মন মুনিয়া পর্ব-৪৯

0
1142

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪৯

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে আশা। খুব ধকল গিয়েছে আজ তার উপর দিয়ে। সারাদিন জার্নি করার পর এখন আর গা টা নাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। যদিও শ্রাবণ ওকে বাসার সামনে এসে নামিয়ে দিয়ে গেছে।

আশা মনে মনে ভাবলো, “ছেলেটা আসলেই অনেক দারুণ।” দেখতে স্মার্ট, দায়িত্বশীলও বটে। কথাটা ভেবেই আশার ঠোঁটের কোনে হাসির আভা দেখা গেলো।
________

দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেলো। ইদানীং প্রায়শই মনি কলেজে যাতায়াত করছে, লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেছে। মুনিয়াও বেড়ে চলেছে একটু একটু করে। নীলের সাথে রেগুলার কথাও হচ্ছে ভিডিওতে।
সেদিন মা বাবার কথা খুব করে মনে পরছিলো মনির। ইচ্ছে করছিলো, একবার চোখের দেখা দেখে আসুক। কিন্তু এতোটা দূরের রাস্তা একা যাবার সাহস করতে পারে না সে। হাতের কাজকর্ম সেড়ে আশাকে কল করে মনি। সেই যে গেছে, আর আসেনি। আশা ফোন রিসিভ করেই বললো
-কি, রে। এতোদিন পর কিভাবে মনে পরলো?
-মনে পরে আশাপু। মুনিয়া বিরক্ত করে, কলেজেও যায়, পড়াশোনাও করি, তাই কল দিতে পারি না।
-বুঝেছি। কি করছিস এখন?
-করছিনা কিছু। তুমি আসছোনা কেন বাড়িতে?
-আসবো। লেখাপড়ার একটু চাপের মধ্যে ছিলাম।
-কবে আসবে?
-কেন?
-একটু বাড়ি যেতে চাইছিলাম। যদি তুমি আসতে।
-আমাকে নিয়ে যাবি?
-হুম।
-ওকে, আমি এমনিতেও দুই একদিনের মধ্যেই আসতাম, তুই যেহেতু বলছিস, তাহলে কালই চলে আসবো।
-সত্যি।
-হুম।

খুশিমনে ফোনটা কেটে দিলো মনি। মনের মধ্যে এক অজানা আনন্দ কাজ করছে তার। এতোদিন পর বাবা মায়ের সাথে দেখা হবে, ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে এক আনন্দের স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে।।

পরের দিন আশা এলে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পরে মনি। মুনিয়াকে সুন্দর একটা জামা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সাথে। মুনিয়া বসতে শিখেছে, এখনো হাটা শিখেনি।। তবে, মাঝে মাঝে দাড়ানোর চেষ্টা করে একা একাই। কিছুতে ধরে এক দুইটা এগোতেও পারে। আশা ওকে কোলে নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।

যেহেতু মনিদের ওখানে ট্রেনে যাবার মতো ব্যবস্থা নেই, তাই একটা সিএনজি রিজার্ভ করে আশা। পুরো রাস্তা সিএনজি তে করেই যাবে।। সেই মনোবাসনা থেকেই সিএনজি তে গিয়ে উঠে বসে ওরা।
কয়েক ঘন্টার জার্নি শেষ করে অবশেষে মনিদের এলাকায় গিয়ে পৌছায় ওরা। এতোদিন পর নিজের এলাকায় পা রেখে নিজের মধ্যে যেনো প্রাণ খুজে পেলো সে। মুনিয়া এখনো আশার কোলে। মনি যদিও দুই একবার নিতে চেয়েছে, কিন্তু আশা দেয় নি। মনিও আর বিশেষ কোনো জোর করেনি।

বাড়ির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য মনি দাঁড়িয়ে পরে। আশা ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করে
-দাঁড়িয়ে পরলি কেন?
-মুনিয়াকে নিয়ে এসেছি। মা বাবা উল্টোপালটা কিছু ভাববে না তো?
-ভাইয়া তো অনেক আগেই বলে দিয়েছিলো মুনিয়া তোর আর ভাইয়ার মেয়ে।
-বলেছিলো তো।
-তাহলে আর ভয় কিসের। তুই বাড়ির ভেতর ঢুক তো। আমিও আসছি তোর পিছু পিছু।
মনি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দেউরি দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।

উঠোনের এক প্রান্তে বসে বাঁশের বেত দিয়ে খাঁচা বুনছিলো রহিম। মুখে একটা জলন্ত বিড়ি ধরানো ছিলো। পাশেই গরুকে পানি খাওয়াচ্ছিলো মনির মা। এতোদিন পর বাবা মাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে মনি ডাকলো
-মা, আব্বা….
মনির ডাকে দুজনেই চমকে তাকালো। রহিম খাঁচাটা হাত থেকে রেখে উঠে দাড়ালো। বিড়ির শেষ টানটা দিয়ে সেটা ফেলতে ফেলতে বলল
-কেডা, মনি নাকি!
-হু আব্বা।
ততোক্ষণে ওর মাও এগিয়ে এলো ওদের কাছে। মনি রহিমের কাছে এসে রহিমকে হটাৎই জরিয়ে ধরে বললো
-কেমন আছো আব্বা?
-ভালা আছি মা। হটাৎ আইলি, কোনো খবর দিলি না যে। কোনো বিপদাপদ হইছে?
-না আব্বা৷ তোমাদের দেখতে মন চাইছিলো খুব।
-ওও।

মনির মা মেয়েকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বললো
-কেমন আছিস মা?
-ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো? তোমার শরীর ভালো তো?
মনির মা এক গাল হেসে বললো
-আল্লাহ ভালোই রাখছে। তোর শরীরডা ভালা?
-হুম।
-আয় ঘরে আয়।
মনির মা মনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকার আগ মুহুর্তে আশাকে দেখতে পেলো। সে কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো
-উনি কেডা মনি, চিনলাম না তো।
মনি হেসে বললো
-আশাপু।
-ও, নীল বাবাজির বোইন।
-হুম।
-আর কোলের মাইয়াডা??
–আপনার নাতনি। সামনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাসিমুখে উত্তর দিলো আশা।

এই প্রথম বারের মতো নিজের নাতনিকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো মনির মা। তিনি চটজলদি আশার দিকে এগিয়ে গিয়ে মুনিয়াকে নিজের কোলে টেনে নিলেন। রহিম মিয়াও বেশ খুশি হলো। দুইজন মিলে মুনিয়াকে আদর করায় ব্যস্ত হয়ে গেলো ততোক্ষনে। মনি শান্তির হাসি হাসলো। ভেতর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেছে মনে হচ্ছে।

আজকের দিনটা ওরা এখানে থাকবে। রাতটা পার করে পরেরদিন সকাল সকাল রওনা করবে। আশাও দ্বিমত করেনি তাতে। সেও একটু বেড়াতে চায়। সন্ধ্যা সন্ধ্যা বাজার থেকে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরে রহিম। এতোদিন পর মেয়ে এসেছে, মেয়ের ননদ এসেছে, ভালোমন্দ একটু খাওয়াতে হবে কিনা। যদিও তৃপ্তিসহকারে আপ্যায়ন করানোর মতো সাধ্য তার নেই। তবে ন্যুনতম চেষ্টা কে না করতে চায়।

রহিমকে ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মনি। বাবার হাত থেকে বাজারের থলেটা নিতে নিতে বললো
-কি আনছো আব্বা?
-পাঙ্গাশ মাছ আনছি মা। তুই তো পাঙ্গাশের মাথা খাইতে খুব পছন্দ করতি।
রহিমের কথায় খুশির হাসি হাসলো মনি। রহিম আবারও বললো
-আরেকটা ফারামের মুরগি আনছি। গরুর গোস্তের অনেক দাম, লাল মুরগিডারও দাম বেশি। কিনার সাধ থাকলেও সাধ্যি নাই রে মা। তোর ননদী এই মুরগি খাইতে পারবো তো? মনি খেয়াল করলো বাবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তাই সে হাসিমুখে বাবাকে শান্তনা দিয়ে বললো
-এতো চিন্তা করোনা তো বাবা। আশাপু অনেক ভালো। সে এতো বাছবিচার করেনা। কিন্তু তুমি এতকিছু কেন আনতে গেলে বলোতো।
-কি কস মা, তুই আমার একটা মাত্র মাইয়া, এতোদিন পর আইলি, বড্ড সাধ জাগছে তোরে দুইডা ভালা মন্দ খাওয়াইতে।

মনির হটাৎ মনে হলো, সে আরেকটা বার বাবাকে জরিয়ে ধরুক। খুব শক্ত করে ধরুক। মনি তাই করলো। হটাৎ এভাবে জরিয়ে ধরায় অবাক হলো রহিম। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
-কি হইছে মনি?
-কিছু হয়নি আব্বা।
-পাগলী মাইয়া। আয় ঘরে আয়।
রহিমকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মনি। ওর মা মুনিয়াকে কোলে নিয়ে নানান ধরনের কথা বলছিলেন। আদরের নাতনির সাথে দুষ্টুমি করছিলেন। বাজারের ব্যাগ দেখে তিনি উঠে দাড়ালেন। রান্না করতে হবে যে। এমনিতেই সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মা কে উঠতে দেখে মনি বললো
-তুমি উটছো কেন মা?
-রান্দন লাগবো। তোরা বো, আমি রাইন্দা আহি।
মনি মাকে বাধা দিয়ে বলল
-আজ আমি রান্না করবো মা। নিজ হাতে রান্না করে আমার বাবা মাকে খাওয়াবো। তুমি আজ মুনিয়ার সাথেই বসে থাকো।
মনির মা হেসে বললো
-আমার মাইয়াডা দেহি অনেক বড় হইয়া গেছে।

মনি মুনিয়ার দিকে তাকালো। অন্যমনস্ক হয়ে বললো
-কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন ভাবে জীবনে এসে হানা দেয়, তখন না চাইতেও মানুষ বড় হয়ে যায়। মনির মা মনির কথার মানে বুঝতে পারলোনা। তাই সে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো
-কি কইলি মা, কিছুই তো বুঝলাম না।
মনি মুখে শুকনো হাসি টেনে বললো
-তোমার বুঝে কাজ নেই, তুমি বসো তো এখানে। আমি রান্না করে নিয়ে আসছি।
মনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগ মুহুর্তে আশা বলে উঠলো
-তুই একা কেন রাধবি মনি, আমিও রান্না করবো তোর সাথে।
-তুমি কেন রান্না করবে আশাপু৷ তুমি আমাদের বাড়ির মেহমান, তুমি এখানেই থাকো।
-মেহমানের কথা উঠলে বলতে হয়, তুইও এখন এ বাড়ির মেহমান মনি।
আশার কথায় মনি হাসলো। বললো
-তোমার সাথে কথায় পেরে উঠা দায় আশাপু। এসো আমার সাথে।

রান্নাঘরে গিয়ে একটা বেতের চালনিতে সবকিছু ঢাললো মনি। একটা কাঠের জলচৌকি টেনে সেটাতে সবেমাত্র বেসেছে আশা। এমন সময় হুট করে মনির ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠলো। ফোনটা চালনির পাশেই রাখা ছিলো। ভিডিও কলে নীলের নামটা স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে। আশা দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো
-আজ সারাদিন বোধহয় আমার ভাইটার সাথে কথা বলিস নি, যা কথা বলে আয়। বেচারাকে আর কতো কষ্ট দিবি।
-কষ্ট দিলাম কখন। ভ্রু বাকিয়ে বললো মনি।
-কথা না বলাটাই তো সবচেয়ে বড় কষ্ট।
-তুমি কি করে জানলে, কথা বলিনি?
-আজ সারাদিন তো তুই আমার সাথেই আছিস, কথা বললে দেখতাম তো।

মনি হাসলো। আশা ওকে তাড়া দিয়ে বললো
-তারাতাড়ি রিসিভ কর কলটা। ভাইয়া টেনশনে পরে গেছে বোধহয়।।
মনি ভিডিও কলটা কেটে দিয়ে অডিও কল দিলো। এরপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের এক প্রান্তে চলে গেলো।
নীল কল রিসিভ করে বললো
-ভিডিও টা কেটে দিলে যে?
-বাড়িতে এসেছি আজ। বাইরে লাইট নেই, অন্ধকার। ভিডিও কল রিসিভ করলেও দেখতে পাবেন না।
-কখন গেলে?
-আজই এসেছি।
-একা?
-না, আশাপুকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।
-বলোনি তো।
-কল করেন নি আপনি।
-আজ একটু বিজি ছিলাম, তুমিও তো করতে পারতে।
-বাড়িতে আসার উত্তেজনায় ছিলাম আজ।
মনির কথায় হাসলো নীল। বললো
-আমার শশুড় শাশুড়ী কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-আর আমার মেয়ে?
-সেও আলহামদুলিল্লাহ।
-বউটা কেমন আছে?
মনি লজ্জায় বললো
-জানিনা।
-আমি জানি।
-কি?
-আমার বউটা আমাকে ছেড়ে একটুও ভালো নেই।
-মোটেও না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি।
-সেতো আমি জানি।
-কচু জানেন।
প্রায় মিনিট পনেরোর মতো কথা বললো ওরা। এক পর্যায়ে মনির তাগিদে ফোন কাটতে বাধ্য হলো নীল। ফোন কেটে দেবার পর হাসিমুখে রান্নাঘরে ফিরে এলো মনি। মনিকে দেখে আশা বললো
-প্রেমালাপ শেষ হলো?
-কি যে বলোনা তুমি।
মনি দেখলো মুরগিটা অলমোস্ট কাটা হয়ে গেছে। আশা কেটে রেখেছে। সে অবাক হয়ে বললো
-ওমা, মুরগিটা কেটে ফেলেছো?
-কি মনে হয়?
-তুমি কেন হাতটা নষ্ট করতে গেলে, আমিই কাটতাম।
-তুই বরং মাছটা কেটে ফেল। ওসব মাছ আমি কাটতে পারিনা, পিছলে যায়।
মনি হেসে বললো
-আচ্ছা।

_______
পরের দিন সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে রওনা করার কথা থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠলো না। বাবা মায়ের অশেষ জোরাজুরিতে সারাটা বেলা কাটিয়ে বিকেলে রওনা করলো ওরা। ঘর থেকে বেরোবার আগে রহিমের হাতে একটা বাটন ফোন দিয়ে আসে মনি। এখন থেকে এটা দিয়েই ওরা কথা বলবে। রহিম আর মনির মা বেশ খুশি হলো ফোন পেয়ে। অন্তত মেয়েটার সাথে ইচ্ছে হলে কথা তো বলতে পারবে।

মনিদের বাড়ির কাছাকাছি যেহেতু কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না, তাই ওরা হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। কিছুটা দূরে গিয়েই বাস সিএনজি সব পাওয়া যাবে। যদিও বাসে ওরা যাবেনা।
দুইজন মিলে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো। এক পর্যায়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিয়ানদের বাড়ির সামনাসামনি চলে আসলো। ওদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে গিয়েই সিএনজি স্টেশন। মনি নিয়ানের চিন্তা মাথাতেও আনলোনা। আশা কথা বলছে আর হেঁটে চলেছে। এমন সময় মনি খেয়াল করলো একটা সিএনজি এসে দাড়ালো নিয়ানদের বাড়ির সামনে। সেখান থেকে বোরকা পরিহিত একটা মেয়ে নামলো, সাথে সাথে নিয়ানও নেমে এলো। মনি বুঝে নিল, এটা ইতিই হবে। আশা নিয়ানকে দেখতে পেয়ে মনির দিকে তাকালো এক নজরে। তবে মনির নজর তখনও নিয়ানের দিকে। নিয়ানের হাতে একটা ক্লিনিকের ফাইল। মুখটা কেমন যেনো শুকনো, মলিন হয়ে আছে একদম। সচরাচর ওকে কখনো মলিন মুখে থাকতে দেখেনি মনি। মনমরা হয়েও থাকেনা সে কখনো। তবে, আজ এতো মলিনতা কেন? কেন এতো বিষাদতা? উত্তর খুঁজে পায়না মনি। বরং উত্তর খুঁজার চেষ্টাও সে করেনা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here