#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২২
গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আশা আর মনি। রাস্তার দুপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছগুলো রাস্তায় চলমান পথিকদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। আশা মনির দিকে তাকিয়ে বলল
-কেমন লাগলো আমাদের গ্রাম?
-খুব সুন্দর।
-শুধুই সুন্দর?
মনি মুচকি হাসলো, মিষ্টি কন্ঠে বললো
-অসম্ভব সুন্দর আশাপু।
-সত্যিই তাই। চলো এবার বাড়ি ফিরে যাই।
-হুম।
প্রায় অর্ধবেলা হাটাহাটি করে বাড়ি ফিরলো আশা আর মনি। বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো মনি। কোচিং এর ছাত্রছাত্রীরা দল বেধে বেরিয়ে আসছে ক্লাস থেকে। হয়তো ছুটি হয়ে গেছে কোচিং।
নির্দিষ্ট ইউনিফর্মে সিরিয়াল মেইনটেইন করে ছাত্রছাত্রীরা যখন বের হচ্ছিলো মনে হচ্ছি এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে।।
মনি বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে আশাকে বলল
-উফফ, কি সুন্দর লাগছে আশাপু।
-তোমার ভালো লেগেছে?
-হুম।
-কয়দিন পর থেকে এখানে তুমিও পড়াবে।
মনি কৃতজ্ঞতার সাথে আশার দিকে তাকালো। নিরবে হেসে বললো
-সবই তোমার অবদান আশাপু। আমি কোনো দিন তোমার উপকারের কথা ভুলমু না।।
-আবারও ভুল বললে, কপাল কুচকে বললো আশা।
মনি হেসে বললো
-ভুলবোনা।
আশা হাসলো। বললো
-হুম, এসো এখানকার টিচারের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।
আশা আর মনি কোচিং রুমের ভেতরে যাবে তার আগেই ভেতর থেকে একজন সুদর্শন পুরুষ বেরিয়ে এলো। আশাকে দেখতে পেয়ে ভদ্রলোক একটা প্রাণখোলা হাসি দিলো। ভদ্রতার সঙ্গে বললো
-আরে মিস আশা, আপনি কখন এলেন?
-গতকাল এসেছি।
-ওহ। সারাদিনে যে একবারো দেখতে পেলাম না।
-একটু গ্রামে বেরিয়েছিলাম। ওকে গ্রামটা দেখিয়ে আনলাম। মনিকে দেখিয়ে বললো আশা।
ছেলেটি মনির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, আপাদমস্তক ভালোকরে দেখে আশাকে বললো
-উনাকে তো ঠিক চিনলাম না।
-আপনার কলিগ।
-মানে?
আশা হেসে বললো
-মজা করছিলাম, তবে মিথ্যে কিছু বলি নি। কয়দিন পর থেকে ও এখানে পড়াবে, আপনার পাশপাশি।
-এ পড়াবে? বিস্ময়ে বললো ছেলেটি।
লোকটির কথায় কিছুটা অবাক হলো আশা। কপাল বাকিয়ে বললো
-কেনো, ও পড়ালে কোনো সমস্যা?
-তা বলছি না, ভাবছি ও নিজেই তো একটা বাচ্চা। একটা বাচ্চা মেয়ে হয়ে এতোগুলা বাচ্চাকে সে কিভাবে কন্ট্রোল করবে!!
আশা হেসে বললো
-তাতে কি, আপনি আছেন তো। আপনি নাহয় ওকে শিখিয়ে দিবেন কিভাবে বাচ্চাদের কন্ট্রোলে রাখতে হয়। কি শেখাবেন তো?
ছেলেটি হেসে বললো
-কেন নয়?
আশা হাসল। মনির দিকে তাকিয়ে বলল
-চলো ঘরে যাই।
-হুম।
ওরা কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ছেলেটি ডেকে বলল
-মিস আশা!
আশা পিছনে ঘুরে বললো
-কি?
-আমার কলিগের নামটা তো জানতে পারলাম না।।
-আপনার নামের কাছকাছিই।
-মানে?
-আপনার নাম থেকে একটা অক্ষরকে বহিষ্কার করুন, পেয়ে যাবেন।
-মনি? বিস্ময়ে বললো ছেলেটি।
-হুম
-ইন্টারেস্টিং।
-ভালো লেগেছে নামটা?
-আরো অনেক কিছুই ভালো লেগেছে।
-মানে? অবাক হয়ে বললো আশা।
ছেলেটি গা ঝাড়া দিয়ে বললো
-নাহ কিছুনা। আমি আসছি।
আশা আর কিছু বললোনা। মনিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো সে। ঘরে ঢুকার আগমুহূর্তে মনি আশাকে বললো
-আচ্ছা আশাপু, ওই লোকটা আমার নামটা কেমনে জানলো?
-ওই যে বললাম, উনার নাম থেকে একটা অক্ষর বহিষ্কার করতে।।
-কি উনার নাম?
-মনির।
-ওহ, উনি তোমাদের কোচিং এর টিচার?
-হুম, তবে উনার আরেকটা প্রফেশন আছে।
-কি?
-উনি আমাদের স্কুলেরও টিচার।
মনির মনের খচখচানিটা দূর হলনা, উল্টো আরো বেড়ে গেলো। সে আবারও সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো
-তাইলে স্কুল কখন পড়ায়? এই টাইমে তো উনার স্কুলে থাকার কথা।
-হুম। তবে আজ স্কুল বন্ধ। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন কোচিং টা ৯ টা থেকে শুরু করানো হয় আর একটু বেশিই সময় দেওয়া হয়। বাকি দিনগুলোতে সকাল বিকেল দুই শিফটে পড়ানো হয়। যদিও উনার সাথে একজন মেডাম ছিলো এতোদিন, তবে পার্সোনাল কিছু প্রব্লেমের কারণে উনি এখন আর আসতে পারেন না। তাই উনাকে একাই সবটা সামলাতে হয়। তুমি জয়েন করার পর উনার উপর ধকলটা একটু কমে যাবে।
মনি মাথা নাড়িয়ে বললো
-হয়তো।
দুপুরের পর রোদটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে কিছুটা। বিকেল হওয়ার সাথে সাথে শীতটা যেনো তীব্র আকারে জেকে ধরেছে। মনির সাথে কোনো শীতের কাপড় নেই। ঢাকা যে কয়দিন থেকেছে সেখানে রিতার একটা চাদর গায়ে জরিয়ে রেখেছে, যদিও সেখানে এত বেশি শীত লাগেনি। এখানে আসার পরও অতি উত্তেজনায় শীতটা টের পায়নি সে। তবে এখন যেনো শরীরে কাপুনি উঠছে।
মনিকে ডাকতে এসে হিমা দেখলো মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে কিছুটা অবাক হয়ে বললো
-এমা, মনি তুমিতো ঠান্ডায় জমে হয়ে যাচ্ছো দেখছি। শীতের কাপড় পরে নাও।
হিমার কথার বিপরীতে মনি লজ্জা সূচক হাসি হাসলো। সে কি করে বলবে তার শীতের কাপড় নেই।
হিমা আবারও বললো
-কি হলো মনি, কথা বলছো না যে।
মনি সংকোচে বললো
-ইয়ে মানে পরে নিবো।
-পরে নিবো বললে হবেনা। এখন পরে এসো আমার সাথে। একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করেছি। সবাই একসঙ্গে বসে খাবো।
মনিকে ডাকতে এসে হিমা দেরি করছে ভেবে এগিয়ে এলো আশা। হিমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বললো
-কি করছো ভাবী, মনিকে নিতে এসে তুমি হারিয়ে গিয়েছো নাকি।
-আমার কি দোষ। দেখ মেয়েটা কেমন ঠান্ডায় জড়ো হয়ে আছে। বলছি শীতের কাপড় পরে আমার সাথে আসতে, তাও করছেনা।
আশা মুচকি হেসে হিমাকে বলল
-তুমি যাও, আমি ওকে নিয়ে আসছি।
হিমা চলে গেলে আশা এগিয়ে গেলো মনির কাছে। ওর পাশে বসে বলল
-তোমার শীতের পোশাক নেই সেটা আমার খেয়াল ছিলোনা। এসো আমার সাথে, আপাতত আমার একটা শাল গায়ে জরিয়ে নাও। পরে তোমার জন্য শীতের কাপড় আনানোর ব্যবস্থা করছি।
-আমার লাগবেনা কিছু আশাপু।
-সেটা আমি বুঝবো। তুমি এসো আমার সাথে।
আশার পিছু পিছু মনি এলো ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুম জুরে বসে আছে রাবেয়া, হিমা, নিলয় আর ওর বাবা। আশা আর মনি আসাতে জায়গাটা পরিপূর্ণ হলো।
চা নাস্তা খাওয়ার এক ফাঁকে আশার বাবা মনিকে উদ্দেশ্য করে বললো
-তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো এখানে?
-না আঙ্কেল।।
-কিছু লাগলে আমাকে বলো।
-হুম। মাথা নাড়িয়ে বললো মনি।
ওদের কথার সাথে তাল মিলিয়ে নিলয় বলল
-আমাকেও বলতে পারো মনি, নিজের বড় ভাই মনে করে।
মনি নিলয়ের দিকে তাকালো কৃতজ্ঞতার সাথে। মনে মনে ভাবলো, “মানুষগুলো এত্তো ভালো কেন, সব মানুষেরা কেন এমন হয়না?”
আশা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-তোকে এখনই দরকার পরবে ভাইয়া। নাস্তা খেয়ে রেডি থাক।
-কেন?
-মার্কেটে যাবো।
-হটাৎ মার্কেট কেন? আর মার্কেট করলে ঢাকা গিয়ে করিস, এখানে কি পাবি।
-শীতের কাপড় তো পাবো নাকি।
-তোর আবারও শীতের কাপড় লাগবে? অনেকগুলিই তো আছে। ভ্রু বাকিয়ে বললো রাবেয়া।
-আমার না, মনির লাগবে।
______
পরের দিন খুব ভোরে রওনা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আশা। মনি পাশেই বসে আছে। রাবেয়া আর হিমা মিলে ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।
মনিকে দেখে চুপচাপ মনে হলো, কিন্তু ভেতর থেকে সে ছটফট করছে খুব। আশা সেটা খেয়াল করে ওর পাশে বসলো।
নরম গলায় বললো
-তোকে তুই করেই বলছি, কারণ তুই আমার অনেক ছোট হবি। এতো ছোট বাচ্চাদের তুমি তুমি করে আমি মজা পাই না।
-বলো আশাপু, আমি কিছু মনে করবোনা।
-শোন, একদমই মন খারাপ করবি না। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি, সময়মত গোসল করবি, ঠান্ডা লাগাবি না, শেষে তোর বাচ্চারও ঠান্ডা লেগে যাবে।
মনি মাথা নাড়ালো। আশা আবারও বলল
-হাসিখুশি থাকবি সবসময়, এই সময় হাসিখুশি থাকাটা জরুরি। আর হ্যাঁ আরেকটা কাজ কিন্তু তোকে অবশ্যই করতে হবে
-কি কাজ আশাপু?
-পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বি, মায়ের কাছে এক্সট্রা জায়নামাজ আছে, কুরআন শরীফ আছে। আমি বলে দিবো তোকে যেনো দেয়। রেগুলার কুরআন তেলাওয়াত করবি, তোর বাচ্চার জন্য ভালো হবে।
মনি শুনে যাচ্ছে আশার কথা। মাথা নিচু করে রেখেছে সে। আশা আবারও বললো
-তোকে কোনদিন থেকে কোচিং এ জয়েন করতে হবে সেটা বাবা বলে দিবে। তুই শুদু সাবধানে থাকিস মনি।
মনি মাথা নাড়ালো। এরমধ্যে ওদিক থেকে খাওয়ার জন্য ডাক এলো। আশা চলে গেলো খেতে।
খাওয়া শেষে নিলয়কে নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে। বোনকে বাসে তুলে দিয়ে চলে আসবে নিলয়। আশা যাওয়ার সাথে সাথে প্রচন্ড একাকীত্ব বোধ করতে লাগলো মনি। মনে হলো, এই বুঝি সে একাকীত্বের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে৷
মাথাটা ঘুরতে লাগলো হটাৎ, এরমধ্যে বমি বমিও পাচ্ছে খুব। কোনোমতে দুহাত দিয়ে মুখে চেপে ধরলো মনি। ছুটতে লাগলো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনে ঢকঢক করে ছেড়ে দিলো উদরে থাকা বস্তুগুলো। সেই সাথে চোখ থেকেও বেরিয়ে এলো অজস্র নোনাজলের ধারা।
চলবে…..