মন তুমি ছুয়ে দেখো না পর্ব ৩৬

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৬
দিনটা ভালোই কেটেছিলো অথৈয়ের।আতিক মাহাবুব খুব জলদিই ফিরে এসেছিলেন।সারাটাদিন বেশ আনন্দে কেটেছিলো ওর।এই বাড়িতে একেবারে আসার পরের দিনগুলো যে এইভাবেই আনন্দময় হয় সেই দোয়া করল অথৈ।তবে রুদ্রিক ওকে চুমু খাওয়ার পর থেকে অথৈ ভুলেও আর রুদ্রিকের কাছে যায়নি।লজ্জায় সে দূরে দূরে থেকেছে।চোখ তুলে তাকায়নি অবদি।রুদ্রিক দু তিনবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলো।কিন্তু মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জা পাচ্ছে।এই কারনে রুদ্রিক আর ঘাটায়নি অথৈ। সন্ধ্যার একটু আগে অথৈয়ের বাসা থেকে ফোনকল আসায়।রুদ্রিক অথৈকে তাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছিলো।অথৈ নিজের লজ্জাকে ক্ষানিকটা সময়ের জন্যে দূরে সরিয়ে।রুদ্রিককে বলেছিলো,’ বাড়িতে আসুন নাহ।মা খুশি হবে।’

রুদ্রিক তখন শীতল গলায় উত্তর দিয়েছিলো,’ গিয়েই কি লাভ?তুমি লজ্জায় আমার দিকে তাকাচ্ছই না।তোমাদের বাড়িতে তো তোমার টিকিটাও আমি খুঁজে পাবো না যেই অবস্থা দেখছি।সামান্য চুমু খেয়েছি।এতেই লজ্জায় একেবারে পারলে মাটি খুরে তার নিচে চলে যাও।বিয়ের পর যে আমি তোমার সাথে আরও কি কি করব।সেগুলো তোমাকে বললেও তুমি লজ্জায় জ্ঞান হারিয়ে না ফেলো।তাই যাও বাসায় যাও।আর যদি আমাকে তোমাদের বাড়িতে এতোই নেওয়ার শখ থাকে।তাহলে স্বামীকে কিভাবে আদর যত্ন করতে জানো তো?সবটা করতে হবে।কি করবে?তাহলে বলো আমি আসছি।’

রুদ্রিকের একেকটা লাগামহীন বাক্য অথৈ বাকরুদ্ধ।এই লোকটা তাকে অনায়াসে এইভাবে এতোগুলো কথা তাকে নির্লজ্জের মতো বলতে পারলো?অবশ্য কাকে নিয়ে কি ভাবছে অথৈ। রুদ্রিক যে কেমন মানুষ তা এই কয়দিনে বেশ ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে ও।অথৈ নিজের লজ্জা ঢেকে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে উঠে,’ ছিঃ অসভ্য কোথাকার।যান তো আপনি।বাড়ি চলে যান।’

এই বলে অথৈ হনহন করে বাড়ির ভীতরে চলে গেলো।পিছন থেকে শুনতে পেলো রুদ্রিকের প্রাণখোলা হাসি।অথৈ ফিরে গিয়ে আবার দেখতে ইচ্ছে করল রুদ্রিকের হাসিটা।কিন্তু এখন গেলে যে এই লোক তাকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। এই ভয়ে আর গেলো না।সোজা নিজের রুমে চলে গেলো আগে।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে রুদ্রিকের গাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে তারমানে লোকটা যায়নি।অথৈ রুদ্রিককে মেসেজ করল,’ বাড়ি চলে যান।আর যদি ভদ্র আর সভ্যভাবে আমার সাথে থাকতে পারেন।তবে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন।’

মিনিট দুয়েক পর মেসেজের রিপ্লাই করল রুদ্রিক।
‘ তুমি আমার কাছে থাকবে, আমার পাশে থাকবে।আর আমি আসলে তো আজ তোমার সাথে আমাকে ঘুমোতেও হতে পারে।আম রেয়েলি ভেরি সরি বউ।তোমার সান্নিধ্যে থাকলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না।আর নিজেকে ভদ্র, সভ্য কোনোকালেই ভাবি না।অন্তত তোমার কাছে তো নাই-ই।তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।ভালো থেকো।হ্যাব অ্যা সুইট ড্রিম উইথ মি।’

মেসেজটা পড়ে অথৈ লজ্জাও পেলো।আবার একরাশ ভালোলাগায় হৃদয় জুড়িয়ে গেলো।অথৈ ছোট্ট করে উত্তর দেয়,’ সাবধানে বাড়ি যাবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’

পর পর অথৈ বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখে রুদ্রিকের গাড়ি চলে যাচ্ছে। মুঁচকি হাসি ফুটে উঠে অথৈয়ের। ও সত্যিই খুব ভাগ্যবান। রুদ্রিককে ও স্বামী রূপে পেয়েছে।

ক্লাসরুমে বসে বসেই গতকালকের ঘটনা ভেবে মুচঁকি মুচঁকি হাসছিলো অথৈ। ওকে এইভাবে অহেতুক হাসতে দেখে পিহু দু তিনবার ডেকেছে ওকে।নাহ, এই মেয়ের কোনো হেলদোল নেই।পিহু এইবার জোড়ে জোড়ে অথৈয়ের বাহু ঝাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,’ ওই ওই ওই।কিচ্ছে তোর?কোন দুনিয়ায় আছস?এইযে আমি তোরে ডাকতেছি।শোনস না?’

আকস্মিক পিহু এমন ঝাকানোতে ভয় পেয়ে যায় অথৈ৷ পর পর নিজেকে সামলে নিয়ে রাগি গলায় বলে,’ বান্দর মাইয়া।এমনে ধাক্কায়তাছস কেন?আমি কি বয়রা?কানে শুনি নাহ?’

আবার প্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,’ এতোদিন তোরে বকতাম এই পিহুর সাথে ঝগড়া করার জন্যে।এখন মনে হচ্ছে তুই যা করছ।একদম ঠিক করছ।এই প্রিয়াইন্না?ওর কানের নিচে খিচ্চা একটা থাবড়া মার তো।’

প্রিয়ান দূর থেকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারল।মানে এটা যে ‘ বান্ধবী এক মাত্র তুই আমার মনের কথা বুঝতে পারছ।’

কিন্তু আবার ভাবলো।যতোই হোক যেমন হোক এই পিহুকেই তা লাগবে।মরবার আগ পর্যন্ত ওর সাথে থাকতে যায়।এমনে না হোক।অন্তত সারাটাদিন ঝগড়াঝাটি করতেও ওকে চাই প্রিয়ানের।ভেবেই প্রিয়ান মুচঁকি হাসলো।
তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,’ ঘাড়ে আমার কয়টা মাথা?এইডাড়ে চড়াইলে এই ডায়নি আমার মাথা কেটে রক্ত খেয়ে ফেলবে।’

এদিকে দুই পক্ষের এতো এতো অপমানে রাগে ফোসফাস করছে পিহু। নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে রাগি গলায় বলে,’ আমি কিছু বলতাছি জা দেইখ্যা তোরা আমারে এমনে অপমান করতাছস?এই তোরে কি আমি খারাপ কিছু বলছি?ভালো মতো ডাকতেছিলাম শোনছ নাই।তাই তো এমনে ধাক্কা দিতে হলো।আর এই তুই প্রিয়ান।আমি আগে তোর সাথে লাগতে যাই তাই নাহ?একটু পরই দেখা যাবে কে কাকে আগে ক্ষ্যাপায়।তোর মাথা আমি সত্যি সত্যি দুই টুকরা করে ফেলমু।’

প্রিয়ান শুকনো ঢোক গিলল পিহুর কথায়।বিরবির করে বলে,’ মাইয়া না জানি আগুন।রাগের তোপে যেমন করতেছে মনে হয় এখনই আমারে ড্রাগনের মতো মুখ থাইকা আগুন মাইরা জ্বালায় ফালাইবো।’

ওদের ঝগড়ার মাঝে রিধি ঢুকে পরল।ও বলে,’ এই অথৈ? কিছু কি ভেবেছিস কালকের বিষয়ে?’

অথৈ ভ্রু-কুচকালো রিধির কথায়।পর পর মনে পরে গেলো গতকাল সে সবাই মিলে একটা ট্যুরের দেওয়ার প্লান করেছিলো ও।কিন্তু রুদ্রিকের ভাবনায় ও এতোই বিভোর গয়ে গিয়েছিলো। যে বিষয়টা ওর মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর ভাই।অথৈ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,’ কি আর বলব বল?আমি তো কাল ভাইয়ার সাথে রাগ করে আর কথাই বলিনি।’

আহিদ উঠে দাঁড়ালো।পকেটে হাত গুছে বলে,’ তাহলে চল এখনই কথা বলে আসি। ভাইয়ার বন্ধুরা তো সবাই রাজি।’

‘ হুম চল তাহলে। দেখা যাক উজবুকটা কি বলে।এই রিধি এই গাধার কি দেখে ভালোবাসলি রে?’

অথৈয়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় রিধি।পরপর হালকা হেসে বলে,’ ভালোবাসা তো আর বলে কয়ে হয় না রে অথৈ। কখন?কাকে?কিভাবে? ভালোবেসে ফেলি নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারি না।কখন মনটা যে অন্যকারো অধিনে চলে যায়।বুঝতে পারিনি।যদি পারতাম তবে এই বেহায়া মনকে সেই কবেই মনের মাঝে বন্দি করে রাখতাম।তাহলে ভালোবেসে যে আমায় সেই ভালোবাসার আগুনে তিলে তিলে জ্বলতে হতো না।এখন আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে না পারছি সেই আগুন থেকে বের হয়ে আসতে।আবার না পারছি সেই আগুনে এইভাবে জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে।তবে তোর ভাই হয়তো একদিন আমাকে এইভাবে পোড়াতে পোড়াতে ছাই করে নিঃশেষ করে দিবে।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হতাশ শ্বাস ফেলল রিধি।চাপা কষ্টে রিধির বুকটা ফেটে যাচ্ছে।একটু কাঁদলে কি সস্তি পেতো?কিন্তু সে তো কান্না করবে না।দূর্বল হবে না আর সে।ইহানের সাথে করে পিকনিকে গিয়েছিলো ওইদিন ওর সাথে যা হয়েছে। এরপর ও ডিসাইড করে নিয়েছে।ভালোবাসার জন্যে পিছু পিছু ছুটবে না ও আর ইহান যদি ওর ভাগ্যে লিখা থাকে।তাহলে ইহান ওরই হবে।আর না হলে তো করার কিছু নেই।আজীবন এই ভালোবাসার দহনে সে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকবে।পুড়তে থাকবে।যেদিন দেখতে না পারছে না।সেদিন বিলীন হয়ে যাবে।রিধি চোখের কোণে জমা হয়ে অশ্রুবিন্দুটা মুছে নিলো।অথৈয়ের খারাপ লাগছে রিধির জন্যে।ও ভাবতে পারেনি রিধি এতো কষ্ট পাবে।অথৈ মন খারাপ করে বলে,’ আমি সরি রে। আমি তোকে এইভাবে হার্ট করতে চায়নি।’

রিধি নিজের কষ্টটুকু লুকিয়ে ফেলল।না,তার এইভাবে ইমোশনাল হলে হবে না।নিজেকে সামলাতে হবে।রিধি জোড়পূর্বক হেসে বলে,’ আরেহ তুই কেন সরি বলছিস?আমিই একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম।মন খারাপ করিস না তো।চল এখন যাওয়া যাক।’

ওরা সবাই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসল।বাহিরে আসতেই হঠাৎ আহিদের নজর যায়।একা একা করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা মাইশার দিকে।এই মেয়ে এইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে আছে কেন?আর মুখটাও মলিন দেখাচ্ছে।তবে লাল হয়ে আছে চেহারা,চোখ দুটো যেন নিষ্প্রাণ।মেয়েটা কি অসুস্থ?কিছু কি হয়েছে ওর? আহিদ কি একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করবে?কিন্তু কিভাবে যাবে?এখানে বন্ধুরা আছে।না, যতোই হোক মেয়েটার কাছে যেতে হবে।মেয়েটার ওই মলিন মুখশ্রী দেখে মুখের বা-পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে।আহিদ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমতা আমতা করে বলে,’ ইয়ে মানে।তোরা যা ইহান ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্যে।আমি একটু আসছি।’

রিধি ভ্রু-কুচকে বলে,’ কোথায় যাবি তুই আবার?’
‘ একটু কাজ আছে জরুরি।তোরা যা না।’

অথৈ বলে উঠে,’ আচ্ছা তুই যা তোর কাজে। সমস্যা নেই।আমর ম্যানেজ করে নিবো।’

আহিদ চওড়া হাসে।তারপর নিজ গন্তব্যে চলে যায়।ও যেতেই অথৈ সন্দিহান গলায় বলে,’ ওই আহিদ্দার মাঝে কোনো ঘাপলা আছে। আজকাল ওর মতিগতি অন্যরকম ঠেকছে।’

‘ কিন্তু কি?’ প্রশ্ন করল প্রিয়ান।
অথৈ চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,’ সেটাই তো আমাদের জানতে হবে।ও এমন হুটহাট গায়েব হয়ে যায়টা কোথায়? প্রিয়ান পাতা লাগাও, পাতা লাগাও।’

অথৈয়ের এই কথায় পিহু মাথা চুলকে বলে,’ শুনেছি গাছ লাগায়। কিন্তু এই পাতা লাগাবে কিভাবে?এই প্রিয়ান তুই পাতা লাগাতে জানিস?’

রিধি ফিঁক করে হেসে ফেলল।অথৈ দাঁতে দাঁত চিপে বলে,’ তুই ইচ্ছে করে এসব বলিস তাই নাহ?’

পিহু সবকটা দাঁত কপাটি দেখিয়ে হেসে দিলো।অথৈ সহ এইবার বাকিরাও হেসে দিলো।আসলেই বন্ধু মানে তোমার লাইফটা একেবারে সেরা।বন্ধুরা একসাথে থাকলে যেন দুঃখরা কাছেই ঘেষতে পারে না।চারদিকে শুধু হাসির কলরব প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়।কি যে শান্তি এতে।তাই বন্ধুদের সবসময় আগলে রাখতে হয়।বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় করতে।তাহলেই না হবে অটুট বন্ধুত্বের বন্ধন।

#চলবে___________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।আমি একটু অসুস্থবোধ করছি।ভালো লাগছিলো না লিখতে।কিন্তু আজ যেহেতু দেওয়ার কথা।তাই আপনাদের নিরাশ করিনি।ছোটো করে হলেও লিখে দিয়েছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here