#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৪
#রূবাইবা_মেহউইশ
____________________
মধ্যরাতে স্ত্রীর দেহে মগ্ন হয়ে দৈহিক অবসাদ কাটিয়ে উঠার সুযোগ হলো না রিশাদের। রাত বারোটার ওপারে বন্ধু যখন ফোন দিয়ে বলল, ‘কিরে চলে গেলি ক্যান তোর জন্য বিরিয়ানি ফেলে একদম কাচ্চির ব্যবস্থা করেছি।’ তখন তার মনে হলো এই মধ্যরাতেই আবার উত্তরায় ব্যাক করা উচিত। অন্তত একটা নারী দেহের স্বাদ মেটানোর জন্য হলেও যাওয়া উচিত। সন্ধ্যায় যখন বন্ধুর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখলো ফ্ল্যাট ভর্তি মদের নেশায় মত্ততা অনেক গুলো ছেলে মেয়ের মাঝে তখনি ঠিক করেছে আজ রাত সেখানেই কাটাবে। বন্ধুর ফ্ল্যাটে আজ পার্টির নামে অশ্লীলতার বহর তাতে অনায়েসে একটা দেহ রাতের সঙ্গী হিসেবে নিতেই পারতো৷ আর তাই গাড়ি থেকে ল্যাপটপটাও নিয়ে এসেছে সাথে৷ বন্ধু সায়মনকে বলল, ‘আজ রাত এখানেই থাকবো পারলে একটা মেয়ের ব্যবস্থা কর।’ রিশাদের কথা শুনে সায়মন অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল৷ যে বন্ধু বিয়ের পর এক সেকেন্ডের জন্যও কোন মেয়ের হাত ধরেনি। এই যে নীলিমা ছেড়ে গেল কতদিন হয়ে গেছে তবুও একরাত বাড়ির বাইরে কাটায়নি সে আজ চাইছে এসব! সায়মন ঠাট্টা করে বলল, ‘ নীলামকে মিস করছিস বুঝি?’
‘ফালতু ওই বারো**** কথা আমার সামনে বলবি না। আমি ইমপোর্টেট না যে ওসবে যাবো না। বা** বিয়ে করে সৎ থাকার কথা বাপ বোঝাইছে বুঝছি এখন আর কোন দরকার নাই৷ ওর সুখ সয় নাই আমার সাথে পাঙ্গা নিতেই গেছে না ওই কুত্তার বাচ্চার সাথে থাকুক মইজ্জা। খালি ডিভোর্স নিয়া ভেজাল চলতেছে নইলে ওরে খুনও করে ফেলতাম এতদিনে।’ সায়মন কিছুটা ভয় পেল রিশাদের রিয়াকশন দেখে৷ নিশ্চিত কোন কারণে তার মুড বেশিই খারাপ নয়তো কি কথা থেকে কোথায় চলে গেল কেন! সায়মন আর না ঘাটিয়ে বলল তুই রেস্ট কর দশটার পর আরো অনেক মেয়ে,ছেলে আসবে। জোগাড় হয়ে যাবে। সায়মন বেরিয়ে যেতে নিলেই রিশাদ বলল, ‘ একটু বিয়ার কিংবা ভদকা কিছু দিয়ে যা তো আমি বারোটা পর্যন্ত একটু ঘুম দেবো। সায়মনও তাই করলো। কিন্তু রিশাদের ঘুম আর হলো না। সে ল্যাপটপে ছেলেকে দেখতে গিয়ে অনেকক্ষণ মেহউইশকে দেখলো। ভালো করে খেয়াল করলো সে মেয়েটি বয়সে তার চেয়ে পাঁচ থেকে সাত বছরের ছোট তো হবেই। কিন্তু একেবারে ছোট নয়। বিয়ের বয়স হয়েছে তার। দেখতেও দারুণ লাগছে। চোখ,নাক মুখ আকর্ষণীয় না হলেও মন্দ নয়৷ আবার চোখ পড়লো নির্জনের দিকে। মনে মনে আরও একটা কথা বাজলো, আমি কি চরিত্রহীন বাবা! এখানেই বোধহয় হৃদয় তার কলকব্জা নাড়িয়ে দিলো৷ সায়মন ভদকা, বিয়ার কিছুই দেয়নি দিয়েছিলো হুইস্কি টাইপ কিছু। রিশাদ নাম জানে না তবে সেটার স্বাদ নতুন ছিলো তার কাছে। ঝাজালো কিছু যা তার গলা বেয়ে নেমে বুকটা জ্বালিয়ে দিলো। কিছু সময় চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে রইলো রিশাদ। তারপর আবারও এক সিপ মুখে নিলো। এমন করেই কয়েক সিপ খাওয়ার পর রিশাদের কি মনে হলো কে জানে। সে বেরিয়ে গেল সায়মনের বাড়ি থেকে। ল্যাপটপ পড়ে রইলো সেই ঘরেই খাটের ওপর। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে চলে গেল রিশাদ। অনেকটা সময় ড্রাইভ করার পর তার মনে হলো সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। শহরের চেনা রাস্তা ছাড়িয়ে অচেনা কোন রাস্তায় চলে এসেছে। তখনই ফোন বাজলো রিশাদের। নম্বরটা এ দেশের নয়। সিডনি থেকে করা ফোন রিশাদের বাবার। রিশাদ গাড়ি থামিয়ে ফোন ধরতেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা সুরে ডেকে উঠলো বাবাকে, আব্বু।’
রাশেদ খানের বুকটা ধ্বক করে উঠলো ছেলের এমন আর্তসুরে। তারপরই মনে হলো রিশাদ কিছু খেয়েছে নেশা জাতীয়! রিশাদই আবার বলল, ‘ আব্বু আমি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। নির্জনকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কোথায়?’ এবার যেন রাশেদ খান নিশ্চিত হলেন ছেলে নেশা করেছে। তবুও ভয় থাকছে সে কোথায় আছে এই ভেবে। ছেলেকে তিনি যথেষ্ঠ আদুরে সুরে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি এখন কোথায় আছো একটু বলতো?’
– আব্বু আমি জানি না। চিনি না এই রাস্তা।
আচ্ছা আশেপাশে দেখো একটু জায়গাটা কেমন?
রিশাদ কাঁচ নামিয়ে গাড়ি থেকে বাইরে মাথা বের করলো। এটা কোন হাইওয়ে না ।এই রাস্তায় কোন নিয়ন আলো, দোকানপাটও চোখে পড়ছে না। তবে একটু পর পর একটা দুটো গাড়ি,বাইক সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এখানে অন্ধকার ভালোই আর অন্ধকার মানেই লুকিয়ে থাকা বিপদের আশংকা। রিশাদ তার বাবাকে কোন বর্ণনাই ঠিকঠাক দিতে পারলো না। রাশেদ খান নিজেই এবার ছেলের লোকেশন সার্চ করতে লাগলেন। রিশাদের গাড়ি এবং ফোন দুটোতেই লোকেশন সার্চ করা যায় এমন ডিভাইস আগে থেকেই ছিলো। রিশাদ নিজে সতর্ক মানুষ এসব ব্যপারে। দেশ থেকে কোটি মাইলের দূরত্বে থেকে রাশেদ খান পাগল হয়ে গেলেন ছেলের সেফটি নিয়ে। প্রথমে রিশাদের ড্রাইভার এবং পরে রিশাদের পরিচিত পুলিশ কাইয়ূমকে খবর দিলেন। পঁচিশ মিনিটের মাথায় কাইয়ূম এসে পৌছুলো রিশাদের কাছে। রাত বিরেতে বড়লোকের কামলা খাটা বড্ড কষ্ট দেয় কাইয়ূমকে কিন্তু পরিবারের অতিরিক্ত সাধ,আহ্লাদের খাতিরে মানতে হয় এসব গোলামি। আর রিশাদ একটু বেশিই জ্বালায় তাকে। তবুও মুখ বন্ধ রেখে রিশাদের বাবার দেওয়া লোকেশনে এসে রিশাদকে খুঁজলো। গাড়ি পেলেও রিশাদ গাড়িতে ছিলো না। আবারও দশ মিনিট ধরে রিশাদকে গাড়ির আশেপাশের জায়গায় খুঁজে মনে মনে কিছু খিস্তি দিলো। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত কাইয়ূমের কাঁধ চেপে ধরতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো সে। রিশাদ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি কান্ড মাটিতে বসে। কাইয়ূম বার কয়েক জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার আপনি এখানে কেন?’
রিশাদ বিড়বিড় করে কোন জবাব দিলো কিন্তু বোঝা গেল না কিছুই। ততক্ষণে রিশাদের ড্রাইভার এলো এক সি এনজি ভাড়া করে। কাইয়ূম আর ড্রাইভার মিলে রিশাদকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। কাইয়ূম থানার গাড়িতে করেই গেল আর ড্রাইভার সিএনজি বিদায় করে রিশাদের গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরলো। রাত তখন দশটা পেরিয়ে। মেহউইশকে যখন জেবুন্নেসা নিজের ঘরে ডেকেছেন তখন রিশাদ বাড়ি পৌঁছে গেছে। সে নিচ থেকে দোতলায় যাওয়ার পথেই মেবিশ, মেবিশ বলে ডেকেছিলো। মেহউইশ যখন রিশাদের দরজার সামনে তখন আধ মাতাল রিশাদ ঘর থেকে আবার বের হচ্ছিলো আর সেখানেই দু জনের ধাক্কা লাগে। মেহউইশ ছিটকে পড়ায় রিশাদ দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যায়।
‘দেখি দেখি কতখানি লাগলো, আহা আমার বউটা ব্যথা পেল আমার দোষে।’
রিশাদের কথা শুনে চমকে তাকায় মেহউইশ। কটু একটা গন্ধ নাকে বারি খায় তার কিন্তু এতেও সে অতোটা বিচলিত হয় নি যতোটা রিশাদের কথা শুনে হয়েছে। সে টিভিতে অনেকবার দেখেছে নেশা করলে মানুষ বিপরীত আচরণ করে। তবে কি রিশাদের এমন কথার পেছনেও তেমন কোন কিছু খেয়েছে! হাসপাতালে কাজের মাধ্যমেই সে এলকোহলিক অনেক ব্যপার দেখেছে। ঠিকঠাক বুঝতে না পারলেও ধারণা হচ্ছে রিশাদ তীব্র নেশাজাতীয় কিছু খেয়েছে। ভয় লাগলো তার রিশাদের দিকে তাকিয়ে । নেশাগ্রস্ত মানুষ জন্তুর ন্যায়। যে কোন বিপদজনক কাজ তার মাধ্যমে হওয়া অস্বাভাবিক না৷ মেহউইশ ঝট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো৷ নির্জন আয়ার কাছে আছে যে করেই হোক এখন ওই বাচ্চাটা কাছে থাকাই তার জন্য ভালো কিছু। সে পা বাড়ালো নিচে যেতে আর তখনি রিশাদ মেহউইশের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘরে। দরজা বেজিয়ে দিয়েই মেহউইশকে বলল, ‘শাড়ী খোলো।’
বন্ধ মুখ খুলে গিয়ে বিশাল এক হা করে তাকালো মেহউইশ৷ সে শাড়ী পরলো কোথায়! এই লোক কি পাগল হয়ে গেল? রিশাদ নিজেই আবার ওড়না টেনে বলল, ‘তুমি আমার বোনের জামা পরেছো কোন সাহসে?খোলো সব৷ আর কেমন বউ তুমি নীলিমা স্বামীকে কত্তগুলো দিন ধরে আদর করো না? আজকে আদর না করলে আমি অন্য মেয়ের কাছে যাবো মনে রেখো।’
মেহউইশ ভয়ে না যতোটা বাকহারা ছিলো তার চেয়েও বেশি হলো রিশাদের কথা শুনে। এদিকে রিশাদের এগ্রেসিভ আচরণ আটকানোও মুশকিল হচ্ছে তার পক্ষে।মনে মনে নিজের মুক্তি কামনায় আল্লাহকে ডাকছে। আবার ভাবছে, ‘একেই কি ধর্ষণ বলে!’ নাহ মেহউইশের বিপদ আল্লাহ খুব সহজেই কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট নির্জনের মাধ্যমে। নির্জন কাঁদছে খুব এবং সেই কান্নার আওয়াজ দরজার বাইরে থেকেই আসছে। রিশাদ মেহউইশের বাহু চেপে ধরেছে চুমু খাবে বলে কিন্তু ছেলের কন্ঠস্বর যেন তার হাতের শক্তি শুষে নিলো। ধীরে ধীরে হাত আলগা হয়ে গেল তার। মেহউইশের দিকে তাকিয়ে কাতর কন্ঠে বলল, ‘ইচ্ছে করেই নির্জনকে ডেকেছো এখানে?’ মেহউইশ ভেবে পায় না নেশাগ্রস্তরা কি কারো কান্না অনুভব করতে পারে নাকি এই লোক পুরোপুরি নেশা করেইনি! নিজের ওপর থেকে রিশাদকে জোর করেই সরিয়ে দিলো সে। ফ্লোর থেকে ওড়নাটা কুড়িয়ে ভালোমতো গায়ে পেঁচিয়ে ঘর থেকে বের হলো৷ দরজা থেকে একটু সামনে আয়া দাঁড়িয়ে আছে আয়া। তারমানে মহিলা তাদের দস্তাদস্তি সবই টের পেয়েছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন মেহউইশের। মাথার চুলগুলোও এলোমেলো ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা তবুও কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। আয়া মহিলাটি মধ্য বয়স্ক সে মেহউইশকে বুঝতে পেরেই হয়তো বলল, ‘ আমি কি ওকে আমার কাছে রাখবো?’
‘নাহ।’ মেহউইশ হাত বাড়িয়ে নির্জনকে নিলো। আর কোন কথা না বলে সোজা ঘরে ঢুকে দরজা লাগালো। বুক ভাঙা কান্নার ঢেউ গলা অব্ধি এসে আটকে গেছে তার। পরিস্থিতি তাকে কোন পর্যায়ে এনেছে! কে এই লোক, কেন এলো তার জীবনে! অর্থের প্রয়োজন তার সর্বকালেই ছিলো কিন্তু প্রাপ্তি কি এমন করে না হলেও পারতো না! রিশাদ চোখ বুঁজে পড়ে আছে বিছানায়। ঘুমিয়ে গেল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তার দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় মুখ বেঁকে এলো তার। এরপর মেহউইশ আর ঘরে বসেনি। নির্জনকে খাইয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে রইলো কাউচের ওপর। বাচ্চাটা বড় শান্ত চরিত্রের হয়তো তার মা এমনই ছিলো। নয়তো এত ছোট বাচ্চাকে সে এতো সহজে রাখতে পারতো না। রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই তখন রিশাদের পকেটে তার ফোন ভাইব্রেট হতেই ঘুম ভাঙলো তার। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলো ঘরে সে একা। ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই সায়মনের গলা ভেসে আসলো, কিরে চলে গেলি ক্যান তোর জন্য বিরিয়ানি ফেলে একদম কাচ্চির ব্যবস্থা করেছি।’
রিশাদের তখনও তেমন কাটেনি নেশা। সে অনেকটা ঘোরের মধ্যেই বলল, কাচ্চি খাবো না ডাল,ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।’
চলবে