মন গহীনের গল্প পর্ব- ৪৫

0
1479

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৪৫
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
দুপুরের রোদ মরে যাওয়ার আগেই পাহাড়ের খাঁজে খাজে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। চকচকে রোদ ফিকে কমলায় বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে সেই সাথে শিরশিরে শীতল বাতাসের অনুভূতি হচ্ছে ত্বকে। রিশাদ তৈরি হয়েছে আরো আগেই। আজকে সে প্রতিদিনের চেয়ে একটু আলাদা করে তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনকার সাদা,কালো রঙ ছেড়ে গায়ে দিয়েছে শ্যাওলা রঙের শার্ট আর জিন্স। হাতে সবসময়কার ঘড়ি আর আজকে জুতোর দিকে তার নজর নেই। বাড়িতে পরার স্লিপার পরেই দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি রকমের বড় চুলগুলিকে দুবার চিরুনির মত করে আঙ্গুল বুলিয়ে নিলো। তীক্ষ্ণ ধারালো চোয়ালজোড়া আজ কোমলতায় যেন বদলে নিয়েছে রুপ। মনের ভেতরে থাকা কিছু ভয় ভেতরের সবকিছুকে তছনছ করছে তার প্রত্যেক মুহুর্তে। মেহউইশের ক্ষমাই একমাত্র উপায় তার ভেতরকার হাহাকার দূর করার। আজ তাই এই পরিকল্পনা তার।

-‘আমরা তৈরি ‘ বলেই মেহউইশ নির্জনের আঙ্গুল ধরে রিশাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহউইশের ঠোঁট জুড়ে প্রশস্ত হাসি আর নির্জনের ছোট্ট কপাল জুড়ে বিরক্তি৷ এই বিকেলে সে রোজকার মত দৌঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলো। কিন্তু বাবার কারণে তাকে এখন মা খেলতে দিচ্ছে না । মোটা জ্যাকেট,মোজা,কেডসে মুড়িয়ে ফেলেছে৷ শীত শীত সন্ধ্যাও সে এসব কাপড় পরতে চায় না। অথচ বাইরে যাবে বলে মা ধমক দিয়ে এখনি সব পরিয়ে দিয়েছে। রিশাদ গভীর নজরে দেখে নিলো একবার তার বউ আর ছেলেকে। দুজনেই পরেছে শ্যাওলা সবুজ রঙের পোশাক। আশ্চর্য! মেহউইশ কি তার শার্টের সাথে মিল করেই এসব পোশাক পরেছে! এগুলো সে কবে কিনেছে? রিশাদ আগে কখনও মেহউইশের এই শ্যাওলা সবুজ কামিজটা দেখেছিলো কিনা মনে পড়লো না তবে নির্জনের জ্যাকেটের ভেতরে পরা গেঞ্জিটা সে নিজেই এনেছিলো কদিন আগে৷ সবাই তৈরি দেখে রেহনুমা তাড়া দিলো সন্ধ্যে হয়ে আসছে জলদি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ;রিশাদও আর দেরি করলো না। গাড়িতে বসে মেহউইশ জানতে চাইলো তারা কি কাল সকালেই চলে আসবে হোটেল থেকে না সারাদিন ঘুরবে? রিশাদ মনযোগে ড্রাইভ করতে থাকলো কোন জবাব দিলো না৷ বলা যায় সে অন্যমনস্ক থাকায় শুনতেই পায়নি মেহউইশের কথা। গাড়ি চলছে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। পাহাড় কাটা এই রাস্তার একপাশে শতফুট দীর্ঘ খাদ অন্যপাশ উঁচু পাহাড়ে ঘেরা৷ চারপাশে সবুজের সমারোহ উপরে নীল আকাশের অসীম চাদর। সেই চাদরে কোথায় কোথায় সাদা মেঘের নকশা কখনো’বা সেই নকশায় মেঘের ধূসর,কালছে অথবা ছাইরঙা৷ পাহাড়ের গায়ে অজস্র বৃক্ষ আর পশুপাখির বাস, কোথায় কোথায় বুনোফুলে সুগন্ধি হয় পাহাড়ের বুক৷ এত ঐশ্বর্য, এত রুপ মাধুরী নিয়েই এই পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে বুক চিতিয়ে। মেহউইশ ভাবছে এত সৌন্দর্যের মাঝে তার জীবনেও কমতি নেই কিছুরই। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলেই সে স্বস্তি পেল। কিন্তু রিশাদ কেন মনমরা হয়ে আছে? আজকাল রিশাদকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। মানুষটা ভীষণ অন্যরকম। শুরুর দিনের রিশাদের সাথে এই রিশাদের খুব একটা মিল পায় না এখন। প্রথম দিনের মত ভয়টাও আর পায় না তাকে৷ রিশাদের প্রতি ভালোলাগার নরম, উষ্ণ চাদর পড়েছে মেহউইশের মনে৷ সে নিজেকে শতভাগ গ্যারান্টি দেয় রিশাদকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না তবুও কেন জানি আজকাল তাকে ভালো লাগে। তবুও সে নিজেকে আশ্বাস দেয় এটা শুধুই ভালে লাগা৷ একসাথে থাকার অভ্যাস থেকে তৈরি ভালোলাগা, মানুষ হিসেবে রিশাদের একাকীত্বে সহানুভূতি দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়৷ আদৌও কি তাই! গাড়ির ব্রেক কষতেই মেহউইশের উড়ো ভাবনারা ছিটকে সরে গেল বহুদূরে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলো এটা তাদের হোটেল নয়। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখলো এটা তাদের হোটেলের চেয়েও বড় এবং নাম দেখে বুঝতে পারলো এই হোটেলটা বেশ নামীদামী । এখানে অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও আসেন খুব৷ কিন্তু হঠাৎ এই হোটেলে ঘুরতে আসা, নিজের থাকতেও অন্যের হোটেলে এটার মানে খুঁজে পেল না সে।

‘তুমি নির্জনকে নিয়ে রিসেপশন থেকে চাবি নাও আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি। মিস্টার এন্ড মিসেস রিশাদ বললেই হবে বুকিং দেওয়া আছে।’ রিশাদ কথাটা বলতেই মেহউইশ চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলো। রিশাদ বলে দিলো এন্ট্রি ডোর লেখা আছে যে দরজায় সেদিক দিয়ে প্রবেশ করে বায়ে রিসেপশন৷ মেহউইশ কিছু বলল না চুপচাপ সে নির্জনকে কোলে নিয়েই হেঁটে গেল রিশাদের বলে দেওয়া রাস্তায়। রিসেপশনে চাবি নিতেই দেখতে পেল বাংলাদেশী এক টিভি তারকা। মেহউইশের মোটামুটি পছন্দেরই এই পুরুষ তারকা । মেহউইশ দেখলো কয়েক পলক অথচ নিজের মধ্যে কোন উত্তেজনা অনুভব করলো না এই পছন্দের তারকাকে দেখে। তিশমাক প্রথমবার কাছ থেকে দেখতে পেয়ে যতখানি চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো তার সিকিভাগও এখন অনুভব করলো না। কিন্তু কেন! উত্তর খুঁজে পেল না সে৷ রিসেপশন থেকে ডোর কার্ড নিয়ে চলে গেলো হোটেলের চতুর্থ তলায়। তাদের রুম নম্বর তিনশো তিন। সে লিফট ব্যবহার করে রুমে পৌঁছে বসে পড়লো বিছানায়। রিশাদের চোখে মুখে আজ অন্যরকম নমনীয়তা চোখে পড়েছে তার। সবসময় রাগী কিংবা বদমেজাজি রিশাদের চোখে মুখে যে অলৌকিক এক দ্যুতির আস্তরণ থাকে তা আজকের রিশাদে নেই। এখানেই যত ভাবনা তার। সকালেও মানুষটার রূপ আগের মতোই লেগেছিলো দুপুরে হঠাৎ কি হলো! দরজায় করাঘাত শোনা গেল। লুকিংগ্লাসে তাকিয়ে দেখলো মেহউইশ দরজায় রিশাদ আছে। দরজা খুলতেই সে ধমকে উঠলো, ‘ বোকা মেয়ে মাথায় কি বোধবুদ্ধি কিছুই নেই?’

‘কেন!’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো মেহউইশ।

‘কেন আবার কি? তুমি ফোন গাড়িতে ফেলে এসেছো এদিকে চাবি নিয়েও রিসেপশনে অপেক্ষা করোনি। আমি কি করো জানবো কথায় তোমরা?’ রিশাদের কথা শেষ হতেই মেহউইশ এবার ভয় না পেয়ে বলল, ‘এখন কি করে পেলেন?’

‘রিসেপশনে জিজ্ঞেস করেছি।’ রিশাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

‘তো এত চিল্লানোর কি আছে। আর বুদ্ধিহীনতারই’বা কি আছে!’

রিশাদ আর কথা বাড়ালো না। হাতে তার ছোট্ট একটা ব্যাগ দেখে মেহউইশ জানতে চাইলো কি আছে ওটাতে?

‘আমাদের কাপড়চোপড়।’

-‘ক’দিন থাকবো আমরা!’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো মেহউইশ।

‘কালকেই চলে যাবো কিন্তু তাই বলে তো আর এক কাপড়েই থাকবো না। ‘

-‘কাপড় গোছালেন কখন?’

-তুমি গোসলে যখন গেলে তখনি গুছিয়ে গাড়িতে রেখেছিলাম।’ দুজনের কথার মাঝেই দরজায় নক পড়লো। রিশাদ দরজা খুলে কফি আর দুধের গ্লাস সমেত ট্রে নিলো একজন বেয়ারার হাত থেকে। রিশাদ নিজেই অর্ডার করে এসেছিলো এগুলো। এখন একটু রেস্ট নিবে তার আগে একটু কফি দরকার এমনটা ভেবেই সে এগুলো অর্ডার করেছিলো৷ মেহউইশ কফি দেখেই নাক কুঁচকালো।

হোটেলে উঠেই সন্ধ্যে মুহূর্তে চমৎকার এক ঘুম দিয়েছিলো মেহউইশ নির্জনকে নিয়ে। তাদের ঘুম দেখে রিশাদের ভালো লাগলো কিন্তু তার চোখে ঘুমের ছিঁটেফোটাও ছিলো না কোথাও। একা একা বোর হওয়ার চেয়ে একটু কাজ করাই উত্তম মনে হলো তার তাই তাদেরকে লক করেই চলে গেছে নিজের হোটেলে। এই দুই মা,ছেলের ঘুমের মাত্রা তার ভালোই জানা৷ তাই নিশ্চিন্তে নিজের হোটেলে ঘুরে ঘুরে প্রয়োজন, অপ্রয়োজনের কাজগুলো দেখে এসেছে। রাতে যখন ঘুম ভাঙলো মেহউইশের রিশাদ তখন খাবারের অর্ডার দিলো। রুমে বসে দারুণ সব খাবারে মেহউইশের মন ভরে গেল তৃপ্ততায়। আর রিশাদ ভাবছিলো কথাটা কেমন করে শুরু করবে! তার পেটে খাবার ভাবনা ঢুকে বুদবুদ করতে লাগলো। রুমের জানালা খোলা থাকায় সামুদ্রিক নোনা হাওয়া জানালার পর্দা উড়িয়ে পতপত শব্দ তুলল। রিশাদের নিঃস্তব্ধতায় শোরগোল করতে লাগলো সেই ছন্দময়ী বাতাস। অনেক খুঁজেও সে তার ভাবনার কিনারা পেল না। জীবনে অন্যায় অনেক করলেও কখনো ক্ষমা চাওয়া হয়নি কারো থেকে। ক্ষমা কি করে চাইলে ক্ষমা পাওয়া যায় সে ধারণা তার অভিধানেই নেই৷ দ্বিধা, লজ্জা সংকোচে ঘাড় নুয়ে এলো তার তবুও এলো না কোন উপায়। রাতের প্রথম প্রহরে সৈকত ভ্রমন পাশাপাশি হেঁটে, এবং মধ্য প্রহরে হোটেল কক্ষে দারুণ সব ফুল দিয়ে সাজানো রুম । মেহউইশ রুমে ঢুকেই অবাক হয়েছিলো। রিশাদ এক পা দু’পা করে কাছে এসে দাঁড়ালো মেহউইশের। ঠোঁটে বাঁকিয়ে হাসিকে আমন্ত্রণ জানিয়েই মেহউইশের হাত দুটো ভরে নিলো নিজের হাতে। নির্জন ঘুমিয়েছে একটু আগেই৷ তার দিকে ইশারা করেই রিশাদ কথা শুরু করতে চাইলো আর তখনি আচমকা ফায়ার সাইরেন বাজতে লাগলো৷ চমকে উঠে রিশাদ দ্রুত রুমের দরজা খুলল৷ সাইরেনটা চতুর্থ তলারই কোন এক রি্ুমেই বাজছে৷ বিপদের আশঙ্কা দেখেই রিশাদ বিছানায় থাকা নির্জনকে বুকে তুলে নিলো। একহাতে নির্জন আর অন্য হাতের মুঠোয় মেহউইশের হাত চেপে দৌঁড়ে বের হলো রুম থেকে৷ লিফটের পাশেই সিঁড়ি। কোন দিকে না তাকিয়ে যতোটা দ্রুত সম্ভব প্রতিটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে পেরিয়ে যাচ্ছে রিশাদ। ততক্ষণে শুধু চতুর্থ তলায়ই নয় প্রতিটি তলার মানুষ হামলে পড়েছে সিঁড়ির দিকে৷ প্রাণপনে ছুটতে চাইছে রিশাদ তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে৷ যেন কোন বিপদের অগ্নিশিখায় আপন কাউকে না হারাতে হয়। যতোই এগোচ্ছে ততোই ভাবছে এই বুঝি সে হারিয়ে ফেলল তাদের৷ নিজের দীর্ঘ একলা জীবনের চরম শূন্যতা আবারও আসবে কাছে আবারও নতুন করে তাকে ধ্বংস করতে। ছুটতে ছুটতে আল্লাহর কাছে প্রাথনা করলো। কিন্তু কি আশ্চর্যজনক কথা এমন বিপদে সে জানেই না কোন দোয়াটা পড়তে হয়। দোয়া পড়লে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ডাক শুনবে! অথচ সে এমন এক মূর্খ মানব যে নিজের ধর্মের কিছুই জানে না। আফসোস হলো খুব নিজের এই বহুদা জীবন নিয়ে।

চলবে
(ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে লিখছি পর্বটা 😑 ভুল ত্রুটি কিন্তু ক্ষমার যোগ্য)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here