মন মুনিয়া পর্ব-৩০

0
912

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩০

আশা যখন মনিকে ওই কথাগুলো বলেছিলো তখন মনি অপলকভাবে তাকিয়ে ছিলো আশার দিকে। মনির এমন তাকানো দেখে আশা হাসলো। মনি ইতস্ততভাবে চুপিচুপি বললো
-এমন কেন বলতেছো আশাপু, উনারা তো তোমাদের মেহমান।
-হুহ মেহমান। কন্ঠস্বর টেনে বললো আশা।
হিমা আরিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
-হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো আরিশা, এতোটা রাস্তা জার্নি করে এলে।।

আরিশা হেসে বললো
-যাচ্ছি।
কয়েক পা গিয়ে আবারও ফিরে এলো সে। আশা অবাক হয়ে বললো
-আবার কি হলো, ফ্রেশ হবে তো।
-ফ্রেশ হবো। তার আগে বলো নীল ভাইয়া কোথায়?
-কেন? চোখ বাকিয়ে বললো আশা।
-কেন আবার, এতোদিন পর এলাম, দেখা করবোনা? কতো বছর পর বিদেশ থেকে ফিরেছে, দেখি কতোটা হ্যান্ডসাম হয়েছে। আরিশার চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি।

আশা মনে মনে ভাবলো, “এই টেপরেকর্ডার টা কি এখন আবারও আমার ভাইয়ের পিছু লাগবে নাকি?”
ওর ভাবনাচিন্তার ব্যাঘাত ঘটিয়ে আরিশা আবারও বললো
-কি হলো আশা, বলছোনা যে নীল ভাইয়া কোথায়?
-নীল ভাইয়ার কথা জানিনা। নিলয় ভাইকে দিয়ে চলবে?

আরিশা প্রথমে কিছুটা হতবাক হলো আশার কথায়। এরপর বোকার মতো হেসে বললো
-মানে?
-নিলয় ভাইয়া বাসাতেই আছে। চাইলে ওর সাথে গিয়ে গল্প করতে পারো, দেখা করতে পারো। কিহ, করবে না দেখা?
আরিশা থতমত খেয়ে বললো
-করবো, অবশ্যই করবো। ভাইয়া কোথায় আছে বলো।
-রুমেই আছে।

আরিশা নিরবে রুম ত্যাগ করলো। আশা মুখ টিপে হাসছে ওর যাওয়া দেখে। হিমা আশার মাথায় টুকা দিয়ে বললো
-মাথায় খালি দুষ্টু বুদ্ধি তাইনা।
-একটু আধটু থাকা লাগে এটা। তুমি চিন্তা করোনা ভাবী, ও আর যাই করুক, তোমার বরের পিছু লাগবেনা দেখে নিও।
হিমা হাসলো, সে বললো
-আচ্ছা আমি এখন গেলাম। ওদিকে অনেক কাজ পরে আছে।

হিমা চলে গেলে আশা গিয়ে বসলো মনির পাশে। ওর কোল থেকে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে সে একা একা মুনিয়ার সাথে এটা ওটা বলতে লাগলো। মনি তখন বললো
-তুমি উনার সাথে এমন করো কেন আশাপু?
-কার সাথে?
-আরিশা আপুর সাথে।
আশা এবার মনির দিকে তাকালো। বললো
-তুই ওকে চিনিস না মনি, তাই এমন বলছিস। ও আস্ত লোভী একটা মেয়ে আর খুবই বাজে। দেখলি না তোকে কেমন আশ্রিতা বললো৷ ও সবাইকে অপমান করে কথা বলতে পছন্দ করে। ও নীল ভাইয়ার জীবনেও অনেকবার ঢুকতে চেয়েছে, কিন্তু ভাইয়া ওকে পাত্তাই দেয়নি। কারণ ভাইয়াও ওর চরিত্র সম্পর্কে অবগত ছিলো, এখনো আছে।

-একজন মেয়ে একটা ছেলেকে পছন্দ করতেই পারে।
-ওটা ওর পছন্দ না, ছিলো আকর্ষণ। ভাইয়া চলে যাবার পর ও আরো অনেকগুলো ছেলের সাথে সম্পর্কে জরিয়েছিলো। হয়তো এখন আর কেউ নেই, সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিদায় দিয়েছে, নয়তো ওরা আরিশাকে চিনতে পেরে নিজেরাই কেটে পরেছে। তাই আবারও ভাইয়াকে জ্বালতন করতে চলে এসেছে।

মনি খেয়াল করলো আশার চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ। আশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বললো
-আমি বরাবরই ওকে পছন্দ করিনা, শুধু মায়ের বোনের মেয়ে, তাই কিছু বলতেও পারিনা।

আজ সকাল থেকেই বাসায় ছিলো না নীল। খাওয়া গোসল বাদ দিয়ে সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করেছে শুধু। সন্ধ্যের আগ নাগাদ বাড়ি ফেরার পথে বাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করানো দেখে বুঝেই নিলো আরশিয়া খালামনি এসেছে। এ গাড়িটা ওর চেনা।।গাড়িটা কেনার সময় ওর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েই গাড়িটা কিনেছিলো ওর খালু। সেটা বিদেশ চলে যাবার প্রায় দুই বছর আগে।

নীল ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকলো। ড্রয়িং রুমে রাবেয়া আর আরশিয়া বসে আলাপ আলোচনা করছে। নিলয় আর হিমাও আছে সেখানে। নীল আরশিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করে নিজের রুমে চলে গেলো। প্রথমেই সে ওয়াশরুমে ঢুকবে শাওয়ার নেওয়ার জন্য। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করেছে, সারা শরীর ধুলোয় ভরে আছে। সে গা থেকে টিশার্ট টা খুলে শর্ট প্যান্ট আর তোয়ালেটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে সে যখন গায়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হলো, মুহুর্তেই সে কারেন্ট খাওয়ার মতো শক খেলো। আরিশা ওর বিছানায় এমনভাবে বসে আছে, যেনো এটা ওরই রুম। নীল তোয়ালে পরিহিত তাই সামান্য লজ্জা পেয়ে আবারও ওয়াশরুমে ঢুকে পরতে চাইলো। তখনই পিছন থেকে ডাকলো আরিশা।
-এইযে মিস্টার,
নীল ওয়াসরুমে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পরলো।

আরিশা ওর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হাসছে। আঁড়চোখে নীলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক সে পরখ করতে লাগলো বার বার। নীল এবার লজ্জাসুচক একটা হাসি হেসে বললো
-আরে আরিশা যে, কখন এলে।
-এসেছি তো অনেক্ষন, কিন্তু বিদেশি সাহেবের তো কোনো দেখায় পেলাম না।
-আমি বাড়ি ছিলাম না তো।

আরিশা কিছু বললোনা। সে হেসে আবারও নীলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে দেখতে বললো
-বিদেশি সাহেবের বডি তো দেখছি হাই লেভেবের হয়ে গেছে । যদিও আগেও বডি স্ট্রাকচারটা বেশ ছিলো, কিন্তু এইবার একটু বেশিই জোস বানিয়ে নিয়ে এসেছো।
নীলের এবার খেয়াল হলো সে তোয়ালে পেচিয়ে আছে। সে তারাহুরো করে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো
-আমি চেঞ্জ করে আসছি।
-কিন্তু তোমাকে এইভাবেই ভালো লাগছে।

নীলের রাগ হলো কিছুটা। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিলোনা।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে দেখলো আরিশা এখনো বসে আছে। এতোক্ষণ তোয়ালে পেচানো ছিলো বলে কিছুটা জড়তা কাজ করছিলো নীলের মাঝে। তবে এখন আর সেই জড়তাটা নেই। নীল ওর মুখোমুখি বসলো। বললো
-কি বলবে এবার বলো।
-তুমি আমাকে দেখে তখন লজ্জা পেয়েছিলে?
-সামান্য।
আরিশা হাসিতে ভেংগে পরলো। প্রচন্ড শব্দ করে হাসছে সে। নীল কপাল বাকিয়ে বললো
-এতো হাসার কি হলো?
-হাসছি তোমার কথা শুনে। আমাদের এই থার্ড ক্লাস দেশে থেকেও কোনো ছেলে এভাবে লজ্জা পায় না। আর তুমি কিনা এতো উন্নত একটা দেশে বিলং করেও আমাকে দেখে লজ্জা পেলে?

নীল হাসলো। আরিশার চোখের দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় বললো
-তুমি হয়তো জানোনা আরিশা, আমি এই দেশেই বড় হয়েছি।
-আমি জানি তো।
-তাহলে হয়তো তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। জানার পরেও ভুলভাল যুক্তি দেখাচ্ছো আমাকে। আমি এই দেশে বেড়ে উঠেছি, এই দেশের সংস্কৃতি বুকে ধারণ করেছি। সামান্য কটা বছর অন্যের দেশে থেকে তাদের কালচারে আমি নিজেকে বিলিয়ে দিবো, এমন ছেলে আমি না। আর তাছাড়া, আমি লজ্জা পেয়েছিলাম কারণ আমার পরণে তোয়ালে ছিলো, আর সামনে তুমি ছিলে।।তাই।
-তাতে কি?
-যে নিজের দেশকে থার্ড ক্লাস দাবী করে, তার কাছে এইটা সত্যিই কিছুনা।

নীলের কথায় মুহূর্তেই আরিশার ফোলা মুখটা চুপসে গেলো। সে আর কিছু বললোনা।

নীল বললো
-চলে যাবে কবে?
আরিশা এবার চোখ বড় বড় করে তাকালো নীলের দিকে। উচ্চস্বরে বললো,
-আমি চলে যাবার জন্য আসিনি,কিছুদিন থাকার জন্য এসেছি।

নীল আর কিছু না বলে উঠে দাড়ালো। একটা টিশার্ট গায়ে জরিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বললো
-থাকলে থাকো, আমার আর কি।
-তুমি যাচ্ছো কোথায়?
-মুনিয়ার সাথে দেখা করতে। আজ সারাদিন দেখা করতে পারিনি মেয়েটার সাথে।

আরিশা ভ্রু বাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললো
-এই মুনিয়াটা কে?
-জেনে কি করবে?
-আমার জানার দরকার আছে। বলো কে এই মুনিয়া?
নীল বাকাভাবে হেসে বললো
-আগেও আমার উপর অনেক খবরদারি করেছো, কোনো লাভ হয়েছে কি? আমি কিন্তু কখনোই তোমার বশীভূত হয়নি। এবারও যদি এমনটা ভেবে থাকো, তাহলে বলবো তুমি এখনো আগের মতোই ভুল করছো।

নীলের কথা শুনে আরিশার রাগ হলো খুব। কিন্তু হজম করে গেলো সবটাই। এতো সহজে রেগে গেলে হার মানতে হবে কিনা।

________
বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে মনি। চাঁদ উঠেছে আজ, খুব বড় একটা চাঁদ। দেখতে ভালোই লাগছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে জোছনা বিলাশ করার তার বরাবরেরই ইচ্ছে ছিলো, তবে সেটা একা নয়। ভালোবাসার মানুষটিকে সাথে নিয়ে।

যেদিন নিয়ান বলেছিলো, সবটা সে সামলাবে, ভুলটা সুধরে নিবে সেদিন মনি ধরেই নিয়েছিলো নিয়ান ওকে বিয়ে করে সংসার করবে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো সেই নিয়ানই বুঝি ওর ভালোবাসার মানুষ। বয়সটা আরো কম ছিলো কিনা। অল্প বয়সে শুধু ভুলভাল চিন্তাভাবনা। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই মনে মনে প্রহর গুনছিলো, কবে নিয়ান ওকে বিয়ে করে বাচ্চাটার একটা নতুন পরিচয় দিবে, কবে থেকে শুরু হবে ওর জীবনের নাম না জানা এক ভালোবাসার অধ্যায়।

আজ সেইসব অতীত।

কয়েক বার ডাকার পরেও কোনো সারা দিলোনা মনি। সে গভীর ভাবনার জগতে বিভোর। এক পর্যায়ে ওর পিঠে আলতো করে স্পর্শ করলো নীল। আকস্মিক হাতের ছোঁয়া পেয়ে সামান্য কেঁপে উঠলো মনি। মনে হলো, এই অজানা শিহরনে সে ভেবে যাচ্ছে। সারা শরীরে তীব্র এক স্রোতের ধারা বয়ে গেছে তার। হটাৎ মনে হলো, কে তাকে স্পর্শ করলো।

তারাতাড়ি করে সে পিছনে ফিরে তাকালো। নীল গভীর চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে যেনো তার স্পষ্ট আকুলতা। এ কিসের আকুতি? মনি সে চোখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছেনা। সে ছুটে চলে যেতে চাইছে এখান থেকে।।

এক পর্যায়ে হুশ এলো মনির। তাও নীলের ডাকে
-কি হলো মনি, এমন করছো কেন?
মনি এক নজরে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে। এটা কি হয়ে গেলো তার সাথে? নীল তো স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, কাছেও না। বেশ খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখেই সে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে এতোক্ষন ওর মধ্যে যে একটা অনুভুতি হলো, অজানা স্পর্শ পেলো, এটা কি ছিলো? এ সবটাই কি তাহলে ভ্রম?

এটা কিসের ভ্রম? কেন তার এমন হলো? উত্তর খুজে পায়না মনি। নীল আবারও ওকে বললো
-তুমি কি অসুস্থ মনি? তোমাকে আমার কাছে কেন জানি স্বাভাবিক লাগছেনা।
মনি নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে বললো
-আমি ঠিক আছি।
-মুনিয়া কোথায়?
-ঘুমিয়ে আছে।
-তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে একা একা?
-ভালো লাগছেনা।
-বাবা মায়ের কথা মনে পরছে?

মনি আবারও বাইরের দিকে তাকালো। কিন্তু নীলের কথার উত্তর দিলোনা আর।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here