মন মুনিয়া পর্ব-২০

0
938

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২০

আশাদের বাড়ি পৌছুতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাস স্টপেজ থেকে রিক্সা নিয়ে সেটাতে চেপে এসেছে ওরা। বাড়ির সামনে নেমে আশা যখন ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত হলো ঠিক সেই মুহূর্তে মনি সেদিকে নজর না দিয়ে বাড়ির ভেতরটা অবলোকন করতে লাগলো।

ওরা এখনো বাড়ির ভেতরে ঢোকে নি। বড় গেইটের সামনে দাঁড়ানো। এখান থেকে ভিতরের কিছু দেখা যায়না। আর রাতের আধার নেমে আসায় সেটা আরো অস্পষ্ট। তবে মনির অবচেতন মন বলছে ভেতরের পরিবেশটা অসাধারণ হবে।।

বাউন্ডারির দেওয়ালটা বিভিন্ন কারুকার্জে খোদাই করা। বাউন্ডারির দেয়ালে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর ফুটবল ল্যাম্প বসানো। সন্ধ্যা হওয়ায় সেগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাতে।

আশা মনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। বাড়ির মেইন গেইট অতিক্রম করে ভিতরে ঢোকা মাত্র মনির মনে হলো এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়, এটা নির্ঘাত পুর্ব আমলের কোনো জমিদারের বাড়ি। নতুন করে রিপেয়ারিং করা হয়েছে।

মনির অতি উৎসাহু দৃষ্টি বার বার চারপাশটায় চোখ বুলাতে লাগলো। মেইন গেইটেই দুপাশে দুইটা ইয়া বড় বড় কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ।

বাড়ির সামনে দৈর্ঘ প্রস্থে সমতা নিয়ে বিশাল আকারের এক উঠোন। উঠোনের চারপাশের কিনারা ঘেষে নানান ধরনের ফুল ফলের বৃক্ষ দিয়ে ছেয়ে আছে।

এছাড়াও এক পাশে আছে একটা মাঝারি আকারের দিঘি। যেটা দেখতে ছোটখাটো একটা সুইমিংপুলের মতো। অন্যপাশে একটা মাঝারি আকারের সুদৃশ্য চৌচালা ঘর। ঘরের উপরে একটা বোর্ডে বড় বড় করে লেখা আছে –

“Seeing the light in the blue”
“নীলাশায় আলোর দেখা”

মনি এই কথার মানেটা খুঁজে বের করতে পারলোনা। একবার ভাবলো আশাপুকে জিজ্ঞেস করুক। পরক্ষণে ভাবলো থাক, পরে জানা যাবে। আশার পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছে মনি।

উঠোন পেরিয়ে যখন ঘরের সামনে এলো মনে হলো কোনো অতিরঞ্জিত প্রাসাদে সে ঢুকতে যাচ্ছে। ঘরের প্রবেশপথে নানান ধরনের শোভাবর্ধক গাছ সারি সারি রাখা আছে। অনেক বড় একটা একতলার বাসাটা সৌন্দর্যে গিজগিজ করছে। উপরে ছাদের ঢালাই দেওয়া।

পুরোটা বাসার মেঝেতে মোজাইক টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে, আর দেয়ালগুলোতে নানান রঙ বেরং এর ডিজাইন করা টাইলস বসানো আছে।

মনির চলার গতি কমে গেছে। আশা মনিকে লক্ষ্য করে বলল
-কি ব্যপার মনি, এতো ধীরে হাটছো যে, খারাপ লাগছে?
মনি উৎসাহ দমন করতে না পেরে বললো

-আশাপু, এ আমারে কই নিয়া আইলা তুমি? এতো পুরা রাজপ্রাসাদ।
আশা হেসে বললো
-সত্যিই রাজপ্রাসাদ। আমার বাবা বেশ সৌখিন মানুষ। উনার মনমতো করে উনি বাড়িটা বানিয়েছেন।

-তুমি ভাগ্য কইরা এমন বাপ পাইছো আশাপু।
-হুম। মুচকি হেসে বললো আশা।

ঘরের ভিতরে ঢুকে অবাক হলো আশা। মা, বড়ভাবি, ভাই, বাবা কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা সে। কেউ কি বাড়িতে নেই? থাকার তো কথা ছিল, কারণ সে বাবাকে জানিয়েই বাড়িতে এসেছে। এমন অবস্থায় কেউ কি করে বাড়িতে না থাকতে পারে?

বাড়ি খালি দেখে অসহায় মুখ করে আশার দিকে তাকালো মনি। তার অসহায়ত্বের কারণ বুঝতে পেরে আশা বললো–

-তোমার এমন শরীর নিয়ে সারাদিক জার্নি করাটা আসলেই অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো মনি। কেউ বাড়ি নেই তাতে কি, বাড়িটাতো আছে। বাড়ি যেহেতু আছে, সকলেই আসবে নিশ্চিন্তে থাকো।

তুমি আমার সাথে আমার রুমে আসো। ওখানে এটাচ বাথরুম আছে, হাতমুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নাও। আমি দেখছি, সবাই কোথায় গেছে।
মনি মাথা নাড়িয়ে সাই দিলো আশার কথায়। সে আশার পিছু পিছু ছুটলো ওর রুমে।

কিছুটা সময় পার হয়ে গেলে বাড়ি ফিরলো নিলয়। পিছন পিছন ওর মা রাবেয়া আর বউ হিমাও আসছে। বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে কিছুটা অবাক হলো তারা। নিলয় অবাক হয়ে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো

-দরজা খোলা কেন মা? লাগিয়ে যাও নি?
-তোর বউকে জিজ্ঞেস কর। আমি কিচ্ছু জানিনা।
কথাটা বলেই রাবেয়া ভিতরে ঢুলে গেলো। শরীরে বয়সের ভার একদমই বুঝা যায় না উনার। দেখে মনে হয় এইতো, সেদিনের যুবতী মেয়েটা।

নিলয় কিছুটা রেগে তাকালো হিমার দিকে। হিমা ঢোক গিলে বললো
-লাগিয়েছিলাম বোধহয়, কে খুললো?
-আমি খুলেছি।
নিলয় কিছুটা রাগ দেখিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

হিমাও ধীর পায়ে পিছন পিছন ঘরের ভিতরে ঢুকলো। মনে মনে হাজার বার নিজের স্বামীকে বকাঝকা করলো সবসময় এভাবে রাগ দেখানোর জন্য। মানুষটা কেমন যেনো, যখন খুশি থাকে তখন কিল গুতো দিলে হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়। আর যখন রাগ হয় তখন একটা নিশ্বাস ফেলতেও কয়েকবার ভাবতে হয়।

আজ পাশের বাড়ির একটা বাচ্চা ছেলের জন্মদিন ছিলো। সেখানেই দাওয়াতে গিয়েছিলো উনারা। বিশাল আয়োজনে তারা জন্মদিন পালন করছে। তো হাসি আনন্দের মাঝেই একজন ভদ্র লোকের হাতে থাকা গ্লাস থেকে কিছুটা কোক নিলয়ের গায়ের উপর পরে যায়। বেশ কেল্লা ফতে।

সেখানেও এক দফা রাগারাগি করে এসছে লোকটার সাথে। সেই রাগের রেশ এখনো বজায় আছে।

রাবেয়া বাড়ির ভিতরে ঢুকে কিছুটা অবাক হলো। ড্রয়িংরুমে সোফার উপর বড় একটা ব্যাগ রাখা। এটা কার ব্যাগ চিন্তা করতে লাগলেন উনি। আশা আসেনি তো? জানালো না যে?

ভাবতে ভাবতে মেয়ের রুমে গেলেন উনি।। এক চিলতে হাসি ফুটে এলো উনার মুখে। মেয়ে দেখছি এসেই ঘুমিয়ে গেছে। রাবেয়া হাসিমুখে এগিয়ে গেলো বিছানার পাশে। একটা পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে শুয়ে আছে মনি। তাকেই আশা ভেবে উনি ওর কাছে গেলেন। কয়েক বার আশা আশা করে ডেকেও যখন লাভ হলোনা তখন উনি গায়ের কম্বলটা কিছুটা সরিয়ে দিলেন।।

সাথে সাথে অবাক হলেন তিনি। একটা ফুটফুটে মেয়ে কতো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কে? ঘুমন্ত মেয়েটাকে কেন জানি ডাকতে ইচ্ছে করলো না উনার। উনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরের বাইরে গেলেন। চুপিসারে হিমাকে ডেকে আনলেন উনি। শাশুড়িকে কিছুটা চিন্তিত দেখে তারাতাড়ি ছুটে এলো সে। বললো
-কি হইছে মা? তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে যে!
-আমার সাথে একটু আশার ঘরে আয়। দেখ একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-বলো কি? চোরটোর হয়তো?

রাবেয়ার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। তিনি সামান্য তেজ দেখিয়ে বললো
-চিন্তাধারা পালটা হিমা। চোর হইলে চুরি করতো, পরে পরে মার খাওয়ার জন্য নিশ্চিন্তে ঘুমাতো না।
-ওহ তাইতো।
উনারা ঘরে ঢুকার আগ মুহুর্তে নিলয়ও উপস্থিত হলো সেখানে। বললো
-কি হয়েছে এখানে মা? কোনো সমস্যা?

নিলয়ের মেজাজটা মনে হচ্ছে ঠিক হয়েছে কিছুটা। তাই হিমা মুখ বাকিয়ে রাবেয়া কে বলল
-তোমার বড় ছেলেকে বলে দাও মা, শুধু শুধু আমাকে বকলো দরজা খোলা থাকার জন্য। এখন যেনো মাফ চায় আমার কাছে। রাবেয়া সেসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে ভিতরে ঢুকলো।

নিলয় অদ্ভুত চাহনিতে হিমার দিকে তাকিয়ে ধীরস্থির কন্ঠে বললো
-মাফ চাইবো?
-হুম।
-কেমন করে? আলতো হাতে নাকি লোহার ন্যায় শক্ত হাতে?
হিমা মুখ বাকিয়ে বললো
-লাগবেনা তোমার ক্ষমা। এসো আরেকবার আমার কাছে, ধাক্কা দিয়া ফালাই দিবো।
-থ্রেট দিচ্ছো?
-হুম।
-দেখা যাবে।

তৎক্ষনাৎ ভেতর থেকে রাবেয়ার ডাক এলো
-তোরা এখনো কি করছিস ওখানে? এখানে আয়।
নিলয় আর হিমা একসাথে ঘরে ঢুকলো। মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে। ওকে দেখে বিস্মিত গলায় নিলয় বলে উঠলো
-মেয়েটা কে? আশু!
-হুম আশু।

আশার গলার কন্ঠস্বর পেয়ে বাথরুমের দিকে তাকালো সবাই। আশাকে দেখতে পেয়ে উৎফুল্লে সকলে একসঙ্গে বলে উঠলো
-আশা! কখন এলি তুই?
আশা বেশ রাগী চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিলয় এগিয়ে গিয়ে বোনকে একহাতে জরিয়ে ধরে বললো
-রেগে আছিস কেন আশু? বল কখন এসেছিস?
-এখন জিজ্ঞেস করছো আমি কখন এলাম? তোমদের তো জানিয়েছিলাম, তাও তোমরা কেউ বাড়িতে নেই। এতোদিন পর বাড়ি এসে দেখি কেউ নেই, তখন কতোটা খারাপ লেগেছিলো আমার জানো?
-সত্যিই অন্যায় হয়ে গেছে বোন, কিন্তু তুই কাকে জানিয়ে এসেছিস, হিমাকে? তুই রাগ করিস না। আমি হিমাকে বকে দিবো।
-এই সব কিছুর জন্য আমাকে কেন দোষারোপ করা হয় শুনি? আমাকে বলেছিস তুই আজ আসবি আশা?
-বাবাকে বলেছিলাম। বাবা কোথায়?

রেহানা এতোক্ষন ছেলেমেয়ে কান্ড দেখে হাসছিলো। এইবার এসে মেয়েকে জরিয়ে ধরে বলল
-দেখলি তোর বাবার কান্ড, একবার বলার প্রয়োজনও মনে করলোনা যে তুই আসবি। আর তুইও কম যাস না, আমাদের একটা ফোন করতেও তো পারতি।
-ভেবেছি বাবা তোমাদের বলে দিবে।
-কখন এলি মা? রাস্তায় কোনো ঝামেলা হয়নি তো?
-একটু আগেই এসেছি, আর নিরাপদেই এসেছি।

হিমা এগিয়ে এসে ধীর গলায় বললো
-এই মেয়েটা কে রে আশা?
-আমার সাথে এসেছে।
-ওহ, তোর রুমমেট বোধহয়।
-ও কে আর কেন এসেছে তা সব তোমাদের জানাবো, তবে এখন না। আগে খাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করো। খুব খিদে পেয়েছে।

এর মধ্যে নড়েচড়ে উঠলো মনি। আশা মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে শান্ত গলায় বললো
-বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে?
মনি আস্তে আস্তে উঠে বসে আশার দিকে তাকিয়ে নিরবে হাসলো। শান্ত গলায় বললো
-হুম।
-তাহলে এবার নেমে এসো, কিছু খেতে হবে তো।

মনি বিছানা থেকে নামার সময় খেয়াল করলো ঘরে ওরা দুজন ছাড়াও এরো তিনজন আছে। কিছুটা ভড়কে গেলো সে। কয়েক সেকেন্ড পর নিজেকে ধাতস্থ করে সে এগিয়ে গেলো তাদের সামনে। বুঝতে বাকি রইলো না এরাই আশাপুর মা, ভাবী আর ভাই।

মনি রাবেয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে উনার পা ছুয়ে সালাম করতে গেলো। সাথে সাথেই ওকে দুহাতে আলতোভাবে ধরে দাড় করালেন রাবেয়া। হাসিখুশি বললেন
-পায়ে ধরে সালাম করতে নেই মা।

মনির বুকে ধক করে উঠলো। মুহূর্তে দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। আহ, মাতো কথায় কথায় এতো সুমধুর কন্ঠে ওকে মা বলে ডাকতো। আর সেই মিষ্টিকন্ঠী মাকে আজ কয়টা দেন ধরে সে দেখেনা। আজ মায়ের এতো কাছে গিয়ে সে দেখতে পেলোনা। এর চাইতে কপাল পুড়া আর কিইবা হতে পারে।

মনির চোখে পানি দেখে অবাক হলো রাবেয়া। সে হন্তদন্ত হয়ে বললো
-কাঁদছো কেন?
-অতি সুখে কানতেছি আন্টি।

চলবে…..

[শর্ত দিয়েছিলাম মজার ছলে, সিরিয়াসলি দিলে কখনোই শর্ত পুরন হওয়ার আগে পর্ব আপলোড দিতাম না। যাইহোক, আমার এই মজার ছলে দেওয়া শর্ত যদি আপনাদের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগার কারণ হয়ে থাকে তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী 😪

বোনাস পার্ট আপলোড দিবো সন্ধ্যায়। ধন্যবাদ ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here