মন মুনিয়া পর্ব-২৪

0
878

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৪

শীতের তীব্রতা চারপাশে জেকে আছে। গাছগুলোর পাতাগুলো ঝরে গিয়ে সেখানে দেখা গিয়েছে একরাশ শূন্যতা। চারিদিকে আদ্রতা ছড়িয়ে পরেছে।

শীতকে উপেক্ষা করে আরামের ঘুম ছেড়ে ফজরের পরপরই উঠে পরেছে মনি। অযু করে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করে সে। ধীরে ধীরে বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠে।

মনি কুরআন শরীফটাকে বুকে ঠেকায়, এরপর বুক থেকে মুখের কাছে নিয়ে আলতো করে চুমু দেয় তাতে।

_____
হিমা সবেমাত্র রান্নাঘরে গিয়েছে, সকাল সকাল সকলের জন্য আগে চা হবে। সেই জন্য একটা পাতিলে হাড়ি বসিয়ে আগুনটা ধরিয়ে দিলো। মনি রান্না ঘরে এসে প্রথমে উঁকি দেয় রাবেয়া আছে কিনা দেখার জন্য। হিমাকে এভাবে দেখে সে সংকোচে রান্নাঘরে ঢুকে।

হিমা হেসে বলে
-নামাজ পড়েছো?
-হুম।
-চা খাবে?
-একটা কথা বলার ছিলো ভাবী।
-নিঃসংকোচে বলতে পারো।
মনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করতে লাগলো, হাতের আংগুল গুলো মুঠোয় পুরে নিয়ে চাপ দিতে লাগলো বার বার। হিমা খেয়াল করে বললো
-বলছো না যে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা?
-হুম।
-বলো।

মনি সংকোচে বলে
-আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেন ভাবী?
-হটাৎ টাকা দিয়ে কি করবে?
-দরকার ছিলো খুব। এক যায়গায় যেতাম।
হিমা হাসলো।
-টাকার দরকার লাগতেই পারে, কিন্তু এভাবে ভয়ে ভয়ে বলছো কেন।
-নাহ মানে।
-কোথায় যাবে জানতে পারি?
মনি মাথা নিচু করলো। বলতে দ্বিধা করলো সে।
হিমা বললো
-সিক্রেট হলে থাকুক, বলা লাগবেনা। টাকা কখন লাগবে সেটা বলো।
-এখনই দরকার ছিলো।
-তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি নিয়ে আসছি।

হাসিমুখে রান্নাঘর ত্যাগ করলো হিমা। মনি অপেক্ষা করতে লাগলো তার ফেরার। কিছুক্ষণের মধ্যেই টাকা নিয়ে ফিরলো হিমা। মনির হাতে টাকাগুলো গুজে দিয়ে বললো
-যেখানেই যাও, তারাতাড়ি ফিরে এসো। আমরা চিন্তা করবো।
মনি মুচকি হেসে বললো
-চেষ্টা করবো ভাবী।

একের পর এক বাড়িঘর আর রাস্তার পাশের গাছগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটি। মনি উদাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। অন্যসময় হলে আর কোনো ভাগ্যবতী নারী হলে হয়তো যাত্রাটা বেশ রোমাঞ্চকর হতো, তবে মনির ক্ষেত্রে এটা সম্পুর্ন উল্টো।

মনি যখন তার কাঙ্খিত গন্তব্যে গিয়ে পৌছুলো তখন বেলা প্রায় ১১ টার মতো। গাড়ি থেকে নেমে মনি ধীরে ধীরে হাটতে লাগলো সামনের দিকে। এক পা দুই পা করে পৌঁছে গেলো বাড়িটির সামনে। বুকে মোচড় দিয়ে উঠল মনির।

বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো আছে। বাড়ির প্রবেশপথে একটা সুন্দর করে সাজানো প্রাইভেট কার দাড় করানো আছে। হয়তো এ গাড়ি দিয়েই বর যাবে। পাশেই আরো কয়েকটি গাড়ি দাড় করানো, বরযাত্রী যাওয়ার গাড়ি।

পুরোটা গাড়ি ফুল দিয়ে আবৃত করা। ফুলের মাঝখানে অনেক যত্ন করে লিখা আছে N+E. নামের অক্ষর গুলো চারপাশ থেকে ফুল দিয়ে লাভ শেপের ভিতর আটকানো।

মনি এক পা দুই পা করে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। সকলেই সাজগোছ করে অপেক্ষা করছে বরযাত্রী যাওয়ার। অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে সবাই আড়চোখে মনিকে কেমন করে যেনো দেখছে। কিন্তু কেউই ওকে চিনতে পারছেনা। মনির পরনে আশার দেওয়া সেই বোরকাটা। চোখদুটোও ভালো করে দেখা যায় না। তবে সে প্রেগন্যান্ট, সেটা সামনে পেটের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়।

ধীরে ধীরে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে দাড়ালো মনি। নিয়ানের সাথে কিভাবে কথা বলতে মাথায় শুধু সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে তার। একট সময় একটা ছোট ছেলেকে দেখতে পেলো সে। হাতে ইশারা করে ডাকতেই বাচ্চাটা চলে এলো তার কাছে৷ মনি আস্তে করে ওকে বললো একটু নিয়ানকে ডেকে দেওয়ার জন্য।

বাচ্চাটি মাথা নাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
মনি চিন্তায় পরলো। নিয়ানকে সে ডেকে দিবে তো?

একটা সময় অপেক্ষার পালার অবসান হলো। মাথায় মুকুট আর শেরওয়ানি গায়ে পরিহিত নিয়ান এগিয়ে আসতে লাগলো ওর দিকেই। মনির বুকের ভেতরকার ধকধকানিটাও বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।

ওর একদম কাছাকাছি এসে নিয়ান বললো
-কে আপনি? চিনতে পারছিনা।
মনি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান কিছুটা ইতস্তত বোধ করে আবারও বললো
-আমার কথায় কষ্ট পেলে আমি স্যরি। আমি সত্যিই আপনাকে চিনতে পারছিনা।
-আমি মনি।

কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় ছেয়ে গেলো চারপাশটা। বিয়ে বাড়ির হট্রগোলটাও যেন কারো কানে আসছেন।
ভ্রু বাকালো নিয়ান। ঠোটে রহস্যময় হাসিটা টেনে শান্ত গলায় বললো
-ওহ, কোত্থেকে এলে? আমিতো জানতাম তুমি পালিয়ে গেছো কোথাও। ফিরে এলে কবে?

-এই মাত্রই এলাম। তাও আপনার কাছে।
-আমি তো ইনভাইট করিনি।
-দাওয়াত দিলে যে আপনার সমস্যা হতো।
-বাজে কথা ছাড়ো। হটাৎ এখানে কি মনে করে?
-কেন আমার সাথে এমন করলেন?
-কি করেছি?

মনির বাধ ভেঙে গেলো। সে চাপা আক্রোশে বললো
-আমি আপনার চাইতে বয়সে অনেক ছোট ছিলাম, তাই আমাকে মেনে নিতে আপনার সমস্যা ছিলো। আপনার নাকি বিয়ের সময় হয়নি, তাই বাচ্চাসহ আমাকে অস্বীকার করতেও আপনি দুইবার ভাবেন নি। তাহলে আজ ইতি কি করে আপনার হবু বউ হতে পারে। ওর বয়স নিশ্চয় আমার থেকে বেশি না।

নিয়ান হাসলো। বলল
-তোমরা মেয়েরা আসলেই হিংসুটে। বাদ দাও, সব মনে রাখলে আর ওই একটা কথা মনে রাখলেনা?
-কোন কথা?
-আমি বলেছিলাম আমার বাবা তার নিজের লেভেলের কারো সাথে আমার বিয়ে করাতে চায়। আর ইতিদের লেভেল আমাদের চাইতে কোনো অংশে কম না। ও দেখতে সুন্দরী, ওর বাবার টাকা আছে, সমাজে মান সম্মান আছে। সামাজিক একটা মর্যাদা আছে। তোমাদের কি আছে?

-আমার কি আছে?
-হ্যাঁ, কি আছে তোমার? শুধু ওই রুপটা ছাড়া আর কিছুই নেই।
-এই কথাটা তখন আপনার ভাবা উচিত ছিলো, যখন জোর করে আমার সর্বনাশ করেছিলেন।
-বলেছিলো তো, ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।

মনির চোখ পানি এবার আপনা আপনি বেরিয়ে আসতে লাগলো। জোর করেও আটকাতে পারছেনা সে। মনি বললো
-সুখী হতে পারবেন তো আমাকে কষ্ট দিয়ে?
-আমি কাউকে কষ্ট দেইনি। কেউ যদি নিজ ইচ্ছেয় কষ্টকে মেনে নেয়, তাহলে সেখানে আমার কিছু করার নেই। আমি সলিউশন দিয়েছিলাম। তুমি সেটা গ্রহণ করোনি, এখানে তো আমার কোনো দোষ নেই।

মনি আর কিছু বলার মতো ভাষা পেলোনা। সে নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। নিয়ান আবারও সেই রহস্যময় হাসিটা হেসে বললো
-এখনো দেখছি ওটা পেটে নিয়েই ঘুরছো। ভালোই বড় হয়েছে দেখছি পেটটা
-ওটা শুধু আমার পেট না, আমার কলিজা।
-ওকেহ, থাকো তোমার কলিজা নিয়ে। আমাকে জ্বালাতন করোনা প্লিজ। সবেমাত্র বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমি চাইনা আমার নতুন জীবনে কারো কুনজর লাগুক।

মনি হাসলো। তাচ্ছিল্যের সাথে বললো
-লাগবেনা কুনজর। আমি চাইবো আপনি সবসময় সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন।
নিয়ান হাসলো। হাসতে হাসতে বললো
-অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। আমরা এখন রওনা হবো। তুমি চাইলে যেতে পারো আমাদের সাথে।
-শেষে কুনজর যদি লেগে যায়। আপনারাই চলে যান।
-ওকে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থেকে নিয়ান বললো
-কোথায় গিয়েছিলে?
মনি অসহায়ভাবে নিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো
-জানিনা, শুধু জানি বাচ্চাটাকে বাচাতে গিয়েছিলাম।
-আমি ভেবেছি হয়তো সত্যি সত্যিই কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে পালিয়েছো।
মনি কিছু বললোনা নিয়ানের কথা। নিয়ান আবারও বললো
-আমি চললাম, বেরোতে হবে।

নিয়ান চলে গেলো। মনি ঠাই দাঁড়িয়ে থেকেই কাঁদতে লাগলো নিরবে। এভাবে কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেলো।

এক এক করে চোখের সামনে দিয়ে সবাই গিয়ে উঠলো গাড়িতে। নিয়ানকে আগেই তুলা হয়েছে গাড়িয়ে। সবাই যখন উঠে বসলো তখন ছেড়ে দেওয়া হলো গাড়িগুলো। মনির চোখের সামনে দিয়ে নিয়ান চলে গেলো বউ আনতে।

মনি কিছুক্ষণ আহত চোখে তাকিয়ে রইলো তাদের যাওয়ার পথে। কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেলে দুচোখ মুছে নিলো ভালো করে, ফিরতে হবে তাকে।

সে পা বাড়ালো সামনের দিকে। তবে এগোতে পারলোনা। সামনে আগানোর আগেই কেউ ওর কাধে হাত রাখলো। মনি ভ্রু বাকিয়ে তাকালো সেদিকে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললো
-আশাপু তুমি।

আশার মুখে কোনো কথা নেই। সে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। মনি আবারও বললো
-আশাপু, তুমি এইখানে? আর কথা বলছোনা কেন?

আশা মুখ খুললো এইবার। চোখেমুখে তার সন্দেহের তীর, সেই তীর মনির দিকে ফিরিয়ে সে বললো
-তুই এখানে কেন এসেছিস? কি এতো কথা বলেছিস তুই নিয়ানের সাথে? কে হয় ওই নিয়ান তোর?
মনি হাসলো। তবে সে হাসি কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ছিলো তার মুখে।

মনি গম্ভীর কন্ঠে বললো
-ওই নিয়ানই আমার বাচ্চার বাবা আশাপু।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here