবেন না। ছুরি ফেলুন।”
আয়াশ তাতে পাত্তা না দিয়ে বললেন…..
–“নেভার। আনিশা যদি আমায় বিয়ে না করে তাহলে আজ এখানেই আমি নিজেকে শেষ করতে দুইবারও ভাববো না। নাউ ডিসিশন ইজ ইউরস আনিশা সাবিহা…!”
চলবে…….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]