মন মুনিয়া পর্ব-৩৯

0
868

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৯

মাঝরাতের পর হটাৎ ই ঘুমটা ভেংগে গেলো মনির। সে পাশ ফিরে মুনিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ওপাশে আশাপুও ঘুমাচ্ছে আরামে।

মনির ঘুম উধাও হয়ে গেলো এরই মাঝে। মাথার মধ্যে ভর করলো অন্য চিন্তা। এভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো, এ বিয়ের কি কোনো মানে আছে? কপালের উপর হাত দিয়ে মনি চোখ বন্ধ করলো। হাজার চিন্তা কাজ করছে মাথায়। এ বিয়ের পরিণতি কি হবে, সেটা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও এ বিয়েটা সম্পর্কে সকলে অবগত নয়। তাতে কি, বিয়ে তো হয়েছে। মনি ধীর গতীতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মুনিয়া আর আশার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসলো সে।

দরজার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা খোলে উকি দিলো নীলের রুমের দিকে। সেদিনকার মতো আজও ঘরে লাইট জ্বালানো। তবে আজ দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো নয়। শুধু ভিড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মনির মনের এক প্রান্ত থেকে কেউ একজন তাগাদা দিচ্ছে ও ঘরে যাবার জন্য। মনি এক পা বাড়ালো। এরই মধ্যে মনের অন্য প্রান্ত থেকে আরেকজন বলে উঠলো, “যাসনা মনি, ভুলেও যাসনা। মেয়েদের মন বুঝা বড় দায়। যদি ভুল করে ওর প্রেমে পরে যাস? প্রেমে তো পরে গেছিস অনেক আগেই, কিন্তু প্রেমের গাড়িটায় এখনো তুই উঠিস নি। একবার উঠবি, তো মরবি।”

মনি দোনোমনায় ভুগতে থাকে। এ অবস্থায় তাকে কি করা উচিত কিছুতেই মাথায় আসছেনা। এক পর্যায়ে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে ও ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায় মনি।

দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আরো দুবার ভাবলো সে, “এতো রাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?” পরক্ষণে মাথা থেকে সে প্রশ্নটা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে নিজে ধমক দিয়ে বললো, “কি আজেবাজে ভাবছিস তুই মনি, সেদিন রাতেও তো গিয়েছিলি, ও কি তোর কোনো ক্ষতি করেছে? রাতের আধারে তোকে একা পেয়েও তোর গায়ে পর্যন্ত একটা আচঁড় কাটেনি ছেলেটা। ওকে নিয়ে এতো বাজে চিন্তা আসে কোথা থেকে তোর মাথায়?

মনি আর কোনো চিন্তা ভাবনা না করে দরজাটা ভিড়িয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো সে। নীল আজো বসে ল্যাপটপে কি যেনো করছিলো। মনিকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ওর তাকিয়ে তাকিয়ে হাসলো সে। শান্ত গলায় বললো
-এসো মনি।

মনি অবাক হলো। নীলের কথার ধরনে বুঝা যাচ্ছে সে আগে থেকেই জানতো মনি এ ঘরে আসবে। মনি দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে নীলের কাছে গেলো। বিস্মিত গলায় বললো
-আপনি জানতেন আমি আসবো?
-হুম। আর সেজন্যই দরজাটা খুলে রেখেছিলাম।
-কিভাবে বুঝলেন?
-বউ এর মনের কথা না বুঝলে আর কার কথা বুঝবো?
মনি ব্রু বাকালো। নীলে হেসে বললো
-রাগলে তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে মনি। আমি চোখ ফেরাতে পারি না তখন।

মনি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বললো
-আজও কাজ করছিলেন?
-হুম। এ মাসের শেষের দিকে আমার ফ্লাইট। হাতে মাত্র আর ১৪/১৫ দিন সময় আছে। তাই চাইছি কাজগুলো জলদি শেষ করে ফেলতে।
মনি একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-কাজ শেষ করতে কতোদিন লাগবে?
-আর দুই তিনদিন করলেই শেষ হয়ে যাবে।
মনি আর কিছু বললোনা। তবে চোখেমুখে এক অজানা আর্তনাদ কাজ করছে তার।

-তোমার মন খারাপ মনি?
-আমার কেন মন খারাপ হতে যাবে?
-আমি চলে যাবো তাই?
মনি বড় বড় চোখ করে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো
-আপনার এমন কেন মনে হচ্ছে যে আপনি চলে গেলে আমার মন খারাপ হবে?
-তোমার চোখ দেখলেই আমি বুঝি মনি, ভালোবাসি তো তাই।

মনি উঠে দাড়ালো। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল
-আমি যাচ্ছি।
নীল উঠে মনির পেছনে দাঁড়ালো। আলতো হাতে মনিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো
-আমার কাছ থেকে কেন এভাবে পালাতে চাইছো মনি, আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো।
মনি তৎক্ষনাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো
-কচু জানেন আপনি।

নীল হাসলো। মনি আবারও পা বাড়ালো দরজার দিকে। পিছন থেকে নীল বললো
-আগামীকাল তোমার কলেজ আছে, সকাল সকাল উঠতে হবে, তাই ঘুমিয়ে পরো গিয়ে।
মনি দাঁড়িয়ে পরলো। থমথমে মুখে বললো
-মুনিয়াকে রেখে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
-আমি জানি মনি, তবে কালকের ক্লাসটা করো, এরপরে আর রেগুলার যেতে হবেনা। আমি কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি এ বিষয়ে। উনারা মেনে নিয়েছেন ব্যাপারটা।

মনি অবাক হলো। এই নীল ওকে নিয়ে এতো কেন ভাবে? শুধু ভালোবাসে বলে?
মনি আর কোনো কথা বাড়ালো না। সে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে শুতে যাবার জন্য বিছানায় এগুতেই মনি দেখতে পেলো আশা বসে আছে। মনি হতভম্ব হয়ে গেলো, আশা কি ভাববে ভেবে অস্থিরও হয়ে গেলো সে। সে জোরপূর্বক হাসি হেসে আশাকে বললো
-বসে আছো কেন আশাপু?
-কোথায় গিয়েছিলি মনি? থমথমে মুখে বললো আশা।
মনি থতমত খেয়ে আমতাআমতা করে বললো
-পানি খেতে গিয়েছিলাম আশাপু।

আশা হাসলো। হাতের কাছে থাকা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বললো
-বস আমার কাছে মনি।
মনি আশার এক কথায় বসে পরলো। কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত সে।
আশা বললো
-মিথ্যা কেন বলেছিস আমার সাথে?
-কিক, কি মিথ্যা বলেছি?
-তুই ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলি তাইনা?

মনি প্রচন্ডরকম অবাক হলো। আশাপু কি করে জানলো এটা? সে কি আমার পিছু নিয়েছিলো? সবটা জেনে গেছে?
আশা আবারও বললো
-কি রে, কথা বলছিস না যে?
মনি ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বললো
-নাহ মানে।
-আমি জানি সবটা।
মনি বিস্ময়ে আশার দিকে তাকালো। ভয়ার্ত গলায় বললো
-কি জানো?
-তোর আর ভাইয়ার কথা। আমি সেদিন রাতেই সবটা জেনেছি, যেদিন তুই প্রথম ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলি।

মনি হতভম্ব। সে বিস্ময়ে না পারছে কথা বলতে, আর না পারছে নড়তে। আশা হেসে বললো
-সেদিন রাতে যখন তুই বিছানা ছেড়ে উঠে ও ঘরে গিয়েছিলি, তখনই আমার ঘুম ভেংগে গিয়েছিলো। আমি তোর পিছু নেইনি কিন্তু। সকালে ভাইয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছি, ও তোকে পছন্দ করে আর ভালোও বাসে। আর রাতে যে তোদের বিয়ে হয়েছে সেটাও আমি জানি, ইনফ্যাক্ট ভাবিও জানে।

মনি আঁতকে উঠলো। সে চটজলদি করে বললো
-কি করে জানলে?
-ভাইয়া বলেছে।
-তাহলে তোমরা যে তখন অন্য কথা বললে?
-আমরা খেয়াল করছিলাম তুই অস্বস্তিতে পরে যাচ্ছিলি। তোর অস্বস্তি কাটানোর জন্যই কথা ঘুরিয়ে বলেছিলাম।

মনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর হটাৎ অপরাধির মতো করে বলে উঠলো
-আমার কোনো দোষ নেই আশাপু, বিশ্বাস করো। আমি এ বিয়েটা না করলে তোমার ভাইয়াকে ওরা মারধোর করতো।
আশা হেসে বললো
-আমি জানি মনি, তোর মন মানসিকতা কেমন সেটা আমরা সবাই জানি। তুই এতো উতলা হোস না। তবে বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে, তখন এটাতে আর দ্বিমত করিস না। ভাইয়া কিন্তু সত্যিই তোকে অনেক ভালোবাসে।

মনি অবাক হয়ে শুনছে আশার কথা। বিপরীতে কিছু বলতে পারছেনা সে। আশা আবারও বললো
-আমাদের ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড অন্যান্য ফ্যামিলির চাইতে অনেক আলাদা। তুই হয়তো অবাক হবি, আমার বাবা মা দুইজনই এম এ পাস। উনারাও লাভ ম্যারেজ করেছে। তাই বর্তামানের নানামুখী কুসংস্কার উনারা বিশ্বাস করেন না। ভালোবাসাতেও উনাদের কোনো দ্বিমত নেই। হিমা ভাবী আমাদের কাজিন হওয়া স্বত্বেও নিলয় ভাইয়া যখন তাকে পছন্দ করে, তখন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাদের বিয়ের আয়োজন করেছেন আমার বাবা মা।।এতো বছর পরেও ভাইয়ার কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি, তাও আজ পর্যন্ত আমার ফ্যামিলির একটা সদস্যও ভাবিকে তুচ্ছ করে কথা বলে নি। কেন জানিস?
-কেন?
-কারণ আমার মা বাবা আর আমরা সবাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, যা হচ্ছে তা সবই আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে। তাতে মানুষের কোনো হাত নেই

মনি বললো
-সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয় আপু। এটাতো সবাই জানে।
আশা হাসলো। বললো
-সবাই জানে মনি, মানে কয়জন বল?
মনি অবাক হলো আশার কথায়। আশা আবারও বললো
-এ সমাজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ মনি, এ সমাজে ধর্ষিতা নারীর কোনো সম্মান নেই, সমাজ তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। নারীর মাথায় কলংকের বোঝা চাপিয়ে সেই ধর্ষণকারী সমাজে মাথা উচু করে হাটে। লোকে বলে, পুরুষ মানুষের আবার দোষ কিসের। এমন একটু আধটু পাপ পুরুষেরা করেই থাকে।

মনি মাথা নিচু করে ফেললো আশার কথায়। চোখের কোনায় এক ফোঁটা পানিও এসে জমলো। আশা ওর হাত দিয়ে মনির চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বললো
-মনে কষ্ট না নিয়ে মাথার মধ্যে আমার কথাগুলো ঢুকা মনি, ভালো করে শুনে দেখ, আমার কথায় অযৌক্তিক কিছু খুজে পাস কিনা।

মনি তাই করলো। সে আবারও মনোযোগ দিলো আশার কথায়। আশা বলতে শুরু করলো..
-এমন কয়টা ফ্যামিলি দেখেছিস মনি, যেখানে সন্তান না হলে বউকে মাথায় তুলে রাখে? হাতেগোনা কয়েকটা বোধহয় পাবি। তবে তারাও অবহেলিত। যে সংসারে ছেলেমেয়ে হয়না, সে সংসারে কিন্তু মেয়েদেরও যায়গা হয়না। বাচ্চার অজুহাতে মেয়েটাকে মেরে ধরে ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত হয়ে যায়। সবাই মেয়েটির দিকে আংগুল উঠায়। সমস্যাটা পুরুষেরও হতে পারে, সেই চিন্তাটা কিন্তু অনেকেই করেনা।

মনি সায় জানালো কথাটায়। আশা হেসে বললো
-নিজের শক্তি কোথায় জানিস?
মনি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আশা বললো
-নিজের শক্তি হচ্ছে নিজের মনের ভিতরে। আজ তুই নিজেকে অপরাধী ভাবছিস, ভাইয়াকে তাই ভালোবেসেও ফিরিয়ে দিতে চাইছিস, একবার পজেটিভলি ভাব মনি, একবার চিন্তা কর, এটা তোর ইচ্ছেতে হয়নি, আল্লাহ হয়তো চেয়েছিলো তোর এমন কিছু হোক, যার মাধ্যমে তোর সাথে ভালো কিছু হতে পারে, তাই এমনটা হয়েছে। মনে জোর পাবি।
-আমার সাথে যা হচ্ছে, যা হয়েছে তাতে আমার কপালে কি এমন ভালো লেখা থাকতে পারে আশাপু? মলিন গলায় বললো মনি।

-এখানে দোষ কিন্তু তোর না, দোষটা নিয়ানের। সে শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে এমনটা করেছে। এটার শাস্তি নিশ্চিয় আল্লাহ তাকে দিবে। কিন্তু এই কাজের পিছনে তোর তো কোনো ইচ্ছে ছিলোনা বল, কিন্তু তোর সাথে এমনটা হয়েছে। আল্লাহ তোকে এটার মাধ্যমে হয়তো পরীক্ষাও নিচ্ছে। আল্লাহ মানুষকে নানান ভাবে পরীক্ষা নিয়ে থাকে, উপলব্ধি কর মনি।

মনির মনের ভেতর হটাৎ এক অজানা চিন্তা বাসা বাধলো। আশার বলা সমস্ত কথাগুলো ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে লাগলো বার বার।

আশা বললো
-আমরা এক্ষুনি কাউকে বলবোনা তোর আর ভাইয়ার বিয়ের কথা। ভাবীও বলবেনা। ভাবী আমাদের ভাবী না, বড় বোনের চেয়েও বেশি।। আমরা সকলে চাই তুই লেখাপড়া কর, ওইদিকে ভাইয়াও গ্র‍্যাজুয়েশনটা শেষ করুক। তুই ঠকবিনা মনি, এইটুকু বিশ্বাস আমাদের উপর করতেই পারিস।

মনি একবার দরজার দিকে তাকালো। এরপর আবারও আশার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো
-আমায় একটু সময় দাও আশাপু।
-ওকে। এখন ঘুমিয়ে পর। সকালে কলেজ যেতে হবে তোর।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here