মন মুনিয়া পর্ব-৪৩

0
885

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪৩

চারিদিকের হৈ-হুল্লোড় ফুরিয়ে একসময় নিস্তব্ধতা নেমে এলো ধরার বুকে। বাতাসের সাথে তীব্র ঝিঝিপোকার আর্তনাদ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পরতে থাকে। জোনাকিরা দলবেঁধে এধার ওধার ঘুরেফিরে আনন্দ করায় মত্ত হয়।

মনির মনে নেই কোনো আনন্দ। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে সকলে সকলের রুমে চলে যায়। আজ নীলও আসেনি খাওয়ার জন্য। রাবেয়া নিজ দায়িত্ব ওর খাবারগুলো ওর ঘরে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাপারটা প্রচন্ডভাবে আঘাত করে মনির মনের কোঠরে। আসলেই সে ঠিক নাকি বেঠিক বুঝতে পারছেনা। মনি সিন্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক, আজ সে নীলের সাথে কথা বলবেই। হটাৎ এমন একটা সিন্ধান্ত নেওয়ার মানেটাই বা কি।

রাতের আধার ধীরে ধীরে গাড় হতে থাকে, বাড়ির মানুষজনও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমের গভীরে পাড়ি নেই। মনি আশার দিকে বারংবার তাকায়। সে ঘুমিয়ে আছে। মনি সামনের দিকে পা বাড়ায় খুবই সতর্কতার সঙ্গে । যদিও আশা জানে সবটা, তবুও এভাবে এতো রাত করে নীলের সাথে দেখা করতে যাওয়া, ব্যাপারটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।

একটা সময় নীলের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় মনি। কি করে কি করবে, কি বলা উচিত মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে তার। মনের মধ্যে এক অজানা ভয় উঁকি দিতে লাগলো হটাৎ। এইসব দোনোমোনোর মাঝে এক সময় দরজায় আস্তে করে টুকা দিলো মনি। প্রথম টুকাতে কোনো কাজ হলোনা। দ্বিতীয়বার সে আবারও টুকা দিলো৷ এবারেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আরেকবার টুকা দিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে ঝরের বেগে দরজাটা খুলে যায়। টাল সামলাতে না পেরে মনি গিয়ে পরে নীলের উপর।

কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে যায়। মনি এখনো নীলের বাহুডোরে আটকা পরে আছে। দুইজন দুইজনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো কতোক্ষণ তা কারোরই জানা নেই। হটাৎ হুশ ফিরে নীলের। সে চটজলদি মনিকে নিজের কাছ সরিয়ে নেয়। সম্ভিত জ্ঞান ফিরে আসায় মনিও লজ্জা পায়, লজ্জায় সে মাথা নোয়ায়।।

নীল গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করে
-এতো রাতে এখানে?
মনি অবাক হয়ে তাকায় নীলের দিকে। আজ অব্দি সে মনির সাথে এভাবে কথা বলেনি। নীল তাড়া দিয়ে বললো
-কিছু বলছোনা যে। কোনো দরকারে এসেছো?
-নক করছিলাম এতোক্ষন। কোথায় ছিলেন? শান্ত গলায় বললো মনি।
-ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
-ওহ।
-কি বলবে বলো।
মনি ধীরে ধীরে নীলের দিকে তাকায়। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকে নীলের মুখের দিকে। নীল চোখ সরিয়ে নেয়। চোখমুখ আগের তুলনায় আরো শক্ত হয়ে যায় তার।

মনি অপরাধীর মতো করে বলে
-আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?
-আমি কারো উপর রেগে নেই।
-তাহলে এভাবে কথা বলছেন যে?
-আমার কথায় কষ্ট পেলে আমি স্যরি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। তোমার ভালো না লাগলে চলে যেতে পারো।
মনি অতি কষ্টে চোখ বন্ধ করে। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
-আপনি পরশু চলে যেতে চাইছেন কেন?
-সেটা আমার ব্যপার। তোমার কাছে নিশ্চয়ই এর জবাবদিহি করবো না।
মনি অবাক হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মানুষের মধ্যে আমুল পরিবর্তন। এও কি সম্ভব?

নীল আবার গম্ভীর গলায় বললো
-কিসের জন্য এসেছিলে বললে না যে? কিছু বলার না থাকলে চলে যাও। আমার কাজ আছে, আমাকে আমার কাজগুলো কমপ্লিট করে রাখতে হবে।
মনি নিচের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর স্বরে বললো
-আমাকে মাফ করে দেয়া যায় না?
-কিসের জন্য? ভ্রু বাঁকিয়ে বললো নীল।
-যে কারণে আমার উপর রেগে আছেন।
-আমিতো বলেছি, আমি কারো উপর রেগে নেই।

মনি এবার চোখমুখ বন্ধ করে একদমে বললো
-আমি আর কখনো আপনাকে ফিরিয়ে দিবো না। তবুও আপনি এভাবে চলে যাবেন না দয়া করে। আমি থাকতে পারবোনা। এতোটা কঠিন হবেন না প্লিজ প্লিজ।
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা চলতে থাকে রুমের মধ্যে। মনির মনের মধ্যে ধুকধুক করতে থাকে অহরহ। সে এখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নীলের কোনো কথার আওয়াজ কিংবা সাড়াশব্দ ওর কানে আসছে না। মনি চিন্তিত হয়। সে সাথে মনের মধ্যে অজান ভয় চেপে বসে। নীল রেগে যায় নি তো আবার? সে কি সত্যি সত্যিই মনিকে ইগ্নোর করতে শুরু করেছে? মনি যে মারা পরবে এবার। প্রচন্ডরকম অস্থিরতা কাজ করতে থাকে মনির মধ্যে।এমতাবস্থায় খুব কান্নাও পায় ওর।

বন্ধ চোখে থেকেও এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। এই বুঝি সব শেষ। এই বুঝি ভালোবাসার মানুষটিকে সে হারিয়ে ফেলেছে। মনের মধ্যে অজানা শূন্যতা বোধ করতে থাকে সে।। তখনও নীলের কোনো সাড়াশব্দ সে পায়নি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সে চোখদুটো মেলে সামনে তাকায়।

নীল ভ্রু বাকিয়ে মনির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলকও পরছেন না তার। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলে আছে। মনি বুঝার চেষ্টা করলো, এটা কিসের হাসি। ভালোবাসার নাকি ঘৃণার। মনির মন কেন জানি বার বার জানান দিলো, এটা তাচ্ছিল্যের হাসি। মনির মনের বাধ ভেংগে গেলো। চোখ বেয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো বার বার। নীল আলতো হাতে মনিকে দুপাশ থেকে ধরলো। মনি চমকে উঠলো।

নীল চোখ মুখের গম্ভীরতা কাটিয়ে সেখানে একরাশ মিষ্টি কন্ঠের ঝটা টেনে মৃদু গলায় বললো
-এ চোখে কান্না মানায় না মনি। এ চোখে আমি পানি নয়, ভালোবাসা দেখতে চাই।
মনি অবাক নয়নে কিছুক্ষণ নীলের দিকে তাকিয়ে থেকে হটাৎ বিস্মিত গলায় বললো
-তার মানে, আপনি আমার উপর রেগে থাকেন নি?
-তোমার উপর রাগ করবো, তাও আমি!!
-তাহলে এতোক্ষণ এভাবে কথা বলছিলেন যে?
-ভালোবাসা আদায় করছিলাম। এটা হলো ভালোবাসা আদায় করার নিঞ্জা টেকনিক।

মনি লাজুক হাসি দিলো। মিহি গলায় বললো
-ভালোই যখন বাসেন, তাহলে এভাবে কেন চলে যাচ্ছেন?
-যেতে তো হবেই। আজ নাহয় কাল।
-তাই বলে পরশু? আপনার হাতে তো আরো কিছুদিন সময় ছিলো। আমার উপর রাগ দেখিয়ে কেন এভাবে আগে আগে চলে যাচ্ছেন?
নীল মনিকে এক হাতে নিজের সাথে আলতোভাবে জরিয়ে ধরে বললো
-আমার বউ, আমার মেয়ে আর সর্বোপরী আমি আমার ফ্যামিলির সাথে থাকতে চাই। তবে লেখাপড়াটা কমপ্লিট করতে হলে কিছু মায়া ত্যাগ করে যেতেই হবে। তাই বলে আমি এতোটাও গাধা নয়, যে হাতে সময় রেখেও আগে আগে চলে যাবো। আমার যাওয়ার সময় হলেই আমি যাবো।

মনি নীলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামান্য অভিমানী গলায় বললো
-তার মানে, আপনি অভিনয় করেছেন সবার সাথে, আর সেই অভিনয় করে আমার মুখ থেকে ভালোবাসার কথা আদায় করে নিয়েছেন তাইতো??
নীল হাসলো। বললো
-অভিনয় করে যদি নিজের ভালোবাসা নিজের করে পাওয়া যায়, তাহলে আমি সেই অভিনয় বার বার করতে রাজি আছি।
মনির মুখে হাসি ফুটলো৷ হাসিমাখা মুখে লাজুক কন্ঠে বললো
-আপনি আসলেই একটা স্বার্থপর।।
-ভালোবাসার ব্যাপারে স্বার্থপর না হলে চলে না। আমি সত্যিই স্বার্থপর মনি, ভালোবাসাকে নিজের করে নিতে আমি এমন স্বার্থপর বার বার হবো।

_____
সকালের ফুরফুরে বাতাস, দুপুরের কাটফাটা রোদ, আর বিকেলের হিমেল হাওয়া,,, সব মিলিয়ে দিন ভালোভাবেই এগুচ্ছে। দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো। কোচিং এ আবার যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আর যাওয়া হয়ে উঠলো না মনির। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে কোচিং সেন্টার টা এখান থেকে সরিয়ে স্কুলের কাছে নেওয়া হয়েছে। আর স্কুলটা এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। আর যে কারণে মনির আর সেখানে যাওয়া হয়নি। এভাবে প্রতিদিন মুনিয়াকে রেখে যাওয়া সম্ভব না। এখনো দুধের বাচ্চা মেয়েটা। কিভাবে মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিবে সে।।

আশার ঢাকায় যাবার সময় হয়ে এলেও সে যাচ্ছেনা। একেবারে ভাইকে বিদায় দিয়ে তারপর সে যাবে। এমনটাই মনে মনে ভেবে রেখেছিলো সে। কিন্তু বিপত্তি হলো আরেক যায়গায়। এমন এক বিপত্তি, যার জন্য এখন মনে হচ্ছে চলে যাওয়াটাই ব্যাটার ছিলো।

বাড়িতে আজ জমজমাট বাজার করে আনা হয়েছে। নীল আর নিলয় দুই ভাই মিলে আজ বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে এসেছে। হিমা আর রাবেয়া মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে তুলছে। রাত পোহালেই মেয়েকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। সেই নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই আশার। এ কি শুরু হয়েছে বাড়িতে? খেয়ে দেয়ে কি কাজ নেই, এবার সবাই ওর বিয়ের চিন্তায় কেন পরেছে। এই অকাজের ঢেকির চিন্তাটা কে ঢুকিয়েছে ওদের মাথায়?

রাবেয়া আজ মহা খুশি। মেয়ের জন্য ভালো একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে তারই এক দুর সম্পর্কের ভাই। ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। ফ্যামিলিও ভালো। দেখতেও নাকি মাশআল্লাহ। ভালো একটা ফ্যমিলিতে মেয়ে বিয়ে দিতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলের বায়োডাটা শুনেও মনে হলো, ছেলেও বেশ ভালো। ছবিতে দেখেছে ওরা। নীল আর নিলয়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে। ওদের বাবারও মত আছে এতে। ঠিক সময় ঠিক পাত্র হাতছাড়া করাটা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। আজকাল পাত্রের অভাব নেই, তবে সুপাত্রের বড্ড অভাব। তাই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না উনি।

ওদিকে রান্নাঘরের কোনায় বসে ঘ্যানরঘ্যানর করে যাচ্ছে আশা। বেশ রাগ হচ্ছে তার। এটা কি ধরনের কথা। কথা নেই, বার্তা নেই, এক ধরনের টর্চার করা শুরু করে দিয়েছে ওর উপর। হিমা হাতের কাজগুলো সাড়ছে। পাশেই মুনিয়াকে নিয়ে বসে আছে মনি।

আশাকে এভাবে পাগলের মতো প্রলাপ করতে দেখে মুচকি হেসে হিমা বলল
-মাথাটা ঠান্ডা রাখ আশা, তা নাহলে পরে আফসোস করবি।
-আফসোস কেন করতে যাবো?
-হাবিকে দেখে মাথা ঠিক থাকবেনা তাই।
আশা মুখ বাকালো। মনি হেসে বললো
-ছেলের ছবিটা তোমার দেখা উচিত ছিলো আশাপু। অনেক সুন্দর দেখতে। তোমার ভাইয়ের চেয়েও সুন্দর।
-কোন ভাইয়ের চেয়ে?
-নীল… কথাটা বলেই জিভে কামড় দিলো মনি। হিমা আর আশা কেমন করে যেনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনি জোরপূর্বক হেসে বললো
-নাহ মানে, এমনি বলছিলাম আরকি।
-ওহ আচ্ছা। তার মানে, আমার ভাইয়ের দিকে ইদানিং বেশ নজর দেওয়া হচ্ছে তাইনা?
-কি যে বলো না।
মনি লজ্জা পেয়ে গেলো ওদের কথায়।

এক পর্যায়ে কথা ঘুরাতে সে হিমার দিকে তাকিয়ে বললো
-আশাপুর জন্য যে পাত্রটা দেখতে আসবে তার কি যেনো নাম ভাবী?
-শাহরিয়ার শ্রাবণ
-বেশ সুন্দর নাম। আশাপুর নামের সাথে বেশ মিলেছে তাইনা।
-ওই, কিভাবে আমার নামের সাথে ওই নাম মিললো? রাগি গলায় বললো আশা।
মনি মুচকি হেসে বললো
-আশার শ্রাবণ, মানেনা তো মন।
-এই পাজি মেয়ে, চুপ থাক। এই আশা সেই আশা নয়। ওটা আষাঢ় মাসের নাম
-বানান যাই হোক, উচ্চারণ তো এক।
-মাইর খাবি বললাম মনি।
আশার মুখে এই কথা শুনে মনি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হিমা বললো
-এখন থেকে বুঝে শুনে কথা বলবি আশা।
-কেন? ভ্রু বাকিয়ে বললো আশা।
-কারণ, ছেলে হচ্ছে প্রোফেসর । মাঝে মধ্যে লেকচারারও নাকি দিয়ে থাকে। কিছু উল্টাপাল্টা করবি, একগাদা লেকচার শুনিয়ে দিবে।
-কোথাকার প্রফেসর?
-মনি যে কলেজে ভর্তি হয়েছে, সেখানকার। সদ্য জয়েন করেছে নাকি শুনলাম। আগে কিছুদিন লেকচারার হিসেবে অন্য একটা কলেজে ছিলো। এখন প্রফেসর হয়ে এখানে এসেছে।
-আমার কলেজের?
-হুম।
-তাইতো ছবিটা দেখা মাত্র আমার কেন জানি মনে হলো উনাকে কোথায় যেনো দেখেছি। হয়তো সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি।
-হতেও পারে। হিমা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আবারও কাজে মন দিলো।

আশার মনের মধ্যে খটকা দেখা দিলো। এই কলেজের টিচার!! তবে কে সে? এখন তো ছবিও চেয়ে দেখতে পারবেনা। ফাজিলগুলো মশকরা করা শুরু করে দিবে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here