মন মুনিয়া পর্ব-১৯

0
952

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৯
(বোনাস পর্ব)

মনি চমকে তাকালো আশার দিকে। হন্তদন্ত হয়ে বললো
-সত্যিই আশাপু। কি কাজ, আমি করমু।
-কাজ একটা আছে। তবে সেটা করতে হলে তোমাকে আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। তুমি পারবে সেখানে গিয়ে থাকতে?

-কেন?
-কারণ কাজটা ওখানেই।
-কি কাজ?
-গ্রামে আমাদের একটা স্কুল আছে। আমার দাদা স্কুলটা গ্রামের গরীব বাচ্চাদের জন্য তৈরি করেছিলো। স্কুলটা তখন থেকেই অনেক জনপ্রিয় ছিলো, কারণ বিনা খরচে এখানে বাচ্চাদের পড়ানো হয় এবং সকল বাচ্চাদের প্রতিদিন নিয়ম করে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়, আর তা সম্পুর্ন আমাদের খরচেই। বর্তমানে দাদা নেই। তবে আমার বাবা সেটার দায়িত্বে আছে।

মনি হটাৎ বললো
-তাইলে তো তোমরা অনেক বড়লোক আশাপু।
আশা হাসলো। এরপর বললো
-আমাদের স্কুলের অতি দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা কোচিং সেন্টার খোলা হয়েছে। আর সেটা আমাদের বাড়ির একটা অংশেই। তুমি যদি চাও সেই কোচিং এর বাচ্চাদের পড়াতে পারো। আমার বাড়িতে থাকবে, খাবে। আর পড়ানো বাবদ একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট পাবে। আর বাড়িতে আমার মা আর বড়ভাবি আছেন, তারাও অনেক ভালো। তোমার ভালোই লাগবে।

মনি অসহায় মুখ করে বললো
-সবই বুঝলাম। কিন্তু আমার লেখাপড়া যে খুবই কম। এস এস সি পরীক্ষাটাও দিয়া শেষ করতে পারি নাই। প্র‍্যাক্টিকেল বাকি, আমি কি পড়াইতে পারমু?

আশা হেসে বললো
-পারবে। ওরা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। প্রাইমারী লেভেলের। তুমি ওদের চেয়ে অনেক উপরের লেভেলে আছো এখনো।
মনি তাকালো আশার দিকে। কিন্তু বিপরীতে কিছু বললোনা।।

বারান্দায় আশা দাঁড়িয়ে ছিলো তখন। রিতা সেখানে গিয়ে আশার পাশেই দাড়ালো। উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো
-মনি কি এখন কোনো কাজ করতে পারবো আশা আপু? আর পারলেই বা কয়দিন পারবো। কয় মাস যাইলেই তো আর কিচ্ছু করতে পারবোনা। তাও তুমি এই মনিরে কেন কাজের কথা বললা?

আশা হেসে তাকালো মনির দিকে। শান্ত গলায় বললো
-মনির অবস্থাটা দেখেছো রিতা? মেয়েটা সারাক্ষণ কাঁদে, চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে। তুমি হয়তো জানো না এটা একটা প্রেগন্যান্সি মেয়ের জন্য কতোটা ক্ষতিকর। ওর এখন হাসিখুশি থাকার কথা। কিন্তু কপাল খারাপ তাই এই অবস্থায় আছে। তুমি সারাদিন বাসায় থাকোনা। কয়দিন পর থেকে আমারও ফুল ক্লাস শুরু হবে, আমিও থাকবোনা তখন। সারাদিন এই মেয়েটা একা বাসায় কিভাবে থাকবে ভেবেছো?

তারচেয়ে আমাদের বাড়ি থাকুক, বাচ্চাদের সময় দিক, আমার মা আর ভাবি তো আছেই। ওর কোনো অসুবিধা হবেনা। বরং সেখানে ও ফুরফুরে অবস্থাতেই থাকবে। চাকরিবাকরি তো করতেই হবে। ওর যেহেতু এতোটা করুন পরিস্থিতি কিছু একটা ওকে করতে হবেই। কিন্তু এখন না। সময় হোক আগে।
রিতা কাচুমাচু করে বললো
-কিন্তু আন্টি আর ভাবী যখন ওর বিষয়ে সত্যটা জানবো তখন?
-চিন্তা করোনা। আমার ফ্যামিলির কেউই লো চিন্তাধারার না। সো সেখানে ওর কোনো সমস্যা হবেনা।

আশা চলে এলো মনির কাছে। মনিকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে বললো
-কিছু ভেবেছো?
-এ্যা? ও হ্যাঁ।
-কি ভাবলে? যাবে আমাদের বাড়ি? দুদিন পর আমি বাড়ি যাবো, যদি তুমি রাজি থাকো তাহলে তোমাকে সাথে করেই নিয়ে যাবো।
-আমি রাজি আশাপু।
-গুড গার্ল। তবে আমাদের বাড়ি যাবার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
-কি কাজ করা লাগব?
-তোমার প্রেক্টিক্যাল এক্সামটা কবে?
-পরশু দিন।
-ওহ হো, তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেলো।

-কি?
-আমাদের বাড়ি যাবার আগে তুমি প্র‍্যাক্টিকেল এক্সাম টা দিবে, তারপর বাড়ি যাবো।
মনি বিস্মিত হলো আশার কথা। অবাক হয়ে বলল
-কি কও আশাপু?
-যা শুনেছো তাই।
-কেমনে দিমু আমি। আমি ওইখানে আর যাইতে পারমুনা। আর আমার এডমিট, রেজিষ্ট্রেশন, প্র‍্যাক্টিকেল খাতা সব বাড়িতে।
-সেটাই তো ভাবছি। তোমার প্র‍্যাক্টিকেল খাতার কাজ কি কমপ্লিট করেছিলে?
-হুম।

আশা রিতাকে ডেকে পাঠালো। রিতা আসলে ওকে জিজ্ঞাসা করলো
-তোর কোনো ছোট ভাই আছে রিতা?
-আপন ভাই নাই, চাচাতো ভাই আছে।
-তাতেই হবে। আরেকবার যখন তুমি বাড়িতে কথা বলবে তখন তোমার মাকে বলো ওর সাথে একটু কথা বলাতে।
-কি কথা?
-সেটা সময় হলেই জানতে পারবে।
রিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।

আরো দুটো দিন পার হয়ে গেছে, আজ খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে আশা। সে উঠে মনি আর রিতাকেও ডেকে তুললো। মনি উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিলো ঝটপট। আজ সে আশাদের বাড়ি চলে যাবে। আশা রেডি হতে হতে রিতাকে বললো
-যেভাবে বলেছিলাম সেভাবে সেভাবে কাজ হয়েছে তো?
-চিন্তা করোনা আশা আপু। আমার ভাই কালই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।।
-গুড।

আশা ওর ব্যাগ থেকে একটা আবায়া বের করলো। সেটা মনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
-এটা পরে নাও মনি। আর এমন ভাবে পরবে যেনো কেউ তোনাকে চিনতে না পারে।
-আমারে কে চিনবো?
-আজ তোমার এক্সাম মনে আছে?
মনি মাথা নিচু করে বললো
-মনে থাকলেই না কি।
আশা হাসলো। বললো
-চটপট রেডি হয়ে নে। যেভাবে বলেছি সেভাবে।

অগত্যা মনি বোরকা পরে রেডি হলো। আশা রিতাকে বলল
-তুমিও আমাদের সাথে যেতে পারতে রিতা।
-আমি কেমনে যাই বলো আশা আপু। আমার তো ছুটি নাই। কয়দিন পর বাড়ি যামু। এখন ছুটি কাটাইলে তখন আর ছুটি পামু না।
-বুঝেছি। ওকে, তোমাকে নাহয় পরেই একবার নিয়ে যাবো।

রিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মনিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো আশা। মনি খুব সাবধানে হাঁটছে। আশাও ওকে সাবধানে চলার নির্দেশ দিচ্ছে বার বার। একটা সময় আশা মনিকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো নিজের মতো করে।

সকাল হওয়ায় রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। তাই খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। যখন গাড়ি এসে নির্দিষ্ট স্টপেজে দাড়ালো তখন নামার পালা। আশা খেয়াল করলো মনি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সে মুচকি হেসে মনিকে ডাকলো। মনি ঘুম ঘুম চোখে বললো
-কি?
-আমরা এসে গেছি তো। নামতে হবে।
মনি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে দাঁড়ালো। এরপর আশার পিছন পিছন নেমে এলো গাড়ি থেকে।

আশপাশটায় তাকিয়ে চমকে গেলো মনি। এ তো তার নিজের এলাকা মনে হচ্ছে।

মনি বিস্ময়ে আশাকে বললো
-আমরা কই আইছি আশাপু?
-তোমাদের এলাকায়?
-কেন?
-বলেছিলাম তো আমাদের বাড়ি যাবার আগে তোমার এক্সামটা দিতে হবে। আজ তো তোমার এক্সাম।
মনি অবাক হলো। বিস্ময়ে বললো
-তুমি কেমনে আমার ঠিকানায় আইলা। আমিতো বলি নাই তোমারে কেমনে কেমনে আসা লাগে।
-এটা ডিজিটাল যুগ। কাউকে কিচ্ছু বলে দিতে হয়না। আর রিতাতো ছিলো। সে আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলো কিভাবে আসতে হবে। এবার চলো তোমার হলে।
মনি মাথা নিচু করে নিরবে বলল
-আমি কেমনে পরীক্ষা দিমু, আমার সাথে কিচ্ছু নাই।
-সব আছে, তোমার হলের সামনে গেলেই দেখতে পাবে। রিতার চাচাতো ভাইকে দিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। সে বোধহয় আমাদের জন্য হলের সামনে অপেক্ষা করছো।

মনির চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে এলো। সে আবেগাপ্লুত হয়ে আশাকে জরিয়ে ধরে বললো
-তুমি আমার সত্যিকারের বোন আশাপু।
-এবার চলো, দেরি হয়ে যাবেতো।
মনি এগিয়ে চললো হলের দিকে। আশা পাশেই হেটে আসছে।

হলের কাছাকাছি যেতেই দেখলো রিতার সেই ভাইটি একটা ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনি উৎসাহে তাকে ডাকতে গেলে আশা তাকে বাধা দিয়ে বললো
-তুমি কথা বলো না। আমি আনছি।

আশা এগিয়ে গিয়ে ফাইলটা নিয়ে আসলো ছেলেটার হাত থেকে। ফাইল নিয়ে চলে এলে মনি বিস্ময়ে বললো
-আমারে যাইতে বাধা দিলা কেন?
-তোমাকে চিনে ফেলতো তাই।
-আমার কথা না বইলা নিছো?
-হুম। বলেছি আমি তোমার মেডাম। তোমার হয়ে আমি ফাইলটা জমা দিয়ে দিবো।
-ও বিশ্বাস করলো?
-বাচ্চা একটা ছেলে। ও আর কি বুঝে।
-আমাগো বাড়ি থেইকা কিভাবে আনলো?
-তোমাকে যেভাবে বললাম সেভাবেই। তোমার মাকে গিয়ে বলেছে মেডাম চেয়েছে তোমার ফাইলটা।

মনি কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বললো
-মায়েরে দেখতে মন চাইতাছে খুব।
-যাবে?
-নাহ। এই মুখ আমি মায়েরে দেখাইতে পারমুনা।
-আচ্ছা, এখন তুমি হলে ঢুকো। তবে সাবধানে, কেউ যেনো না চিনে। একবার কেউ চিনে ফেললেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে।
-তুমি কি করবা?
-আমি একটু হাঁটাহাটি করি।

মনি চলে গেলো পরীক্ষার হলে। প্র‍্যাক্টিকেল পরীক্ষা হওয়ার কোনো সিরিয়াল মতে বসার প্রয়োজন পরলো না। কয়েক স্কুলের ছাত্রছাত্রী এখানে, তাই কেউ বিশেষ ভাবে নজর দিলোনা ওর দিকে।। আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমন ভাবে আবায়া আর হিজাব করা তাতে ওকে বিন্দুমাত্র চিনার উপায় নেই। পরীক্ষা মিটে গেলে সে বেরিয়ে এলো হল থেকে। কিছুটা দুরেই নিয়ান আর ইতি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে এটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

মনি এগিয়ে যেতে লাগলো আশার দিকে। আশা বাইরে অপেক্ষা করছে। মনি যখন আশার কাছাকাছি গেলো তখন হটাৎ ই থমকে গেলো সে। কারণ নিয়ান ইতিকে বিদায় দিয়ে আশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নিয়ানকে দেখে আশা চমকে উঠল, এরপর হাসমুখে কথা বলতে লাগলো দুইজনে। দেখে মনে হলো ওরা পূর্বপরিচিত।
মনি অবাক হয়ে দেখতে লাগলো তাদের দুইজনের কথোপকথন। তবে কি বলছে সেটা শুনলোনা। অনেক্ষন কথা বলার পর আশা মনিকে দেখতে পেলো দূরে তার দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। আশা নিয়ানকে বিদায় জানালো।

______
প্রায় অনেকটা রাস্তা চলে এসেছে ওরা। সবকিছু পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে সামনের দিকে। পরীক্ষার হল থেকে আসার পর খুবই কম কথা বলেছে মনি। দু একটা কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিয়েছে শুধু। ব্যপারটা অস্বাভাবিক লাগলো আশার কাছে। সে জিজ্ঞেস করলো
-কি ব্যপার মনি? কথা বলছো না যে। ভালো লাগছেনা?
-না, তেমন কিছুই না। আচ্ছা, তখন যে দেখলাম আপনে একটা ছেলের সাথে দাঁড়াইয়া কথা বলতাছেন, আপনে চিনতেন তারে?
-হুম আমি চিনি ওকে। আমরা এক ভার্সিটিতেই পড়ি, যদিও সে আমার সিনিয়র। আমিতো অবাক হয়েছি ওকে এখানে দেখে। আমি জানতাম না ওর বাড়িও এখানে।
-ওওহ।

আশা বললো
-তুমি চিনো ওকে?
মনি থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে কি বলবে? কি করে বলবে এটাই সেই ছেলে, যে তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে।
আশা মনিকে আবারও বললো
-কি হলো, বললেনা যে।
-আমি চিনিনা উনারে। আজই প্রথম দেখলাম।

চলবে…..

[যদিও শর্ত পুরন হয় নাই, তাও বোনাস দিলাম। তবে এই পর্বে যতক্ষণ না ২০০+ লাইক হচ্ছে, ততোক্ষণ নেক্সট পার্ট আপলোড দিবোনা😑

সিরিয়াসলি বললাম😪]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here