মন গহীনের গল্প পর্ব-১৪

0
1222

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৪
#রূবাইবা_মেহউইশ

💞
‘নির্জনকে দিন।’

মেহউইশ কথাটা বলতেই রিশাদ বিনাবাক্যে নির্জনকে তার কোলে দিলো। শিরশিরে ভোরের বাতাস উদোম গায়ে হঠাৎ হঠাৎ কাঁপুনি দিচ্ছে রিশাদের।মেহউইশের খেয়াল করেছে রিশাদের হাতের পশমগুলো শিউরে আছে। নির্জনের দিকে হাত এগিয়ে আবারও বলল, ‘আমার কাছে দিন ওকে আপনি কাপড় পরুন৷’

-কাপড় পরবো মানে? আমি কি কাপড়ছাড়া ঘুরছি!

আমি সে কথা বলিনি৷রোদ এখনও পুরোপুরি উঠেনি শীত শীত ভাবটা আছেই৷ তাই শার্ট বা টি শার্ট কিছু একটা পরে নিন৷

সেটা কি সুন্দর করে বলা যায় না? কথাটা বলতে বলতেই নির্জনকে দিয়ে দিলো রিশাদ। বাচ্চাটা এত শান্ত কি করে হলো কে জানে! মেহউইশ অবাক হয় এতটুকু বাচ্চা কি করে থাকছে মা ছাড়া? একটুও কাঁদেনা চুপচাপ ফিডার মুখে দিলেই কেমন চুকচুক শব্দ করে খায়। হাসি পায় তার এই শব্দ শুনলে৷ মনে হয় কোন বিড়াল ছানা দুধের বাটিতে চাটছে। বাচ্চাটার গায়ের রঙ এতোই ফর্সা যা দেখে হিংসে হয় মেহউইশের। সেও মোটামুটি ফর্সা কিন্তু বাচ্চাটা একেবারে বাড়াবাড়ি রকমের ফর্সা৷ হয়তো মা, বাবার কারণেই সে এতো ফর্সা। প্লাসে,প্লাসে মিলে ডবল প্লাস আরকি! মেহউইশ সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছিলো নীলিমাকে পরনে ছিলো কালো লেগিংস আর হলুদ কূর্তি। গলা, মুখ,হাত যতটুকু চোখে পড়েছে সাদায় ঝলসে যাওয়া রঙ মনে হয়েছিলো৷ আঁড়চোখে রিশাদের নগ্ন দেহে চোখ ফেরাতেই খেয়াল করলো রিশাদও অনেক ফর্সা। ব্যস হয়েই গেল তার হিসাব গণিতের প্লাস প্লাস। রিশাদ কয়েক মিনিট একই জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল নিজের ঘরে। ফুপুকে ডেকে গরম পানি চাইলো গোসলের জন্য।

রোদের তেজ সময়ের সাথে একটু একটু করে বাড়তে থাকলো। রিশাদ সকালের নাস্তা সেরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ফুপুকে কিছু বলে গেল মেহউইশ তাদের শোবার ঘর থেকে লক্ষ্য করলো সেটা৷ কিন্তু ফুপুর মুখের রঙ বদলে গিয়েছিলো কোন কারণে৷ কি হতে পারে সেই কারণ! মেহউইশ জানে না আর রিশাদ অমন শার্ট,প্যান্ট, কোট পরে কোথায় গেল তাও জানে না। রিশাদের অফিস তো শুনেছিলো ঢাকায়। তবে কি সে এখন ওভাবে তৈরি হয়ে ঢাকায় গেল? তাকে আর নির্জনকে নিলো না কেন! তার ভাবনার মাঝেই আনতুং এলো ঘরের সামনে। জানতে চাইলো সে এখন গোসল করবে কিনা তাহলে বাথরুমে গরম পানি রেখে আসবে।

সকালের সময়টা যেনতেন করে কাটলেও দুপুর এবং বিকেলটা মেহউইশের দারুণ কাটলো। আনতুং আজ পাহাড়ি কিছু জংলী ফুল এনেছিলো তার জন্য । ভূতে ধরা লোকের নাকি ঔষধ সেইসব ফুল৷ সুতোয় বেঁধে মালা বানিয়ে তাকে সাজিয়েছিলো খুব৷ মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে মেহউইশ কিন্তু মুখে বলেছে এ ফুল তার পছন্দ হয়নি। কেন বলেছে তা জানে না৷ বিকেলে ফুপুর সাথে বসে হালিম রান্নার ব্যবস্থা করেছে৷ নির্জন দু দিন ধরে তার কোলে এলেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে খুব৷ মেহউইশের এ জড়ানো ভালো লাগে,অন্যরকম আনন্দ হয় মনে মনে। সারা সন্ধ্যা সে নির্জনকে বিছানায় শুইয়ে কতরকম কথা বললো, খেলা করলো৷ সন্ধ্যার পর মায়ের ফোন পেয়েই কিছু সময় কথা বলেছে কিন্তু একটিবারও ইভানের কথা জানতে চায়নি। শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো মুশকিল। তবুও রিশাদ বিকেলে সুযোগ থাকার পরও সন্ধ্যায় ফিরছে। কাল রাতে মেহউইশের ওই অবস্থা দেখার পর থেকেই মাথা থেকে রাগের আস্তরণটা একেবারেই যেন উবে গেছে। এ রিশাদ গত আটাশ বছরের রিশাদের চেয়ে আলাদা। এক রাতেই ভয়ংকররকম পরিবর্তন তার মস্তিষ্কে এসে বসে গেছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই মনে পড়ছে বারবার মায়ের কথা। কতটুকু খেয়াল আছে মায়ের মুখ? মনেই পড়তো না বোধহয় বাড়িতে ছবি না থাকলে৷ ফুপুটার অল্পবয়সেই জীবনটা বেরঙিন না হলেও অন্তত তার জীবনে কিছুটা সময় ফুপুকে পাশে পাওয়া যেত কিন্তু এখানেও দূর্ভাগ্য। এক প্রেমের অবদানে ফুপু,খালা দুজনের স্নেহ থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। এখন সেই প্রেমের খাতিরেই তার ছেলেটাও বঞ্চিত হচ্ছে। কি এমন আছে এই প্রেম ভালোবাসায়? সে কেন কখনো বুঝতে পারেনি প্রেমের স্বাদ কেমন! ভাবনারা পাহাড়ি মেঘের মতোই মাথায় ঠুকে ঠুকে এদিক ওদিক ঘুরছে। ড্রাইভিংয়ে মনযোগ রাখা দায়। মেহউইশের মা ফোন দিয়েছিলো রিশাদকে। সে ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি। ভদ্রমহিলা তাকে কল দিয়ে প্রথমেই বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে মুক্তি দাও। আমাদের লাগবে না তোমার টাকা পয়সা। আমরা খেটে খেতে জানি।’ রিশাদের কাছে এ কথার জবাব নেই আজ থেকে আর। কালকে পর্যন্তও সে মাইমুনার কথা কানে তোলেনি কিন্তু আজ সকাল থেকে নিজ মনেই ভাবছে সব কথা। বাড়ি ফিরে প্রথমেই ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে গেল। কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতেই খাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহউইশ ঘুমুচ্ছে পাশেই নির্জন হাত পা নাড়িয়ে খেলছে। কতরকম শব্দও করছে মুখ দিয়ে৷ ভালো লাগছে দৃশ্যটা দেখতে তাই নিজের মুঠোফোনটায় তৎক্ষনাৎ তুলে নিলো কিছু ছবি৷ সন্ধ্যাক্ষণ পার হয়েছে অনেকক্ষণ রিশাদ নির্জনকে নিয়ে ফুপুর ঘরে বসলো৷ ফুপু আজ নাড়ু বানিয়েছেন নারকেলের৷ মেহউইশও সাহায্য করেছিলো কাজে। রিশাদকে নাড়ু দিয়ে ফুপু আরাম করে তার পাশেই বসলেন৷

‘তোমার বউয়ের নামটা তুমি ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারো না, তাই না!’

মাত্রই মুখে নাড়ুটা দিয়েছিলো। ফুপুর কথায় মুখের খাবার গলায় নেমেই আটকে গেল। ফুপু পানি এনে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। ডকডক করে গ্লাসের সবটা পানি শেষ করে বলল, ‘আসলে তার নামটাই কেমন যেন। উচ্চারণ ঠিকঠাক মুখে আসে না।’

‘হুম, আমারও একই অবস্থা৷ মেয়েটাকে ডাকতে গেলে বউমা বলতে গয়৷ আমি কি অতো বুড়িয়ে গেছি নাকি! অত বড় মেয়েকে বউমা ডাকবো আজব লাগে। আমি ভাবছি তাকে নীলিমা বলেই ডাকবো। কি সুন্দর নাম।’

-কিহ!

‘চেঁচাচ্ছো কেন রিশাদ?’

‘তুমি ওকে নীলিমা ডাকবে কেন? ও তো মেহউইশ’ বলেই মনে পড়লো ফুপু কখনো নীলিমার ছবি দেখেন নি। এ বাড়িতে এসেছেন রিশাদের বিয়েরও বহু আগে আর সবার থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই তিনি রিশাদের একমাত্র ফুপু হয়েও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না।

‘নীলিমা পালিয়ে গেছে ফুপু৷ ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী মেবিশ।’

রিশাদের বলা কথাটা কানে বাজলো খুব তার ফুপুর। এসব কবে হলো সে জানেই না৷ ফোনে শুধু বিয়ের খবর শুনেছিলো এরপর বাচ্চার। তারপর মাস চারেক হলো যোগাযোগ বলতে শুধু টাকা পাঠানোর কাজটাই করতো রিশাদ৷ কথাও বলেনি ঠিকঠাক এ ক’মাসে। তবে কি এ ক’দিনেই এতকিছু হয়ে গেল!

-বাবা তুমি দ্বিতীয় বিয়ে কবে করলে? নাকি নীলিমাকে রেখে এই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছো তাই আমাকে সেদিন বললে ভাইকে যেন না জানাই তারমানে সত্যিই,,,,৷ মুখের রঙ পাল্টে গেল রিশাদের ফুপুর তা দেখে রিশাদ আবারও বলল, ‘ তেমন কিছুই না ফুপু। নীলিমা চলে গেছে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে আর নির্জনকেও এখন নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আর মেহউইশকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি নির্জনের জ,,, রিশাদের কথা শেষ হবার আগেই তার ফুপু সপাটে এক চড় মারলেন তার গালে। আচমকা থাপ্পড়ে হতভম্ব রিশাদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। ততক্ষণে ফুপু তার সামনে থেকে গেছেন। হাতের নাড়ু হাতেই রইলো তার। এক পা দু পা করে ছেড়ে বেরিয়ে গেল রিশাদও। বাইরে কুয়াশা বাগানের মাটি শিশিরে ভিজে সোদা এক গন্ধ তৈরি করেছে যেন৷ এ গন্ধ অন্যরকম, অনেকটা ভ্যাপসা গরমে হালকা বৃষ্টিতে মাটি ভেতরের ফাঁপা গন্ধ । মন্দ লাগছে না রিশাদের তবে শীতটা গায়ে সুঁইয়ের মত বিঁধছে। কিন্তু এখন আর ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না গরম কাপড়ের জন্য। ফুপু নিশ্চয়ই এখন তার ঘরেই গিয়েছে। সে অন্যায় করেছে মেবিশকে জোর করে বিয়ে করে।কিন্তু তার কি উপায় ছিলো সেদিন! ছেলেটার সেদিনের অসুস্থতা, কান্না এবং মেবিশের কোলে যেতেই তার চুপ হয়ে যাওয়া। উগ্র চিত্তের রিশাদ সেদিন ছেলেটার ভালো শুধু মেবিশকে ঘিরেই মনে হয়েছিলো। একটাবারও তখন নিজের করা কাজগুলোকে অন্যায় মনে হয়নি। বাবা হিসেবে সবই ঠিক মনে হয়েছিলো কিন্তু এখন একটু একটু করে নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করছে সে। ভুলগুলো যেন এখন নিজ থেকেই তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সব৷ যা হয়েছে সব অন্যায়, যা করেছে সব ভুল কিন্তু সে কি এখন মেহউইশকে মুক্তি দিলে সেই ভুল শুধরানো সম্ভব! ‘নাহ, মেবিশকে ছাড়তে পারবো না আমি’ নিজের মন থেকেই যেন এমন এক জেদমাখা মন্তব্য শুনতে পেল রিশাদ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here