#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২২
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
সন্ধ্যের মুখে শীত জড়িয়ে পাহাড় যখন কুয়াশায় লুকিয়ে গেল তখনই রিশাদ বাড়ির কোর্টইয়ার্ডে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাইমা বেছে বেছে বড় বড় কাঠগুলো রেহনুমার দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে এনে জড়ো করছে রিশাদের সামনে। শীত এখানে এত বেশি হবে তা বুঝতে পারেনি জেবুন্নেসা। কক্সবাজারে এতোটাও কাঁপুনি লাগেনি তার এখানে এসে শারীরিক অবস্থা করুণ। রেহনুমা ঘরে ঢুকেই জেবুন্নেসাকে ওরকম কাঁপতে দেখে চুপচাপ নিজের আলমারি থেকে ভারী একটা উলের সুয়েটার আর মোজা বের করে দিলো হাত আর পায়ের। জেবুন্নেসা প্রথমে সেদিকে ফিরেও তাকায়নি আর রেহনুমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝটপট সুয়েটার গায়ে দিলো সে। না চাইতেও মনে মনে ধন্যবাদ বলে দিলো আনমনেই। এই শীতের সন্ধ্যায় সবাই বাইরে বসে বার বি কিউ খাবে আয়োজন করেছে। জেবুন্নেসা মনটা ভালো লাগছে না একদমই। এখন দুজনকে কাছে পেয়ে স্বস্তি লাগলেও রিহানের জন্য খারাপ লাগছে। ছেলেটা একা বাড়িতে আছে তার বাবা বাড়িতে এসেছেই কিনা কে জানে! ছেলেটা বার বি কিউ পার্টি খুব পছন্দ করে আর এজন্যই হয়তো কষ্টটা বেশি লাগছে তার। ছোট ছেলেটাকে রেখে এসব তার গলা দিয়ে নামবে না। রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো মেয়েটা লেজের মত পিছন পিছন সেখানেও চলে গেছে কাল আবার আঠার মত এখানেও চলে এসেছে। রিহানটা কেন এলো না? সেও তো দেখেছে মা রাগ করে চলে যাচ্ছে জেদ ধরে সেও আসতো! চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ঘরে বসে।
মেহউইশ নির্জনকে আজ প্রতিদিনকার চেয়ে দ্বিগুন কাপড়ে মুড়ে নিচ্ছে। মুখটা ছাড়া তার একটা নখও দেখার উপায় নেই। রিশাদ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলো গেছে নির্জনকে যেন একদম প্যাকেটমোড়া করে নেওয়া হয়। বাইরের ঠান্ডা লেগে তার যেন জ্বর,ঠান্ডা না লাগে কিছুতেই। মেহউইশও নিজের বুঝমত তৈরি করলো বাচ্চাটাকে। হিম শীতল পরিবেশে নিজেরও কাপড়ে মুড়িয়ে যেতে হবে ভেবেই কাপড় খুঁজছে সে।এদিক ওদিক খুঁজে যে কাপড় চোখে পড়লো তাতে কোনটা এখন পড়া ঠিক হবে বুঝতে না পেরে বিছানায় বসলো। রাইমা ড্রেসের ওপর মোটা একটা লং স্লিভ গেন্জি পরেছে আবার তার ওপর হুডি। হাত মোজা,পা মোজা সবই পরেছে৷ মধ্যবয়স্ক শ্বাশুড়ি দুজনও কি চমৎকার সব সুয়েটার পরেছে৷ সে কি পরলে ভালো লাগবে বুঝতেই পারছে না। এখানে এতো শীত না পড়লেই হতো! নির্জনকে মোটা মোটা গরম কাপড়ে আবৃত করায় ছেলেটাকে ভালোই বড় লাগছে দেখতে৷ মেহউইশ নিজে তৈরি হওয়া বাদ দিয়ে নির্জনের হাতের মোজা খুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে খেলছে। কখনও আঙ্গুলে চুমু খাচ্ছে কখনওবা নিজের গালে তার আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে।মেহউইশ এখনও নির্জনকে নিয়ে বের হচ্ছে না বলেই রেহনুমা বলল, ‘রিশাদ দেখে আয় তো মেহউইশ এখনও আসছে না কেন?’
রাইমা বসা থেকে উঠতেই যাচ্ছিলো কি রেহনুমা তার হাত টেনে ইশারা করলো, সে চাইছে রিশাদই যাক। রিশাদই উঠে ঘরে গেল আর যেতেই দেখলো মেহউইশ খিলখিলিয়ে আসছে নির্জনের আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে৷মন ভালো করার মত এক দৃশ্য যা রিশাদের শূন্য হৃদয়ের মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মত লাগছে। হাসি মুখে মেহউইশ নির্জনকে আদর করছে। রিশাদের উপস্থিতি টের পেয়েই পেছনে ফিরে একপলক দেখলো সে। রিশাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে, ঠোঁটের কোণে তার এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠেছে।
‘তোমরা এখনও বাইরে এলে না?’ বলতে বলতেই রিশাদ খাটের কাছে এগিয়ে এলো। মেহউইশ বসা থেকে উঠে সরে যাচ্ছিলো তার আগেই রিশাদ হাত টেনে ধরলো মেহউইশের। চমকে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালো মেহউইশ । রিশাদের চোখ তার চোখে আবদ্ধ হলো। দু জোড়া চোখে জড়তা আর অস্বাভাবিকতার বাস তা আজই প্রথম উপলব্ধি হলো দুজনের।
‘হাত ছাড়ুন।’
‘একটু বসো এখানে। ‘
‘আমার শীত লাগছে শাল নেবো।’
‘তুমি বসো আমি দিচ্ছি ‘ বলেই রিশাদ মেহউইশকে খাটে বসিয়ে আলমারি থেকে একটা লং জ্যাকেট বের করলো৷ জ্যাকেটটা রিশাদের এবং পুরনো আর সেটাই মেহউইশকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পরো।’ সাথে নিজেরই মোজাও দিলো। মেহউইশের নিজেরই অনেকগুলো শীতের কাপড় কেনা হয়ে গেছে এখানে আসার পর থেকে। সব রিশাদ নিজেই কিনে এনেছিলো এবং সাইজেও পারফেক্ট তবুও কেন নিজের গুলো বের করে দিলো তা মেহউইশের মাথায় ঢুকলো না। রিশাদ বিছানা থেকে নির্জনকে কোলে তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহউইশের রাগ হলো এসব বড় বড় জ্যাকেট আর মোজা দেখে। সে এগুলো পরবে না নিজের থাকতে অন্যের ব্যবহৃত জিনিস কেন পরবে? কিন্তু নাহ, রিশাদ তার মনে যতোটা তিক্ত ব্যক্তি ঠিক ততোটাই ভয়ংকর তার কি সাধ্য রিশাদের কথার বিপরীত করে! মুখ ফুলিয়ে সেই জ্যাকেটটাই গায়ে দিলো। প্রথমে পায়ের মোজা তারপর হাতের মোজা পরে রিশাদের খুব সুন্দর একটা মাফলার ছিলো যা রিশাদের ড্রয়ার থেকে ইচ্ছে করেই নামিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। এটা যেন রিশাদকে তার কথার জবাব না দিতে পেরে এভাবেই মনের ক্ষোভ ঝাড়লো।বাইরে থেকে রাইমার গলা শোনা যাচ্ছে সে ‘ভাবী ভাবী’ বলে ডাকছে। তড়িঘড়ি মাফলারটা ভালো করে গলায় বেঁধে বের হলো মেহউইশ। কর্টইয়ার্ডে আগুনের শিখা বাড়ির পুরো দক্ষিণ অংশই কমলাভ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে এ বাড়িতে বর্তমানে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকটা মানুষ। মেহউইশ বসেছে রাইমার পাশে তার পাশেই বসে আছে রেহনুমা আর রিশাদ , রিশাদের পাশেই নির্জনকে কোলে নিয়ে বসে আছে জেবুন্নেসা তার থেকে আবার একটু দূরত্ব রেখে আনতুং, গেইটের দারোয়ান আর আনতুংয়ের ছোট্ট মেয়েটি। আজ বারবিকিউ করবে বলেই রেহনুমা মেয়েটাকে আনতে বলেছে৷ এমনিতেও মেয়েটা এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করে খুব৷ রাতের বেলায় আনতুং এখানে থাকে বলে প্রায়ই মেয়েটা মন খারাপ করে৷ অথচ তাকেও এসে থাকতে বললে সে রাজী হয় না। তার নানীকে ছাড়া নাকি ঘুম আসে না। হতে পারে জন্মের পর মাকে ছাড়া থাকলেও নানীকে ছাড়া কখনও থাকেনি বলেই এই সমস্যা৷ কিন্তু আজ খাওয়ার কথা বলায় মেয়েটা খুব খুশি হয়েই এসেছে। কাঠ পুড়ছে ফট ফট শব্দ হচ্ছে কাঠ জ্বলার। বাতাসে ভেসে আসছে মৃদু সৌরভ জংলী ফুলের। মেহউইশ হাত পা মুড়িয়ে বসায় নাকের কাছে জ্যাকেটের হাতটা থেকেও একটা ঘ্রাণ আসছে। অচেনা সে ঘ্রাণে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। কিসের ঘ্রাণ এটা? কোন পারফিউম এর ঘ্রাণ এমন! পরিচিত নয় তবে ঘ্রাণটা বেশ লাগলো। এমন ঘ্রাণ আগেও কোথাও পেয়েছিলো সে। তবে তা শুধু একবারই পেয়েছিলো বলে মনে হলো। নাক টেনে সে ঘ্রাণ নিতে চোখ বুঁজে রইলো। রাইমা তার কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছে। একের পর এক গল্প সে তার ঝুলি থেকে বের করছেই। রিশাদ চারপাশে তাকিয়ে যখন মেহউইশের দিকে তাকালো, চোখদুটি তার যেন ঝলসে গেল মুহূর্তেই৷আগুনের আলোয় মেহউইশের মুখের রঙ বদলে দিয়েছে। বদলটা এতেটাই প্রখর তেজদীপ্ত যা অলৌকিক শক্তিতে ভস্ম করছে রিশাদকে। আজ এই প্রথম মনে হলো সে আবার নতুন কোন মোহে আটকা পড়ছে। এতগুলো দিনে কখনও এই মোহ তাকে ছুঁতে পারেনি অথবা তার মনের ওপর পড়া শয়তানী রাগের প্রলেপ ছুঁতে দেয়নি।রিশাদের তাকানো,তার নরম সুরে কথা বলা সব কিছুই মেহউইশের চক্ষুগোচর। তাই মনে মনে ভয় জাগছে অন্যরকম আজ। লোকটার মতিগতি ঠিক নেই আর একটা পুরুষ তার ঠিক কি কি প্রয়োজনে এমন আচরণ করে তা তার ধারণাতেই একটাই আছে কারণ। ‘দৈহিক আনন্দ’ ঠিক এই একটাই প্রয়োজনেই রিশাদের আচরণ সেই রাতে এমন নরম হয়েছিলো। আজও কি তবে এমন কিছু হতে চলেছে! শিউরে উঠলো গা বুকের ভেতর আত্মাটাও কাঁপছে তার।
বার বি কিউ পার্টি বলতে খাওয়া ছাড়া তেমন একটা আনন্দ কারোই হলো না। ঘুমানোর সময় বাঁধলো বিপত্তি দু’ঘরেই। রেহনুমার ঘরে এক খাটে ঘুমাতে হবে জেবুন্নেসা আর রেহনুমাকে। রেহনুমার মধ্যে আড়ষ্টতা আর জেবুন্নেসার ভেতর ক্ষোভ।অথচ তৃতীয় ঘরটিতে থাকার মত বাড়তি কম্বল নেই একজনকে আলাদা থাকতে দেওয়ার মত৷ রিশাদ অবশ্য সন্ধ্যায় শুনেই যেতে চেয়েছিলো কক্সবাজারে। হোটেলে এখনও অনেক নতুন আসবাব, কম্বল,বিছানাপত্র অনেক কিছুই আছে যা সে তার নতুন ফ্লোরের জন্য কিনেছিলো। কিন্তু জেবু কিংবা রেহনুমা কেউই চায়নি রাত করে তাকে বাইরে যেতে দিতে। বাধ্য হয়ে আজ রাত তাদের এক বিছানায় এক কম্বলে কাটাতে হবে।
রিশাদ আজ বিছানা নিজেই গুছিয়েছে। নির্জনকে শুইয়ে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একি! মেহউইশ তো সেই যে রান্নাঘরে ঢুকলো আর বের হয়নি৷ আজ কি সে রাতটা ওই রান্নাঘরেই কাটাবে!
চলবে