#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১০
#রূবাইবা_মেহউইশ
___________________
হালকা শীত শীত আবহাওয়া পূব আকাশের সূর্যটাও কমলা রোদ মাখিয়ে দিচ্ছে ধরনীকে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আজ থেকে পারমানেন্টলি রিশাদের ড্রাইভারের চাকরি শেষ হয়ে গেল। ঢাকার অফিসিয়াল প্রতিটি কাজকে সে বিনা রেজিগনেশনেই ছেড়ে দিলো৷ মনটা এই প্রথম তার মায়ের জন্য বিক্ষিপ্ত হলো৷ মা মারা গেছে সেই কবে। স্মৃতিতে মায়ের চেহারাটাও ঠিকঠাক মনে নেই। যেদিন থেকে খালা এলো মা হিসেবে তাদের বাড়ি সেদিন থেকে খালাটাও বদলে গেল। মায়ের আদলের প্রিয় খালাটাকে সেই থেকে অপ্রিয় মনে হতে লাগলো। দিন গেল মাস গেল বাবার সাথে খালার ঝগড়া রোজ রোজ বিশ্রী কিসব প্রেম নিয়ে বাবার অভিযোগ আর খালার ব্যর্থ চিৎকার । ধীরে ধীরে একাকীত্ব সঙ্গী হয়ে গেল ছোট্ট রিশাদের। অর্থবিত্ত আর ক্ষমতায় সব পাওয়া যায় বাবার বোঝানো এই কথাটাকে কাজে লাগিয়ে মাকে খুঁজতে চাইলো সে বহুবার। মেলেনি মা তার এই ভূলোকে। আয়া হিসেবে ছিলো একজন যে কিনা দীর্ঘ সময় মায়ের মত ভালোবাসলেও দিনশেষে ফিরে যেত নিজ সন্তানদের কাছে। রিশাদ আবার একা হয়ে যেত। খালা এসে আদর কম যত্ন বেশি আর বাবার প্রতি থাকা ক্ষোভে বাঁকা কথাও ছুঁড়তে লাগলো। দেখতে দেখতে রাইমা হলো রিশাদের মনে হলো এই বুঝি তার একাকীত্ব ঘুচে গেল। কিন্তু নাহ, বোন হতেই বাবার ভালোবাসা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বাবার চোখের মণি রাইমা একাই বাবার সুখের চাবি হয়ে রইলো। এরপর এলো রিহান তবে ততদিনে রিশাদের আর বাবার ভালোবাসার প্রয়োজন রইলো না। রিহান হলো সেও বেচারা কপাল পোড়া তার মতোই। বাবার যেন মেয়েই সব ছেলেরা কিছুই না। রাগের কারণে রিহান তার মায়ের কাছেও অপ্রিয়। রিশাদের চেয়ে ভিন্ন নয় রিহানের কপালের লেখনও৷ একসময় রিশাদ পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব্যবসাতেও ঢুকে গেল। দেখতে দেখতে পড়া,কাজ দুইয়েই মুঠোভর্তি সফলতা আসন্ন হতেই বাবার মনে আদর এলো। রিশাদের সুখের জন্য বিয়ে করালো নিজের মতোই আরেক কোটিপতির মেয়েকে। বিনিময়ে অর্থে অর্থে সম্পর্ক হলো ঠিকই শুধু মনের সাথে মনের কোন সম্পর্ক হলো না। বিয়ের রাতেই নীলিমা জানালো এ বিয়ে সে টিকিয়ে রাখবে না। ভয়ংকররকম রাগী রিশাদও সেদিন সদ্য বিয়ে করা বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে একটুও রাগ করেনি। বরং সময়ের অপেক্ষা করেছে নিশ্চয়ই একসময় মেয়েটা পুরনো প্রেমিককে ভুলে তার মায়ায় জড়াবে। কিন্তু নাহ, তেমন কিছুই হয়নি উল্টো প্রেমিকের কাছে কোন একদিন আঘাত পেয়ে রিশাদকে আঁকড়ে নিয়েছিলো নিজের মাঝে। রিশাদ ভেবেছিলো সম্পর্কটা বুঝি এবার মোড় নিবে তার দিকেই। এখানেও ভুল প্রমাণিত হলো, কদিনেই নীলিমা আর তার প্রেমিকের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেল আর তার মাঝেই জানা গেল নীলিমা প্রেগন্যান্ট৷ পরের কাহিনিটা আরও ভিন্ন। রিশাদ বদলে গেল আগের চেয়ে অনেক বেশি। বাবার সাথে যেচে পড়ে সম্পর্ক ভালো করতে চেষ্টা করলো। ব্যবসায় অত্যধিক মনোযোগী হলো আর নীলিমাকে নজরে রাখতে সবরকম ব্যবস্থা করে নিলো। চোখে চোখে নয়টা মাস রেখে দুনিয়ার আলোয় আনা হলো নির্জনকে। নীলিমাও যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিলো। নির্জনের জন্মের পর দেড় মাসের মতোই ছিলো রিশাদের বাড়ি। তারপর বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবার নাম করে মাঝপথেই রিশাদের কোলে থাকা নির্জনকে ফেলেই পালিয়ে গেল পুরনো প্রেমিকের সাথে। মেহউইশও বিয়ের রাতে ঠিক তাই করেছিলো যা নীলিমা করেছে আর ঠিক এ কারণেই রিশাদ বিক্ষিপ্ত হয়ে মেহউইশকে পাওয়ার পরই থাপ্পড় মেরেছিলো ওরকমভাবে। সময় যেন সময়েরই পুনরাবৃত্তি করেছিলো সেদিন রিশাদের চোখের সামনে। বাবার সাথে সম্পর্কের আবারও ফাটল ধরলো কাল রাতে৷ নিঃসঙ্গ রিশাদ বুদ্ধিমানও কম নয়। বাবার সাথে মিলে কাজ করলেও সে নিজের জন্যও অনেক কিছু জমা করে রেখেছিলো। কে জানে! হয়তো সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবেই করেছিলো। আজ সেই জমা পুঞ্জি আজ কাজে লাগছে তার। মেহউইশ ঘুমে ঢলে পড়ছে বারবার। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে রিশাদ তাকাচ্ছিলো মেহউইশের কোলে থাকা নির্জনের দিকে৷ সিটবেল্ট লাগানো বিধায় মেহউইশের পড়ে যাওয়ার আশংকা নেই কিন্তু হাত আলগা হলেই নির্জন পড়ে যাবে। রাস্তার কিনারায় গাড়ি থামিয়ে রিশাদ ছোঁ মেরে ছেলেকে নিয়ে নিলো নিজের কোলে৷ মেহউইশ চমকে তাকালো।
স্যরি
রিশাদ ফিরেও তাকালো না মেহউইশের স্যরি শুনে। সে চুপচাপ নির্জনকে এক হাতে কাত করে কোলে নিলো। অন্যহাতে ড্রাইভিং করার জন্য প্রস্তুতি নিলো। মেহউইশ ভাবছে এই দৈত্য নির্ঘাত তাদের আজকে উপরে পাঠাবে এক্সিডেন্ট করে।
পানির দরকার ছিলো একটু,,, কথাটা বলে রিশাদের দিকে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠলো মেহউইশের। সে কি ভাবছে আজকেও পানির কথা বলে মেহউইশ সেই রাতের মতোই পালাবে? ভুল করেও না৷ এবার আর সেই ভুল কাজ করবে না সে। যথেষ্ঠ শিক্ষা হয়েছে তার এই লোকের হাতে থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে। বাপের জন্মে এমন মার তাকে আর কেউ মারেনি কখনও। রাস্তাটা নিরব লাগছে খুব৷ এটা কোন এলাকা মেহউইশ বুঝতে পারলো না। হাইওয়ে ছেড়ে কি অন্যকোন ওয়ে আছে চট্টগ্রামে যাওয়ার! কি জানি? তার তো এটাই জানা নেই হাইওয়ে আসলে কোনটাকে বলে। হাসি পাচ্ছে খুব এখন এত বছরের জীবনে কতোটা গর্দভ রয়ে গেল এখনও৷ ইভান কত্তো কিছু তাকে শিখিয়ে, চিনিয়ে দিতো,, মনের ভেতর আবারও কষ্টেরা উড়তে লাগলো ডানা মেলে৷ ইভান নামটা মনে আসলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে তার কাছে। যেখান থেকেই হোক খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে তাকে। বাড়িতে যখন রিশাদ তাকে ধমকে উঠলো, ‘একদম চুপ’ বলে তখনই রিশাদ জানিয়েছিলো ইভান হাসপাতালে আছে। হাতের শিরা কেটে ফেলেছে।এবং মেহউইশের মাকে বলা হয়েছিলো তিনি যেন মেয়েকে কিছুই না জানান৷ রিশাদ একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলো মেহউইশের জন্য আর সেটার ফোন নম্বর প্রথমেই মাইমুনাকে দেওয়া হয়েছিলো। ইভান যখন হাত কাটলো তখনই তিনি সেই নম্বরে ফোন করে সবটা বলে গেছেন একাধারে। ফোনের ওপাশে কথাগুলো কে শুনেছে তার কোন আন্দাজই ছিলো না তার। ফোনটা ছিলো তখনও রিশাদের পকেটে৷ সে বাড়ি ফিরে ভেবেছিলো একটু ভালো কথাবার্তার মাঝে ফোনটা দিবে মেহউইশকে কিন্তু তার আগেই শ্বাশুড়ি মায়ের ফোনকল পেয়ে রিসিভ করতেই রেগে যায়। ইভান নামটা মেহউইশের লাইফ থেকে দূর না হলে সে সংসার করবে কি করে তিনি কি বোঝেন না? মনের আক্রোশ মনে রেখেই সেদিন ইভানকে হাসপাতালে নিতে লোক পাঠালো, মেহউইশের নামে দেনমোহরে দেওয়া বাড়িটাতে শ্বাশুড়ি আর শালাকে পাঠিয়ে দিলো। বাড়ির খরচ হিসেবে মাসে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থাও করলো৷ কিন্তু শেষ অব্ধি মেহউইশ কি বললো! সুযো পেলেই সে পালিয়ে যাবে? একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করা চাট্টিখানি ব্যপার না আবার কখনও কখনও খুবই সহজ ব্যপার। রিশাদ তো কোনদিন এভাবে বিয়েই করতো না। শুধুমাত্র ছেলের জন্য মা লাগবে বলেই এত কিছু করা। মেহউইশ ছাড়াও দুনিয়ায় এমন অনেক মেয়ে পাওয়া যাবে বিয়ে করার জন্য কিন্তু সহজসাধ্য মেহউইশকেই কেন মনে হলো তার! সে উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে রেখেছেন জেবুন্নেসা। নাস্তা করে নিজের ঘরে দরজা এঁটেছেন৷ ঘরময় পায়চারী করতে করতে এক দফা ঝগড়া সেরেছেন ফোনে তার স্বামীর সাথে। সকালেই রাশেদ খান ফোন করে জানিয়েছেন রিশাদের সাথে হওয়া কাল রাতের বাকবিতন্ডা। রিশাদকে তিনি ঢাকার সকল প্রকার ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। আর এই নিয়েই চিন্তায় অস্থির জেবুন্নেসা। রিশাদের সাথে তার মৌখিক কোন মিষ্টি সম্পর্ক না থাকলেও ছেলেটা তার বড় আদরের। নিজের মনের মানুষকে হারানোর জন্য দ্বায়ী রাশেদ খানের সন্তান বলেই যতোটা অবহেলা দেখিয়েছেন৷ মন থেকে তো সে বড় আপন তার অতি আপন মৃত বোনের সন্তান। প্রকৃতপক্ষে জেবুন্নেসা রিশাদ,রিহান কিংবা রাইমা তিনজনের কাউকেই কম ভালোবাসেন না। কিন্তু সেই ভালোবাসা তিনি প্রকাশ করা জরুরি বলে মনে করেন না। স্বামীর প্রতি থাকা আক্রোশ আর ক্রোধের কারণেই তিনি হরদম কটুবাক্যই বলে বেড়ান খান বাড়ির প্রতিটি মানুষের সাথে। বিয়ের একুশ বছর হয়ে গেলেও এই কটুবাক্য ব্যয় একটুও কমেনি তার তাই বলে সন্তান আর ভাগ্নের প্রতি ভালোবাসায়ও কমতি নেই। সব ব্যবসা থেকে আলাদা করে দিলে রিশাদ থাকবে কি করে? বউ, বাচ্চা এমনকি তার নিজের খরচই চালাবে কি করে! রাইমা আজ কলেজে যায়নি। মায়ের মুখের ভাব তার কাছে একটুও ভালো লাগেনি। বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? কই সে তো আজ মায়ের গলার স্বরও শোনা যায়নি একটিবার। এতোটা নিঃশ্চুপ তিনি কখনও থাকেননি। রাইমার ভয় হলো বড় কোন বিপদের আশংকা জাগলো মনে। দাদাভাইও কাল নতুন ভাবীকে নিয়ে গেল আর তো ফিরলো না!
ঝলমলে রোদ্দুরেও শীতল শীতল হাওয়া গায়ে লাগছে। দুপুর বাজে দুইটা আর এ সময় এসে পৌঁছুলো কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম । সময় লাগেনি লাগেনি করেও অনেকটা লেগে গেছে কুমিল্লা পৌঁছুতেই। এখনও অনেকটা পথ বাকি চট্টগ্রাম যেতে৷ রিশাদ ভেবে পায় না আজ তার এতোটা ক্লান্ত লাগছে কেন। মেহউইশের কোল থেকে তকন নির্জনকে টেনে নিলেও ড্রাইভিং আর করতে পারেনি। এক হাতে হাইওয়েতে চলার সাহস তার হয়ে উঠেনি৷ না পেরেই সে আবার নির্জনকে দিতে হলো মেহউইশের কোলে৷ বরাবরই চট্টগ্রাম গাড়িতে গেলে সে ড্রাইভারকে নিয়ে যায় অন্যথা প্লেনে। আজ তার পক্ষে কোনটাই সম্ভব নয়।
গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে অনেকগুলো পানির বোতল আর দু প্যাকেট বিরিয়ানি আনলো। ততক্ষণে গাড়ির জানালায় মাথা বের করে বাইরেটা দেখলো মেহউইশ । এই প্রথম সে এতখানি দূরের পথ পেরুলো আরও নাকি বাকি৷ বিমর্ষ হয়ে থাকা মনটাতেও এবার একটু পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। কিছুটা হলেও মন খারাপ ভাবটা এখন কম শুধু বুকের ভেতর ইভানের জন্য হওয়া চিনচিনে ব্যথাটাই দূর হচ্ছে না, হওয়ারও নয়। হয়তো একটাজীবন এই ব্যথা নিয়েই কাটাতে হবে। রিশাদ তো গাড়িতে উঠার পরই মোবাইল ফোনটা দিয়েছিলো। ইভানের নাম্বারে কি একটাবার কল করবে! ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারে না সে। কোলে থাকা বাচ্চাটার মুখ দেখে তার তেমন একটা মায়া কাজ করে না। শুধু মনে হয় এই বাচ্চাটা একটা আপদ বৈ কিছুই না।
চলবে