#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৭
রিতার অনেক জোরাজুরিতে রাতে সামান্য ভাত খেলো মনি। যদিও গলা দিয়ে খাবার তার নামছিলো না, তবে বেঁচে থাকতে হলে আর যার জন্য সে চলে এসেছে তাকে বাচিঁয়ে রাখতে হলে খেতে তাকে হবেই।
খাওয়া শেষে বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে আছে মনি। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে সে। একটা চাঁদকে ঘিরে হাজারো তারার মেলা। দেখতে ভালোই লাগছে।
মনির মাথাটা বেশ ধরেছে। দুহাতে মাথায় চাপ দিয়ে বসলো সে। ইদানিং মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে ওর। সারাক্ষণ মাথায় চিন্তা নিয়ে ঘুরে কিনা। মনি দুহাতে মাথা মালিশ করতে ব্যস্ত।
এমন সময় ওর কাধে কেউ হাত রাখলো। মনি মাথাটা উপরে তুলে কাধে হাত রাখা মানুষটির দিকে তাকাতে তাকাতে বললো
-রিতা!
মেয়েটি হাসলো। বললো
-আমি রিতা না, আমি আশা। রিতার রুমমেট।
মনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। সে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল
-আপনের ফোনেই আমি কথা বলছিলাম তাইনা?
আশা হেসে বললো
-হুম।
-কিন্তু বাসায় আসার পর তো আপনেরে দেখলাম না। আপনে বাসায় ছিলেন না?
-বাসাতেই ছিলাম। তবে তুমি আসার কিছুক্ষণ আগেই আমি আমার এক ফ্রেন্ড এর বাসায় গিয়েছিলাম।
-ওহ।
-ভালো আছো তুমি?
মনি ভালো করে মেয়েটার দিকে তাকালো। স্বর্গের অপ্সরী বলা চলে মেয়েটাকে। অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। যেমন দেখতে সুন্দর তেমন কথাবার্তা।
মনিকে নির্বাক দেখে আশা বললো
-কথা বলছো না যে?
মনির হুশ এলো। সে থতমত খেয়ে বললো
-এ্যা, ওহ হ্যাঁ ভালো আছি। আপনে ভালো আছেন?
-ভালো আছি। এখানে বসে আছো যে?
-ভালো লাগতাছে না।
-ওহ, আচ্ছা বসো। আমি ভিতরে গেলাম। খারাপ লাগা কেটে গেলে রুমে চলে এসো। বাইরে এভাবে বেশি সময় বসে থেকো না। ঠান্ডা লেগে যাবে।
-হুম।
আশা চলে গেলে মনি একভাবে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির যাবার পথে। মনি আসার পর থেকেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। অপরিচিত মানুষগুলোও কতো সুন্দর ব্যবহার করে যাচ্ছে ওর সাথে। আর অতি পরিচিত কাছের মানুষগুলো…
মনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। উত্তপ্ত নিশ্বাস টেনে রুমের দিকে পা বাড়ালো সে।
প্রেমিকার সাথে কথা বলা শেষ করে গ্রামের রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছে নিয়ান। মনটা খুব ভালো তার। মাথায় যে একটা চিন্তা ছিলো, সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছে। যদিও মনি চাইলে সে ওকে আরো সাহায্য করতো।
হাঁটতে হাঁটতে নিয়ান ভাবলো,
“আমার বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চা বলে জানবে জয়নাল, বিষয়টা হাস্যকর। যদি কখনো জেনে যায় এটা ওর বাচ্চা না, তখন তার এক্সপ্রেশন টা কেমন হতে পারে!!
উফ, সেই মুহুর্তটা যেনো না আসে। মনিকে অত্যাচার করবে ছেলেটা। খুব বাজে একটা ছেলে সে।
নিয়ান হাঁটতে হাঁটতে একসময় মনির বাড়ির পাশের রাস্তায় চলে এলো। কখন কিভাবে সে এসেছে তার জানা নেই। যখন দেখলো, তখন অবাকই হলো। হয়তো আগেও অনেক এসেছে সেই অনুসারের ভুল করে চলে এসেছে।
মনির মা এখনো কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। রহিম হাঁক ছাড়ছে আর মনির মাকে বকে যাচ্ছে।।
ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ নিয়ানের কানে গেলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মা একা হয়ে গেছে, তাই হয়ত সেই কষ্টেই কান্না করছে।
নিয়ান উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। বাড়ি যেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে । রাস্তার ধারেই একটা ছোটখাটো মুদি দোকান। শীতের রাতে সেই দোকানে গরম গরম সেদ্ধ ডিম আর রঙ চায়ের আড্ডার আসর জমেছে।
প্রায় সকলে গরম সেদ্ধ ডিম অথবা চা খেয়ে যাচ্ছে। আবার আলাপচারিতায় ব্যস্ত অনেকে। কয়েকটা লোক বেশ মনোযোগ সহকারে কিছু একটা বিষয় নিয়ে মশগুলে আছেন। নিয়ান ভাবলো, “এই শীতের রাতে এক কাপ রঙ চা খাওয়ায় যায়।
সে এগিয়ে গেলো দোকানে। দোকানের চারপাশ জুরে বাশের তৈরি মাঁচা বাধানো আছে। কাস্টমারদের বসার জন্য এইসব বানানো হয়েছে। নিয়ান মাঁচার এক পাশে গিয়ে বসে পরলো। দোকানদার লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো
-চাচা, এক কাপ চা প্লিজ।
দোকানদার লোকটি হাসিমুখে বলল
-বহো বাজান। দিতাছি।।
নিয়ান অপেক্ষা করতে লাগলো চায়ের জন্য। লোকটি চায়ে চিনি দিয়ে সেটাতে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে নিয়ানের দিকে তাকালো। সরু গলায় মিষ্টি করে বললো
-তোমারে তো চিনলাম না বাজান। কোন গেরামের তুমি?
-আমি এ গ্রামেরই চাচা। তবে এ গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে আমার বাড়ি।
-তোমার বাপের নাম কি?
-মোহাম্মদ হামিদুর রহমান।
লোকটি বিস্ময়ে বললো
-তুমি হামিদ মাস্টরের পুলা?
নিয়ান মুচকি হেসে বললো
-হুম।
উপস্থিত সকলের নজর তখন নিয়ানের দিকে। এ গ্রামের খুব কম লোকেই নিয়ান কে চিনে। বর্তমানে এ দোকানে উপস্থিত কেউই হামিদ স্যারের ছেলের সম্পর্কে অবগত নয়। তারা জানে হামিদ মাস্টারের একটা ছেলে আছে, তবে চোখের দেখা দেখেনি কখনো।
নিয়ানকে নিয়ে সকলের মাঝে একটা সোরগোল লেগে গেলো। সবাই নিয়ানকে বেশ খাতিরযত্ন করতে প্রস্তুত। এ গায়ের মাস্টারের ছেলে বলে কথা, তাছাড়া শহরের দামী ভার্সিটিতে পড়ে সে। কয় জনের এমন দম আছে।
নিয়ান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় সকলের মাঝে। তবে বেশ ভালোও লাগছে তার।
নিয়ান চায়ের কাপে আলতোভাবে চুমুক দিচ্ছে। এমন সময় কেউ একজন বলে উঠলো
-আমাগো মনিও তো তোমার বাপের কাছেই পড়তো তাইনা?
লোকটির কথায় নিয়ান কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
-হয়তো পড়তো। এ গায়ের অনেকেই আমার বাবার কাছে পড়ে। আমি সঠিক জানিনা।
-বাড়ি থাকো না, জানবা কেমনে।
অন্য একজন লোক উক্ত লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো
-যাই কও বড় ভাই, মনির কাছ থেইকা কিন্তু আমরা এইডা আশা করি নাই। কখনো ভাবি নাই মাইয়াডা এমন করবো। আইজকাল কাউরেই বিশ্বাস নাই কও! সবাই উপরে এক আর ভিতরে আরেক।
-কিন্তু আমার মনে হয়না মাইয়াডা খারাপ। সে হয়তো নিজেরে ওই মাতালডার হাত থেইকা বাঁচানোর লাইগাই এমনডা করছে। ওর বাপেতো একটা কষাই।
-কি জানি বাপু। কার মনে কি আছে, বুঝা বড় দায়।
ভদ্রলোকেদের কথোপকথনে বেশ অবাক হলো নিয়ান। মনির আবার কি হলো। ওর তো আজ বিয়ে হবার কথা ছিলো। বিয়েটা কি হয়নি তাহলে? কিন্তু ওর সাথে যখন মনি ছিলো তখন তো সব ঠিকই মনে হয়েছিলো। বাড়ি আসার পর কোনো ঝামেলা হয়েছে কি?
নিজের অতি উৎসাহিত মনকে দমাতে পারলোনা নিয়ান। লোক দুইটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
-কি হয়েছে মনির?
-তুমি চিনো মনিরে?
নিয়ান আমতাআমতা করে বলল
-নাহ, তবে আপনারাই তো বলছিলেন ও আমার বাবার কাছে পড়তো, তাই জিজ্ঞেস করছি।
-ওও। লোকটি দম নিলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর বলল
-মাইয়াডার আইজ বিয়া হওনের কথা ছিলো। যদিও আমরা কেউ জানতাম না। পরে জানছি। এইসব কথা তো চাপা থাকেনা।।
কথাটা বলে আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো লোকটি। নিয়ান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে। লোকটি আবারও বলতে শুরু করলো
-তা, মাইয়াডা আইজ তোমার বাপের কথা কইয়া বাড়ি থেইকা বাইড় হইছিলো, কি নাকি নোটফোট দিবো তোমার বাপে। কিন্তু সেই যে গেলো মাইয়াডা, আই আইলোনা।
নিয়াম চমকে উঠলো। কিছুই মাথায় ঢুকলো না তার। তৎক্ষনাৎ সে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বললো
-বাড়ি আসে নি মানে? ওর বিয়ে হয়নি?
-বিয়া হইবো কেমনে, মাইয়াডা আর বাড়িই তো ফিরে নাই। আহ, মাইয়ার মা ডা কানতে কানতে শেষ। সারাদিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়া খালি কাইন্দাই দিন পার করছে। অহনো বোধহয় কান্তাছে।
নিয়ানের মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। আর কিছু বলতে বা শুনতে মন চাইছেনা তার। তারাতাড়ি বিল মিটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে নিয়ান।
পুরোটা রাস্তা বেশ চিন্তায় চিন্তায় পার করলো নিয়ান। মনি বাড়ি আসেনি, তাহলে গেলো কোথায়? সে তো বলেছিলো একাই আসতে পারবে। তাহলে?
হারিয়ে যায়নি তো?
না না, হারাবে কি করে। ওতো এতোটাও বাচ্চা মেয়ে না। পথ ভুল হলে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতো। তাহলে?
বাজে কারো পাল্লায় পরে নি তো? কোনো বিপদে পরেছে মেয়েটা?
হাজার চিন্তা মাথায় ঘুরছে নিয়ানের। চিন্তায় মাথাটা প্রায় ব্যথা হওয়ার উপক্রম। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে নাম্বারটা একনজরে দেখলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর মুচকি হেসে রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে কেউ বললো
-হ্যালো।
-বলো বাবু।
-বাড়ি চলে গেছো?
-যাচ্ছি।
-এখনো যাওনি? তখন যে কেটে দিয়েছিলে, বললে বাড়ি যাবে?
-এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো, তাই আটকে গিয়েছিলাম। এখন যাচ্ছি।
-এখন যাবেনা।
-কেন?
-কথা বলবো।
নিয়ান হাসলো। আবেগী গলায় বললো
-তোমার আবদার পুরণে আমি সদা প্রস্তুত মাই উড বি বেগম সাহেবা।
নিয়ান ভুলে গেলো মনির কথা। ভুলে গেলো তারই ভুলে এক জনের জীবন জলাঞ্জলির কথা। সে মত্ত হলো বর্তমান নেশায়। সে নেশার নাম ভালোবাসা। নিয়ান ডুবে গেলো ভালোবাসার অতল গহ্বরে । এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেলো, সে কোনো পাপ করেছে।
রাতের আঁধারে সবাই ঘুমে ঢলে পরেছে। তবে ঘুম নেই মনির নয়ন পাতায়৷ ঘুমেরাও আজ বিদায় নিয়েছে। সুখপাখিদের মতো ঘুমও আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে মনির আক্ষেপ নেই, সে দুহাতে আগলে ধরছে তার দিকে ধেয়ে আসা এক নাম না জানা অনুভূতিকে।
মনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। মৃদু আলোয় সে তার পেটের দিকে তাকালো এক নজর। মন দিয়ে অনুভব করলো আগত ভালোবাসাকে। আলতো ছোয়ায় কিছুটা আদর করে মুচকি হেসে বললো
-তুই তারাতাড়ি চলে আয় বাবুনি। আমি অপেক্ষা করছি তোর আগমনের, অপেক্ষা করছি তোর বেড়ে উঠার।
অপেক্ষা করছি তাকে জ্বালানোর।
সে জ্বলবে, আমি শান্তি পামু। সে হাহাকার করবে, আমি তৃপ্তি পামু।
চলবে…
[সকলের উদ্দেশ্যে একটা কথা। আপনারা যারা এখনো আমার পেইজটিতে লাইক দেন নি, তাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা প্লিজ আমার পেইজটিতে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন।
আর আমার আরেকটা আবদার আছে আপনাদের কাছে। আপনারা যারা আমার গল্প পড়তে ভালোবাসেন, তারা আপনাদের ফ্রেন্ডদের কাছে আমার পেইজটিকে ইনভাইট করে আমার লেখা গল্পগুলো আরো পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করুন প্লিজ। আমার ছোট্র পেইজটাকে পাঠকমহলে ঠাঁই দিতে সাহায্য করুন। এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।
আশা করছি আমার অনুরোধ আপনারা রাখবেন। ভালো থাকবেন সবাই🙂]