মন মুনিয়া পর্ব-৩২

0
912

#মনি_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩২
[বোনাস পর্ব]

কলেজে ভর্তির সকল ফর্মালিটি শেষ করে বের হয়ে আসে নীল। পেছন পেছন মনিও বেরিয়ে আসে। আজকের সবটাই কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে দিয়ে গেছে। মনি প্রশ্ন করার মতো কিছু ভাবতে পারছেনা।

এক পর্যায়ে মনকে স্থির করে, এইবার জিজ্ঞাসা করেই ছাড়বে। মনি ধীর গলায় নীলকে ডাকে।
-এই যে শুনছেন?
নীল পিছন ফিরে তাকায়। বলে
-আমাকে বলছো?
-হুম
-বলো..
-আমাকে হটাৎ কলেজে এডমিশন করালেন যে?
-ইচ্ছে হয়েছে তাই করিয়েছি। কেনো, কোনো সমস্যা?
-না, মানে, এখন তো ভর্তির সময় নেই, অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। তাছাড়া আমার কোনো কাগজপত্রও তো এখানে ছিলোনা। তাহলে কি করে?

নীল মনির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। মনি ইতস্তত বোধ করে তাতে। সে দৃষ্টি চটজলদি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। নীল বলে
-গতকাল রাতে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম মনি। এই কলেজের অধ্যাপক আমাদের পূর্বপরিচিত । উনার মাধ্যমেই সব ব্যবস্থা করেছি, যদিও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।৷ আর ভোরবেলা তোমার এলাকাতেও গিয়েছিলাম।

মনি অবাক হয়। বলে
-আপনি আমাদের এলাকাতেও গিয়েছিলেন?
-তা নাহলে পেপারস পেলাম কোথায়?

মনি কিছু বলতে পারেনা আর। হটাৎই বাবা মায়ের কথা মনে পরে যায় তার। নীল ওকে তাড়া দিয়ে বলে
-চলো।
-কোথায়?
-বাড়ি যাবেনা?
-ওহ! চলুন..

একটা সিএনজি ডেকে তাতে উঠে পরে দুইজনে। পুরোটা রাস্তা কেউ কারো সাথেই আর কোনো কথা বলেনি। বাসার সামনে এসে যখন সিএনজি থামলো তখন বিকেল গড়িয়েছে মাত্র। সিএনজি থেকে নেমে মনি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যায়। এরমধ্যে নীল পিছন থেকে ডাকে মনিকে। মনি দাঁড়িয়ে বলে
-কি?
-কাল সকাল সকাল রেডি থেকো।
-আবার কোথায় যাবো?
-যেতে হবে এক যায়গায়।
-মুনিয়াকে রেখে আমি আর কোথাও যেতে পারবোনা।

নীল মুচকি হেসে এগিয়ে আসে মনির কাছে। কিছুটা নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে মনির চোখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে
-গেলে তোমারই ভালো হবে। একটা দিনের কথায় তো বলেছি।
-কিন্তু মুনিয়া..
-ওর জন্য মা আছে, ভাবী আছে, আশা আছে। কোনো সমস্যা হবেনা।

মনি আর কোনো কথা বলেনা। সে চটজলদি ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সারাটা দিন ধরে মুনিয়াকে সে দেখে নি। মেয়েটা হয়তো প্রচুর কেঁদেছে।

নীল পিছনে দাঁড়িয়ে হাসে। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার দিকে। ইদানিং মেয়েটার সবকিছুই তার বড্ড ভালো লাগে।

ঘরে ঢুকে মনি দেখতে পায় মুনিয়াকে কোলে নিয়ে রাবেয়া বসে আছে। মুনিয়ার সাথে মজার মজার কথা বলছেন উনি, যেমনটা বাচ্চার দাদী নানীরা বলে থাকেন। মনির মন জুরিয়ে যায় মুহুর্তেই। সে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় রাবেয়ায় কাছে। কৃতজ্ঞতার সাথে বলে
-আজ আমার কারণে হয়তো আপনারা মুনিয়ার অনেক জ্বালাতন সহ্য করেছেন।

রাবেয়া হেসে বললো
-মেয়েটা আমাদের, নিজেদের মেয়েদের জ্বালা সহ্য করার মাঝেও এক আনন্দ আছে মনি। আগে আমার মতো বুড়ি হো, দাদী নানী হো, বুঝবি তখন এর আনন্দ কতোটা।
রাবেয়ার কথায় মনি খিলখিল করে হেসে উঠে।

নীল সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলো। মনির খিলখিল হাসি শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে পরে। আজ অব্দি একদিনও সে মনিকে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখেনি। আজই প্রথম সে দেখলো, মনির মুখ থেকে নিঃস্বরিত সে হাসির ঝর্ণাধারা পুরো ঘরটাকে মুখরিত করেছে।

এভাবে মনখুলে হাসলে মেয়েটাকে কতোটা ভালোলাগে, তা হয়তো ও নিজেও জানেনা। জানলে মেয়েটা সবসময় এভাবে হাসতো।

রাবেয়া মনির কোলে বাবুকে না দিয়ে বললো
-বাবুকে পরে নিবি। সারাদিন পথঘাট মানুষজনের ভীরে ছিলো। আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আয়। তারপর..

মনি মাথা নাড়ায়। সে চলে যায় রুমে।
নীল ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে ঢুকে। ওকে দেখে রাবেয়া বলে
-কলেজে ভর্তি করাতে পেরেছিস?
-হুম।
-যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। খেয়ে নিবি।

মায়ের কথার আর কোনো উত্তর না দিয়ে নীল নিজের রুমের দিকে এগোতে থাকে। কেন জানি ওর পা দুটো আজ চলছেনা। এক যায়গাতেই থমকে থাকতে চাইছে। বার বার ওর কানে মনির হাসির সেই ঝল্কানির সুর ভেসে আসছে।। এক অদৃশ্য কেউ যেনো ওকে বার বার কানের কাছে বলে যাচ্ছে, “তুই নির্ঘাত মেয়েটার প্রেমে পড়তে চলেছিস নীল”

নীল অবাক হয়। এমনও কি কখনো হতে পারে?

রাবেয়ার কথায় হুশ ফিরে নীলের। উনি তখন থেকেই নীলকে অবলোকন করে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিলো ছেলেটা যেনো নিজের মধ্যে নেই।। কোনো একটা ঘোরের মধ্যে যেনো ডুবে যাচ্ছে। রাবেয়া বলেন
-কি এতো ভাবছিস নীল?

নীল অবাক হয়, সত্যিই সে এসব কি ভাবছে? তরিঘরি করে মাকে সে উত্তর দেয়
-কিছুনা মা।
মাকে উত্তরটা দিয়েই সে রুমে ঢুকে পরে। যা হবার পরে হবে, এখন আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া তো দরকার। যদিও পথে মনিকে একবার বলেছিলো হোটেলে গিয়ে কিছু খাওয়ার জন্য। মনি রাজি হয়নি, মুনিয়ার জন্য বাড়ি ফেরার তার বেশ তাড়া ছিলো। নীলের ও কেন জানি মনিকে জোর করতে ইচ্ছে হয়নি তখন।

খাওয়া দাওয়া শেষে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মনি। মেয়েটাকে এসে খাওয়াতেই ঘুমিয়ে গেছে। তবুও কোলে রাখতে ইচ্ছে করছে। বিকেল প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এই মুহূর্তটা মনির কাছে বেশ লাগে। তাই সে একমনে বাইরের এই মুহুর্তটা অবলোকন করছে।

এমন সময় নীল আসে ওখানে। মনির কোলে মুনিয়া ঘুমানো। সে প্রশ্ন করে,
-মুনিয়াকে শুইয়ে দিলে না যে। ঘুমিয়ে আছে তো।
নীলের কথায় সে ঘুরে দাঁড়ায়। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে
-ওকে নিজের কাছে রাখতেই আমার আনন্দ।
-খেয়েছো কিছু?
-হুম।
-একটা কথা বলবো?
-কি কথা?

নীল এক মুহুর্ত মনির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর ধীর গলায় বলে
-তুমি কি জানো, হাসলে তোমাকে কতোটা সুন্দর লাগে?
নীলের কথায় কিছুটা লজ্জা পায় মনি। সে নীলের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নেয়।৷ নীল হাসে। মিষ্টি গলায় আবার বলে
-এভাবেই হেসো সবসময়।
-আমি হাসি তো।
-হাসো, তবে আজকের মতো মনখোলা হাসি তোমাকেই কখনোই হাসতে দেখিনি আগে।

মনি আর কিছু বলেনা। নীল আবারও বলে
-তখন কি বলেছিলাম মনে আছে?
-কিহ?
-ভুলে গেলে?
-সকাল সকাল রেডি হওয়ার কথা?
-এইতো মনে আছে।
-এতোটুকু তো মনে থাকেই।
-পুচকে মেয়ের স্মরণ শক্তি বলে কথা।
মনি হাসে। নীল তাকিয়ে থাকে সে হাসির দিকে। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, চাইলে এ হাসির মধ্যে সে ডুবেও যেতে পারবে।।

মনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে আসার জন্য পা বাড়ায়। এমন সময় কিছু একটার সাথে পায়ে লেগে সে পরে যেতে থাকে। নীল দৃশ্যটা দেখামাত্র মুহুর্তেই এগিয়ে আসে। দুইহাতে মনিকে ঝাপটে ধরে পরে যাবার হাত থেকে তাকে বাঁচায়। তবে বিপত্তি ঘটে অন্য যায়গায়।

নীলের দুইহাতের মাঝে বন্দী থাকা অবস্থায় মনি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। তবে, ওকে ছাড়ার কোনো নামই নিচ্ছেনা নীল। মনি এক হাতে মুনিয়াকে চেপে ধরে অন্যহাতে নীলের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। তবে নীল যেনো পণ করেছে, মনিকে সে আজ ছাড়বেনা। নীল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। গভীর এই চাহনির মাঝে যেনো এক মাদকতা আছে, সে চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকার শক্তি মনির নেই।

সে লজ্জিত কন্ঠে ধীরগলায় নীলকে বলে
-আমাকে ছাড়ুন।
মনির বলা এইটুকু কথা নীলের কানে যায়না। মনি আবারও বললো
-আমাকে ছাড়ুন, ঘরে যাবো আমি।
এবারেও নীলের হুশ নেই। মনি এবার বিপাকে পরে। কি করবে সে? কেউ এসে গেলে ওদেরকে এই অবস্থায় দেখে যদি ভুলভাল কিছু ভেবে বসে? মনি আতংকিত হয়।

এইদিকে ওদের এই চাপাচাপিতে ঘুম ভেংগে যায় মুনিয়ার। হয়তো দুজনের হাতের আবদ্ধের মধ্যে থেকে সে ব্যাথাও পাচ্ছিলো। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে গগনবিদারী চিৎকারে কান্না করে দেয় মুনিয়া।
সেই কান্না নীলের কাছে বোমা বিস্ফোরণের মতো লাগে। সে ছিটকে দূরে সরে যায়। আতংকিত হয়ে বলে
-কিহ, কি হয়েছে? এতো চিৎকার কিসের?
হটাৎ নীলকে এমন বোকার মতো আচরণ করতে দেখে প্রচন্ড হাসি পায় মনির। সে আবারও খিলখিল করে হাসিতে ফেটে বললো
-বোমা বিস্ফোরণের শব্দ।

নীল বিস্ময় নিয়ে বললো
-মানে?
মনি কিছু বলেনা। সে হাসতে হাসতে মুনিয়াকে নিয়ে রুমে চলে যায়। নীল বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার দিকে।

মনি চলে যাবার সাথে সাথেই ওর মাথায় আসে এতোক্ষণে করা সমস্ত কর্মকান্ডের কথা। মনিকে পরে যাবার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে কিভাবে ওকে এতোটা সময় আঁকড়ে ধরে ছিলো, ভাবতেই মনে মনে কিছুটা লজ্জা পায় সে। একা একা সে হাসে।

হটাৎ নীল ভাবনায় পরে, ওর এহেন কর্মকান্ডের জন্য মনি ওকে সুবিধাবাদী লোক ভাববে না তো? ছিঃ ছিঃ, এমন কিছু ভাবলে সে মনির সামনে আসবেনা কখনো।

পরক্ষনে ভাবে, “ও তো পরে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই মনিকে এভাবে ধরেছিলো, সুবিধাবাদী ভাবার কোনো চান্সই নেই। ”
নীল পা বাড়ায় সামনের দিকে। আবারও ওর মাথায় একই কথা কিলবিল করতে থাকে। সে একহাতে মাথা চুলকায়। মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,

“মনি কি সত্যিই আমাকে সুবিধাবাদী লোক ভাববে?”

চলবে…..

[হুহ দিয়া দিলাম🤐 এবার আমারে মিষ্টি খাওয়াও😋]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here