মন মুনিয়া পর্ব-৩

0
1332

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-০৩

-এই মেয়ে, ব্যাথা পাও নি তো? হাতটা ধরে উঠে আসো।
মনি এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো ছেলেটির দিকে। সে যেনো উঠার কথা ভুলেই গেছে। এক পর্যায়ে ছেলেটি কপাল কুচকালো, মিনমিন করে বললো
-বয়রা নাকি! উঠতে বলছি উঠছো না কেন?
এবার মনি কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো, তবে আগের জায়গাতেই স্থির বসে রইলো সে।

ছেলেটি এবার মনির উঠে আসার অপেক্ষা না করে চট করে ওর হাতে ধরে সজোরে একটা টান দিলো। টানের জোর এতোটাই ছিলো মনি টাল সামলাতে না পেয়ে একেবারে ছেলেটির গায়ের উপর ঠেসে পরলো। মনি এবার চোখমুখ বন্ধ করে একটা চিৎকার করতে যাবে তার আগেই সেই স্যারের ছেলেটি ওর গায়ের সাথে মিশে থাকা মনিকে হ্যাচকা টানে দূরে সরিয়ে জোরে বলে উঠলো
-গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বের হবে তো এক থাপ্পড়ে তোমার মুখের মানচিত্র বদল করে দিবো।

মনি যেনো জমে গেল এবার। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলো সামনে থাকা ছেলেটি ভয়ংকর ভাবে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনি কিছু বলতে যাবে তখন ছেলেটি বললো
-বলেছি না একটা কথাও বলবে না। যখন তোমার দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে চাইছিলাম তখন তো কোনো কথা বলোনি, এখন কেন কথা বলতে চাইছো?
-আমি তো আপনারে বলি নাই আমারে সাহায্য করার লাইগা। নিচের দিকে তাকিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বললো মনি।
-তুমি যেহেতু আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেছিলে, তাই তোমাকে সাহায্য করা আমার রেস্পনসিবিলিটি ছিলো।

মনি আর কোনো কথা বললোনা। সে শুধু ছেলেটির সামনে থেকে পালানোর পথ খুজতে ব্যস্ত। ছেলেটি সেটা বুঝতে পেরে বললো
-এই মেয়ে, এতো কাচুমাচু করছো কেন? তোমাকে কে আটকে রেখেছে শুনি? এই নিয়ান তোমাকে সাহায্য করছিলো এতোক্ষণ, আটকে রাখার জন্য কোনো ফন্দি আঁটেনি। তুমি যেতে পারো।
ছেলেটি পথ ছেড়ে দাড়ালে মনি এক দৌড়ে সেখান থেকে ছুটে এলো। পিছন থেকে ছেলেটি হতবাক হয়ে মেয়েটির দৌড় দেখতে দেখতে বললো
-আজব মেয়েতো, এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন!

বাড়ি এসে সোজা বিছানায় এসে উপুর হয়ে পরলো মনি। এখনো ওর সারা শরীর কাপছে। এমন একটা পরিস্থিতি হবে সে কি কখনো ভেবেছিলো?
যখনই মনে হচ্ছে সে স্যারের ছেলের গায়ের সাথে লেপ্টে গেছিলো তখন লজ্জায় চুপসে যাচ্ছে সে। এবার সে কিভাবে প্রাইভেট পড়তে যাবে ভেবেই নেতিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।

মনির মায়ের আজ কাজ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। মনি তখন ভাতের চাল ধুইয়ে চুলার উপরে বসিয়েছে মাত্র। মা এসেই হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। মেয়েকে চুলা জ্বালাতে দেখে বলল
-কিরে মা, তুই এখানে কি করিস?
-ভাত বওয়াইতাছি মা। তোমার এতো দেরি হইছে কেন?
-আর কইস না, ওগো বাড়িত আইজ থেইকা ধান কাডা লাগছে। ওই ধান কামলারা বাড়িত আইনা দিয়া গেলে সব ধান আরেক জনরে লইরা উড়াইয়া থুইয়াইছি। কাইল আবার ভোরে গিয়া সিদ্ধ বওয়াইতে হইবো।
-তাইলে তো তোমার আজ অনেক খাটনি গেছে।
-তা তো গেছেই। তুই কি ইস্কুল থেইক্কা আইয়া কিছু খাইছোস?
-না মা।

মনির মা কপাল কুচকে বললেন
-খাস নাই কেন? অসুখ বাধানির লাইগা উইঠা পইরা লাগছোস?
-ভাত তো নাই মা।
-কি কস? আমি তো যাওয়ার আগে তোর লাইগা ভাত থুইয়া গেছিলাম। তোর বাপ কি সব ভাত খাইছে?
-জানিনা তো।
-তোর বাপ আসলেই মানুষ না, অমানুষ একটা।
-থাক না মা। আব্বার হয়তো বেশি খিদা লাগছিলো।

রাতে রহিম মিয়া বাড়ি ফিরলে তার সাথে বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে গেলো মনির মায়ের। মেয়েটাকে সারাদিন অভুক্ত রেখে তিনি কিভাবে সব ভাত একা খেয়ে ফেললেন সেই নিয়েই একটা ক্ষোভ মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি বলেলেন
-মানুষ এতোডা পাষাণ কেমনে হয়? কেমনে পারলেন আপনি এইডা?
-কি করছি আমি?
-যেই ভাত রাইখা গেছিলাম তা দিয়া আপনেগো দুইজনের হইয়া যাইতো। আপনে জানেন মাইয়াডা সেই সকালে খাইয়া গেছে, তাও ওর লাইগা দুই লোকমা ভাতও রাখলেন না?

-তোর মাইয়া সময়মত বাড়ি না আইলে খাইবো কেমনে। আমার এক মেমান আইছিলো, তারে খাওয়াই দিছি। আবারও আইবো একটু পরে, আইজ থাকবো আমাগো বাড়িত।
-কোন মেমান, কেডা আইছিলো? ভ্রু বাকিয়ে বললো মনির মা।

-রশিদ ভাইয়ের পুলাডা আছেনা জয়নাল, হে আইছিলো।
-কেন?
-কেন মানে? আমার খালাত্তো ভাইয়ের পুলা কি আমার বাড়ি আইতে পারে না?
-কেন পারবো না, অবশ্যই পারবো। তয় হেই পুলা তো একটা ভন্ড গাঞ্জাখোর। হেই কেন আমগো বাড়ি থাকতে যাইবো?

-মুখ সামলাইয়া কথা কো মনির মা। ওই পুলারে নিয়া কোনো উল্ডাপাল্ডা কথা কইবি না।
-কেন কমু না, মানলাম হে আইছিলো। তয় আবার কেন আইবো? বাড়িত একটা সমত্ত মাইয়া আছে, সেইডা কি মাথায় নাই? কেমন বাপ আপনে? একটা সমত্ত মাইয়া ঘরে থুইয়া ভন্ড এক গাঞ্জাখোর পুলারে রাইতে জায়গা দিতাছেন।
রহিম মিয়া নিজেকে একটু শান্ত করে নরম গলায় মনির মাকে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন

-শোন মনির মা, এতো চেতিস না। একটা ভালা খবর আছে।
-আপনের মুখে আবার ভালা খবর, কন শুনি।
-জয়নাল আমাগো মনিরে বিয়া করবার চায়, তাও কোনো টেকাপয়শা ছাড়াই।
-মানে? আঁতকে উঠলেন মনির মা।
-মানেটা বুঝলিনা, আইজকাল কেডা বিনা টেকায় বিয়া করে শুনি, আর আমরা যদি মনিরে অন্য জায়গায় বিয়া দেই তাইলে কি এমনে এমনে দিতে পারুম ? যৌতুক দেওয়া লাগতো, আর সেই যৌতুকের টেকা আমরা পাইতাম কই? আমাগো তো কপাল ভালা, জয়নাল এমনে এমনেই মনিরে বিয়া করতে চাইছে। শুধু তাই না, হে কইছে যদি আমরা মনিরে ওর লগে বিয়া দেই, তাইলে আমাগোরে উল্ডা হে পাঁচ হাজার টেকা দিবো।
পোলাডার মন মানসিকতা কত্ত ভালা একবার চিন্তা কইরা দেখ।

হটাৎ ই রেগে গেলেন মনির মা। অত্যন্ত বিরশ মেজাজে বললেন
-আপনের মাথা ঠিক নাই। যদি ঠিক থাকতো তাইলে টেকাপয়শার চিন্তা কইরা নিজের মাইয়ারে একটা বদমায়েশ গাঞ্জাখোরের সাথে বিয়া দেওনের কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। আপনে কেমন বাপ, যৌতুক থেইকা বাঁচার লাইগা আর সামান্য কয়ডা টেকার লাইগা নিজের মাইয়ারে একটা বদমাইশের হাতে তুইলা দিতে চান।
-তয় তোর মাইয়ারে কোন হানের কোন রাজপুত্তুর বিয়া করতে আইবো শুনি?
-আমার মাইয়া দেখতে শুনতে ভালা, বিয়ার লাইগা জামাই এর অভাব হইতো না। আর যদি অভাব হয়ই তাইলে কাইটা গাঙে ভাসাইয়া দিমু, তবুও ওই নেশাখোরের কাছে দিমুনা।
-দেখি তোর কতো জোর, বিয়া আমি ওর লগেই দিমু। পারলে আটকাইয়া দেখাইস।

রহিম মিয়া হনহন করে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে। উনি চলে যাওয়ার পর মুহূর্তেই সামান্য একটা আর্তনাদ করে বিছানায় বসে পরলেন মনির মা। চোখমুখ বেয়ে পানিধারা বেয়ে পরছে। মেয়ের উপরে আসন্ন বিপদটা চোখের সামনে ভাসতেই তিনি কুকড়ে উঠছেন। মনির বাবা যে কতোটা ভয়ংকর আর স্বার্থপর মানুষ, উনি তা হাড়ে হাড়ে জানেন। উনার বিরুদ্ধে গিয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেন নি মনির মা। এখন কিভাবে সে মনিকে বাচাঁবে সেটা ভেবেই বারবার দিশা হারচ্ছেন।

রান্নাঘরে বসে এতোক্ষণ সবটাই শুনেছে মনি। সেও ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙে পরেছে বাবা মায়ের ঝগড়া শুনে। যদিও নেশাখোরের সাথে বিয়ে হবে শুনেও ওর তেমন কোনো হেলদোল নেই। ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ে নেশাখোরদের সম্পর্কে আর কতোদুরই বা জানে।

রহিম মিয়া বেরিয়ে যাবার পর মনি ধীরে ধীরে মায়ের কাছে এগিয়ে আসে। মাকে এইরকম দেখে সে খুবই মুষড়ে পরে। মায়ের কাছে গিয়ে বসে একহাতে মাকে জরিয়ে ধরে বলে
-এমন মন খারাপ কইরা থাইকো না তো মা।
মনির মা বিষন্ন মনে তাকায় মনির দিকে। মনি অপলকভাবে তাকিয়ে আছে উনার দিকে। মেয়েকে দেখে উনি আরো ভেঙে পরেন। এবার ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। মেয়েকে জরিয়ে ধরে বলেন
-তোরে মনে হয় আমি আর বাঁচাইতে পারমু মা রে মা। তোর ওই পাষন্ড বাপ যখন একবার ঠিক করছে ওই গাঞ্জাখোরটার লগে তোর বিয়া দিবো তখন তাই করবো। আমারে মাফ কইরা দিস মা।
-ও মা, তুমি এমনে কথা কইতাছো কেন? আমার ভাল লাগেনা তুমি এমনে থাকলে।

কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে যাবার পর রহিম মিয়ার গলার আওয়াজ পায় মনি আর ওর মা। ওরা একটু নড়েচড়ে বসে এতে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রহিম মিয়া উনার ওই খালাতো ভাই এর ছেলে জয়নালকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। ছেলেটাকে দেখা মাত্রই মাথায় রক্ত চড়ে যায় মনির মা। সে মনিকে ইশারা করে এখান থেকে গিয়ে রান্নাঘরে বসে থাকে। এই ছেলে যতোক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ যেনো ওর সামনে না আসে। মনি মাথা নাড়িয়ে তাই করতে চাইল। যে চলে যেতে লাগলো সেখান থেকে। এমন সময় রহিম মিয়া বাধা দেয় তাকে। হাসিমুখে বলে
-যাস কই মনি, দেখ কেডা আইছে।

মনি একবার আড়চোখে তাকায় জয়নালের দিকে। শরীরের রংটা ফ্যাকাসে, গালদুটো মুখের ভিতরে গিয়ে ঠেকেছে, কোঠরদুটো থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম, চোখের চারপাশে একেবারে চাইরঙা কালচে বর্ণ হয়ে আছে। আর পান খেয়ে দাঁতমুখ গুলো বেজায় কুৎসিত লাল হয়ে আছে। সর্বোপরি বমি আসার উপক্রম। মনি ওর দিকে তাকাতেই ছেলেটি দাঁত বের করে হেসে বললো
-তা কেমন আছো মনি? দিনকাল কেমন যাইতাছে?
মনি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
-ভালো।
-আমারে চিনছো?
মনি কিছু বললোনা। তবে মনির উত্তরের অপেক্ষা না করেই মনির মা ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো
-তোরে যা কইছি তা কর মনি। পরপুরুষের লগে কিয়ের এতো কথা।

মনির মায়ের এমন কথায় রাগে কপালের রগ ফুলে গেলো রহিম মিয়ার। তবে জয়নাল সামনে থাকায় কিছু বললেন না উনি।
মনি চলে যাওয়ার সময় ওর দিকে কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জয়নাল। এরপর একটা বাকা হাসি হেসে তাকালো মনির মায়ের দিকে। খসখসে গলায় বললো
-চাচী কেমন আছেন?
-ভালা না।
-কেন?
-নিজের মাইয়ার কপাল পুড়তাছে দেইক্ষাও কোনো মা কি ভালা থাকতে পারে?
-মনির আবার কি হইছে?
-জানো না?
-না তো। কি হইছে মনির?
মনির মা আর কিছু বলতে পারলোনা। তার আগেই রহিম মিয়া হুংকার করে বলে উঠলো
-কথা বাড়াইস না মনির মা। পুলাডা আইছে, কিছু খাওয়াইয়া থাহনের ব্যবস্থা কইরা দে।

মনির মা সেখান থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো
-হো খাওয়ামু তো, আমার মাইয়ার চল্লিশা খাওয়ামু।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here