মন মুনিয়া পর্ব-১২

0
1060

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১২

রাতে পড়ার টেবিলে বসেও বিশেষ কোনো মনোযোগ দিতে পারলোনা মনি। ইদানীং মা খুব চিন্তা করে মেয়েকে নিয়ে। মনিকে এমন অবস্থায় এর আগে তিনি দেখেন নি।

সেদিন রাতে হাতের সব কাজকর্ম শেষ করে মেয়ের কাছে গেলেন তিনি। মনি তখন টেবিলের সামনে বসে বই খোলা রেখে ভাবনায় মশগুল ছিলো। মা যে এসেছে সেটা পর্যন্ত খেয়াল করেনি মনি।।

মা খুবই সন্তর্পণে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। হটাৎ হাতের ছোয়ায় কিছুটা চমকে গেলো মনি। পরক্ষণে মাকে দেখে স্বস্তি পায় সে। ধীর গলায় বলে
-কিছু কইবা মা?
-তোর কি কিছু হইছে মনি?
-কক কই, কিছু হয় নাই তো মা।
-আমার উপর গোস্বা কইরে আছিস মা?
-কি যে কও মা। তোমার উপর আমি কেমনে রাগ কইরা থাকতে পারি?

-তাইলে আমারে বল, তোর কি হইছে?
-জানিনা মা, ভাল লাগেনা কিছু।
-আমি আগেই না করছিলাম ওই জয়নালরে বিয়া করতে রাজি হোইস না। আমার কথা শুনিস নাই তখন। আমি জানি, এই বিয়ার কথা ভাইবা ভাইবাই তোর এই অবস্থা।

মনি শুকনো হাসলো মায়ের কথা শুনে। যাক, তবুও মা অন্য একটা বিষয়ে পরে আছে। তিনি আবার বললেন
-অহনো সময় আছে মা, এই বিয়াডা তুই করিস না।
-আগের বারও আমার সাথে এমন হইছে, এইবারও যদি এমন হয় আব্বা আমারে আস্ত রাখবোনা মা।
-সেইডা আমি দেখমু।

-তারপর তোমারে কে দেখবো? আব্বায় কি তোমারে ছাইড়া দিবো?
মনির মা গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। এই কথার উত্তর তার কাছেও নেই।

রাতের পড়া শেষ করে কোনো রকমে খেয়ে শুতে যাবার বন্দোবস্ত করে মনি। এমন সময় গলা খাকারি দিয়ে ঘরে ঢুকে জয়নাল। ওকে দেখে মনি আর মনির মা দুজনেই বিরক্ত হয়, তবে কেউই মুখে সেটা প্রকাশ করতে পারেনি।

জয়নালের চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে আছে, শরীরটাও কেমন হেলেদুলে পরছে। নির্ঘাত ছাইপাঁশ গিলে এসেছে। রহিম বাড়িতে আসেনি এখনো। মনির মা কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো হটাৎ। খালি বাড়ি পেয়ে এই মাতালটা আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে না তো?

মনি জয়নালকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায়, তবে সেটা হয়ে উঠেনা। বাইরে বেরোবার সময় জয়নাল ওর হাতে ধরে টান দেয়। ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর লাগে মনির কাছে, তবে কিছু বলতে পারেনা। সবটা মুখ বুজে মেনে নিতে হয়।

মনির মা কিছুটা ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠে
-এইসব কি করতাছো জয়নাল। আইছো ভালা কথা, তাই বইলা মাইয়াডার হাত ধইরা টানতাছো কেন?
জয়নাল মাতলামো করতে করতে মনির মায়ের সামনে গেলো। উনার মুখের সামনে নিজের হাতের একটা আঙ্গুল নাড়িয়ে বললো
-হুশশশ, কোনো কথা না। এর আগেও তুই আমার লগে উল্ডাপাল্ডা কথা কইয়া গন্ডগোল বাধাইছিলি।

মনির মায়ের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে জয়নালের কথা শুনে। ইচ্ছে করছে কয়েকটা বসিয়ে দেক এই মাতালের সারা শরীর জুরে। মাকে এভাবে বাজেভাবে কথা বলাটা মোটেও মেনে নিতে পারছেনা মনি। সে চেচিয়ে উঠলো। বাজখাই গলায় বললো
-জয়নাল ভাই, আপনারে বিয়া করতে রাজি হইছি, কিন্তু অহনো বিয়া করি নাই। আমার মায়ের লগে ভদ্রভাবে কথা কন, নইলে ফল কিন্তু ভালা হইবোনা।

জয়নাল কিছুক্ষণ মনির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। এরপর হটাৎই অট্রহাসিতে মেতে উঠলো সে। হাসতে হাসতে বললো
-তুই কি করবি রে মনি? করমু তো আমি। আগে বিয়াডা হইবার দে, তোগো মা আর মাইয়া দুইজনেরই পাখনা গজাইছে, সেইডা কাইটা দিমু। আমার পায়ের নিচে পইরা থাকবি তোরা দুইডা। আর তোর বাপ, তারে তো আমার গোলাম বানামু, এমন ভাবে বানামু, তোর বাপে সেইডা ধরতেও পারবোনা।

মনির চোখমুখ থেকে অজস্র ঘৃণারাশি স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসছে। মনির মা জলদি করে উঠানে গেলো। উঠানের এক পাশে একটা বড় বাশের টুকরা রাখা আছে। সেটা দুহাতে নিয়ে হনহন করে ঘরে ঢুকলেন তিনি।

মায়ের হাতে এতো মোটা বাশের টুকরো দেখে ঘাবড়ে গেলো মনি। সে ভয়ার্ত গলায় বললো
-কি করতাছো মা?
মনির মা মনির দিকে তাকালো। তেজস্বী গলায় বললো

-এই মাতালডা অহন নেশা কইরা নেশার মইধ্যে ডুইবা রইছে। এইডারে অহন যতোই মারি, সকালে শুধু ব্যাথাডাই দেখবো, কেডায় মারছে মনে করতে পারব না। এইডাই সুযোগ মনি, এইরকম সুযোগ আমি আর হয়তো পামুনা। সুযোগ যহন পাইছি সেইডারে হাত ছাড়া করি কেমনে।

মনি আতংকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মা এলোপাতাড়ি ভাবে মেরে যাচ্ছে জয়নালকে। জয়নাল মার খাচ্ছে তবে এতোটাই মাতাল হয়ে আছে সে, উলটো প্রতিবাদ করতে পারছেনা। মাঝেমধ্যে ব্যথায় ককিয়ে উঠছে সে, তবে সেটা কারো কানে যাবার চান্স নেই, এই ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ গায়ের জ্বালা মিটাচ্ছে মনির মা। পরম সুখ পাচ্ছে এতে।

পরদিন সকালে বেশ চিন্তিত অবস্থায় উঠোনে বসে থাকতে দেখা গেলো রহিমকে। মনির মা সেটা খেয়াল করে বললো
-কি এতো ভাবতাছেন সকাল থেইকা?
-শুনছোস মনির মা, একটা খারাপ খবর আছে?
-কি খবর? কিছুই জানে না এমন একটা ভঙ্গিতে বললেন উনি।

রহিম মিয়া কিছুক্ষণ নিরব থেকে এরপর ধীর গলায় বললো
-জামাইডারে কাইল কেডায় জানি বেদম মাইর মারছে। পুরা শরীরডা জখম হইয়া গেছে।
-কার জামাই?

রহিম সামান্য তেজ দেখিয়ে বললো
-আমাগো জামাই, মনির জামাই এর কথা কইতাছি।
-বিয়া তো অহনো হয় নাই, অহনোই জামাই জামাই করেন কেন?
-বাড়তি কথা কইবি না মনির মা। এমনিতেই অনেক চিন্তায় আছি পুলাডার লাইগা।
-কেডায় মারছে কিছু কয় নাই?

-না, যারা মারছে তাগো মুখ নাকি কাপড়ে বান্ধা আছিন, তাই দেহে নাই।
রহিমের কথায় মনির মা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। কতো সুন্দর করে মিথ্যা বলতে জানে লোকটা। হয়ত সে চায়না, মনির মা জানুক মার খাওয়ার সময় জয়নাল মাতাল অবস্থায় ছিলো।

মনির মা কিছুটা বাকাভাবে বললো
-যেই পুলা, কারো ক্ষতি ছাড়া তো কোনো ভালা কাম করে নাই জীবনে। তারই ফল পাইছে হয়ত।

রহিম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো মনির মায়ের দিকে। কিছু বলার জন্য উদ্ধত হলো তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মনি। মেয়েকে দেখে মুখের কথা মুখেই চেপে রাখলো, আর বের করলোনা।

দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। পুরো এক মাস ব্যাপী পরীক্ষা। প্রতিটা পরীক্ষার মাঝেই গ্যাপ আছে, তাই এটা যেনো এক লম্বা সময়ের সফর।

পরীক্ষায় সে ভালোই সাপোর্ট পাচ্ছে রহিমের। প্রায় প্রতি পরীক্ষার দিনই মেয়েকে কিছু টাকা হাতে গুজে দিচ্ছে যেনো পরীক্ষার পরে কিছু খেয়ে নেয়। তবে সে জানিয়ে দেয় টাকাটা সে দিচ্ছে না, জয়নাল দিচ্ছে। এর জন্য জয়নালের বেশ প্রশংসাও করেন তিনি। মনি সে টাকা নিতে চায় না, তবে নিতে হয়।

মনির মা অবাক হয় মাঝেমধ্যে। একটা বাবা কতটা নিচু মনের হলে নিজের স্বার্থে নিজেরই মেয়েকে একটা বদমায়েশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নাচানাচি করে।

ইদানিং একটা সমস্যায় ভুগছে মনি। পিরিয়ডের ডেট অনেক আগেই অভার হয়ে গেলেও সেটা হচ্ছেনা এখনো। মনি বেশ চিন্তায় পরে। কোনো অসুখ বাধলো না তো আবার। মনি ভাবে এটা সে মাকে বলবে কিনা। কিন্তু বলবে বলবে করেও বলা হয়না।

এভাবে চলে গেলো আরো বেশ কয়েক দিন। পরীক্ষাও এখন প্রায় শেষের পথে। শেষ পরীক্ষার দিন হলে গিয়ে সে ইতির মুখ থেকে জানতে পারে নিয়ান বাড়ি এসেছে। ইতির চোখেমুখে খুশির ঝলকানি। মনি অবাক হয়।

ইতি এতো খুশি হচ্ছে কেন? ওর তো এতো খুশি হওয়ার কথা না। যাইহোক, মনি সেটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করেনা।।

পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরোবার মুহূর্তে মাথাটা হটাৎ ঘুরে মনির। বেশ বমি বমিও লাগে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে তারাতাড়ি কমন রুমে যায়। বাথরুমে ঢুকে কোনোরকমে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সেখানেই গরগর করে বমি করে দেয়।

বমি করার পর কিছুটা স্বস্তি আসে শরীরে। তবে মনে? মনি ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে। ওর মনে যে ভয়টা জেগে উঠেছে সেটা যদি সত্যি হয় তবে সব শেষ হয়ে যাবে। ভেবেছিলো সব কিছু ভুলে আগের ঘটনাটার শেষ টেনে নতুন করে সবটা শুরু করবে, কিন্তু এটা তো শেষ নয়। সন্দেহ টা ঠিক হলে এখান থেকেই তার ঝামেলার শুরু মাত্র।

মনি কমন রুম থেকেই মাথার স্কার্ফটা ভালোকরে পুরোমুখে বেধে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। এমন করে বাধে যেনো ওর মুখটা একদমই বুঝা না যায়। ওর স্কুলটা একটা বাজারের মাঝখানে দাঁড়ানো। এই বাজারে অনেকগুলো ফার্মেসী আছে। দুই একটা ফার্মেসি মনির পরিচিত, বাকিগুলো সব অপরিচিত।

মনি একটা অপরিচিত লোকের ফার্মেসিতে ঢুকে। সেখানে গিয়ে দেখে আরো কয়েকজন পুরুষ মহিলা আগে থেকেই দাড়ালো। কেউ আবার বসে আছে। মনি অপেক্ষা করতে থাকে সকলে যাওয়ার।

অপেক্ষর প্রহর শেষ হয় প্রায় আধঘন্টা পর। তবে এর মধ্যে ফার্মেসিতে থাকা লোকটা বেশ কয়েকবার মনির কি লাগবে জানতে চেয়েছে। মনি তখন লোকলজ্জার ভয়ে বলতে পারেনি তার প্রেগন্যান্সি স্টিক লাগবে।

যখন সে এটা চাইলো ফার্মেসীর বিক্রেতাটা সন্দিহান চোখে তাকিয়েছিলো তার দিকে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা মেয়ে এটা দিয়ে কি করবে ভেবে প্রশ্নও করেছিলো। মনি জড়তা নিয়ে বলেছিলো এটা সে তার এক ভাবীর জন্য নিচ্ছে।

সে বাড়ি গিয়ে কারো সাথে টু শব্দটাও করলোনা। তারাতাড়ি সে একটা কাটা বোতলের নিচের অংশটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। তার আর দেরি সহ্য হচ্ছেনা। সত্যটা সে জানতে চায়। নিশ্চিত হতে চায় যেটা সে ভাবছে সেটা সত্য নয়।

মনি স্টিকটা দিয়ে টেস্ট করতে বসে গেলো। মনের মধ্যে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে তার। প্রতিটা সেকেন্ড পার হওয়ার মুহূর্তে তার বুকের ধুকপুকানিও বেড়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে মনের মধ্যে কু ডাকতে লাগলো মনির। চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। স্টিকে দুটো লাল দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

মনি নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা। কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে বাথরুমে বসেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here