#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-০৫
বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া গায়ে মাখিয়ে স্যারের বাড়ির দিকে যাচ্ছে মনি। যদিও শীত শীত লাগছে সামান্য, তবে ভালোই লাগছে। বাকিরা খানিক আগেই চলে গেছে পড়তে। মনি যখন বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে তখনই ওর নজরে পরলো নিয়ানকে। সে মোবাইলে কিছু একটা করছে। মনি সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে লাগলো। ঠিক তখনই নিয়ান ওকে লক্ষ্য করে বললো
-হেই রানিং গার্ল।
মনি সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। আস্তে করে বললো
-আমারে কিছু কইতাছেন?
-হুম এদিকে আসো।
মনি একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ানের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। কাছাকাছি গিয়ে বললো
-কি?
-সকালের সেই রানিং গার্লটা তুমিই ছিলে না?
-আপনার ভুইলা যাওনের অসুখ আছে?
মনির কথায় হাসলো নিয়ান। মনি ভ্রু বাকিয়ে বললো
-হাসেন কেন?
-হাসতে কি বারণ আছে?
-না। আমি গেলাম পড়তে। মনি যেতে উদ্ধত হলে নিয়ান বললো
-আরে যাচ্ছো কোথায়, দাড়াও।
-কেন?
-আসো গল্প করি তোমার সাথে।
-আমার সাথে? অবাক হয়ে বললো মনি।
-হ্যাঁ। আসলে বাড়ি আসার পর থেকে ভালো কোনো বন্ধু পাচ্ছিনা গল্প করার মতো। এমনিতেও ছোট থেকে শহরেই লেখাপড়া করেছি, যার কারণে এখানে আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই বললেই চলে। তবে মাঝেমধ্যে বাড়ি এলে আগে দুই একজনের সঙ্গ পেতাম। এখন তারাও বাড়ি নেই।
-ও, তবে আমি আপনের সাথে কি গল্প করমু?
-উম্মম্মম, নিয়ান কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। এরপর বললো
-তোমার সাথে সকালে যেটা হয়েছিলো সেটার ফ্ল্যাশব্যাক কি ছিলো সেটাই বলো আপাতত।
-আমার প্রাইভেটে দেরি হইয়া যাইতেছে। স্যার মনে হয় পড়ানো শুরু কইরা দিছে। দেরিতে গেলে মারবো আমারে।
-সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। বাবাকে আমি বুঝাবো।
-কিন্তু আজকার পড়াডা যে আর পামু না।।
-শুনো রানিং গার্ল, ওইসব পড়া আমার মুখস্থ। পরে আমি তোমাকে সেগুলো বুঝিয়ে দিবো। গল্প শুরু করো এখন।
-আপনি আমারে এইসব কি নামে ডাকেন?
-রানিং গার্ল। নামটা সুন্দর না? তোমার সাথে যায় ভালো। কথায় কথায় শুধু দৌড়াও। এবার শুরু করো বলা।
মনি এবার একটু ইতস্তত করতে লাগলো। সকালে ঘটনাটা বলতে গেলে তার বাবার বিশ্রী ব্যাপারটা উঠে আসবে। তাতে কি ভালো দেখাবে? বরং ওর সামনে নিজেকে বেশ ছোট মনে হবে। আর তাছাড়া, এই ছেলের সাথে ওর এতটাও পরিচয় হয়নি যে তাকে জীবনবৃত্তান্ত বলতে হবে। মনিকে একরকম চিন্তিত দেখে নিয়ান বললো
-কি ভাবছো?
-আমি আপনারে কেন ওইসব বলমু?
-আমার জানতে ইচ্ছা করছে তাই।।
-পারুম না বলতে। আমি পড়তে গেলাম।
-যদি না বলো তাহলে কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিবো।
-কি কইবেন?
-তুমি বাবার কাছে পড়তে না গিয়ে আমার সাথে গল্প করতে এসেছো।
-মিথ্যা কথা কেন কইতাছেন? আপনিই তো আমারে ডাকলেন।
-সেটা তো আমি জানি। বাকিরা তো জানেনা। আর এখানে সবাই আমার কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিবে।
মনি বিপাকে পরলো। এ কেমন মানুষের পাল্লায় পরলো সে। নিয়ান এখনো মনির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনি কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলা শুরু করলো পুরো ঘটনাটা।
সারাদিন অনেক খোজাখুজির পরেও রহিম মিয়াকে না পেয়ে বেশ রেগে গেলো জয়নাল। টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে নাকি লোকটা। বাড়িতে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি, রহিম মিয়াকে তো পেলোই না, বরং মনির মায়ের মুখ থেকে কিছু শক্ত কথা শুনে এলো সে। মেজাজটা তখনই বিগড়ে গেছে তার। কিসের এতো দেমাগ এদের। মনিরে সে এক রাতের জন্য হলেও বিয়ে করে ছাড়বে।
অবশেষে, গঞ্জের একটা দোকানে তাস খেলার ভীরে পাওয়া গেলো রহিম মিয়াকে। জয়নাল এক রাশ ক্ষোভ নিয়ে ঢুকলো সেই দোকানে। রহিম মিয়া তখনও তাস খেলায় মগ্ন। জয়নাল এসেছে এটা সে খেয়াল করেনি। জয়নাল রহিম মিয়ার পাশে গিয়ে বসে এক হাত উনার ঘারে রাখলো। রহিম মিয়া সে হাতের মানুষটির দিকে ফিরে সবকটি দাঁত বের করে হেসে দিলো। এতে জয়নালের রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে চাপা আক্রোশে বললো
-আমার লগে চিটারীডা না করলেই পারতা চাচা।
-আমি আবার কি করলাম?
-তোমার মাইয়ার অন্য পুলার লগে ইটিশ পিটিশ আছে এইডা কও নাই কেন আমার?
রহিম মিয়া সকলের সামনে এমন একটা কথা শুনবে আশা করেন নি। সে লজ্জিত কন্ঠে বললো
-কি কইতাছো বাপ? মাথা কি আইজ পুরাডাই গেছে গা? আইজ মনয় একটু বেশিই পেডে পরছে।
আকস্মিক জয়নাল রেগে বেজায় বিষাদ গলায় বললো
-আমার লগে বাটপারি করো? চাচা হয়ছো বইলা কি মাথা কিইনা নিছো? আমার টেকা আমারে ফিরাইয়া দেও। এইদিকে তোমার বেডি আমারে ত্যাড়াব্যাকা কথা শুনাইবো, অন্য দিকে তোমার মাইয়া আমারে থুইয়া আমার চোক্ষের সামনে বুড়া আঙুল দেখাইয়া অন্য পুলার লগে আকাম করবো, আমি মাইনা নিমু না।
-আমার মাইয়া এমন কিছু করতেই পারেনা। শক্ত গলায় বললো রহিম মিয়া।
-ওহ আইচ্ছা, তোমার মাইয়া ধুয়া তুলসীপাতা তাইনা? তো সেই মাইয়ারে আমার কাছে টেকা দিয়া বেচলা কেন শুনি? ঘাবলা তো আছে নিশ্চয়।
রহিম গলার স্বর নরম করলো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো
-বাপ, এইহানে অনেক মানুষ। সবার সামনে আমার মাইয়ারে নিয়া এইরকম কথা কইয়ো না। আমার মানসম্মান থাকতোনা। টেকার ব্যাপারটা তো তোমার আর আমার মইধ্যে।
-কোনো থামাথামি নাই। হইতে আমার টেকা আমারে আইজ ফিরাইয়া দিবা নাইলে আইজকার মইধ্যেই ওই মাইয়ারে আমার লগে বিয়া দিবা।
-আইজকা? চিন্তিত হলো রহিম।
-হু আইজকা।
-আইজকা কেমনে কি হইবো? সন্ধ্যা তো হইয়া গেছে। এখন কি সম্ভব?
-তাইলে কাইল।
রহিম মিয়া কি যেনো ভাবলো। এরপর বললো
-আইচ্ছা। কাইল জামাই সাইজ্জা আইয়া পইরো তারাতাড়ি। আমি এইদিকে সব গুছাইয়া রাখবাম।
-জামাই সাজন লাগেনা আমার। আপনে আপনার কাম সাইরে রাইখেন।
_____
সমস্ত ঘটনা শুনে কপালে ভাজ পরলো নিয়ানের। মনির বাবার প্রতি একরাশ ঘৃণা জন্মালো হটাৎ। একজন বাবা কিভাবে মেয়ের এতোবড় সর্বনাশ করতে পারে!
মনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলে কিছুক্ষণ মাথা নত করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো নিয়ানের সামনে। নিয়ানের দৃষ্টি তখন মনির দিকে। এক সময় মনি বললো
-সন্ধ্যা হইয়া গেছে। আমি এখন বাড়ি যাই। আপনে স্যারেরে বইলেন যেনো আমারে না মারে।
নিয়ান হাসলো মনির কথায়। মেয়েটা বয়সে খুব ছোট তাই মারকে অনেক ভয় পাচ্ছে।
মনি যাওয়ার জন্য এক পা আগাতেই পিছন থেকে নিয়ান বললো
-এই রানিং গার্ল।
মনি চমকে পিছনে তাকালো। এরপর দৃষ্টি স্বাভাবিক করে নরম গলায় বললো
-আবার কি?
নিয়ান তার ডান হাতটা মনির দিকে বাড়িয়ে দিলো। মিষ্টি করে বললো
-Will you be my friend? The rainbow is like friendship with the sky. Birds make friends with trees. The river makes the sea a friend. And I want to make you a friend. Do you agree?
মনি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। পুরো কথার মর্মার্থ সে না বুঝলেও এতটুকু বুঝতে তার বাকি নেই যে নিয়ান তাকে বন্ধু বানাতে চায়। মনি কিছুক্ষন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান সেটা লক্ষ্য করে বললো
-পুরো কথাটা কি মাথার উপর দিয়ে গেছে?
-হুম।
-কেন?
-আমি আপনার বন্ধু হমু?
-হলে সমস্যা কি?
– সময়মত বিয়া হইলে আমার মতো একটা মাইয়া থাকতো আপনের। আমি কেমনে আপনের বন্ধু হমু?
মনির কথা শুনে বিস্ময়ে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো দশা নিয়ানের। এ কি বলে পাগলী মেয়ে। মাথার তারগুলো কি সব ছিড়ে গেছে?
-স্টুপিডের মতো কথা বলছো কেন? আমাকে কি তোমার এতোই বুড়ো মনে হয়?
-না, কিন্তু আপনে আমার অনেক বড়। আমরা কেমনে বন্ধু হমু?
-সেটা আমি জানি। কিন্তু তুমি কি জানো না, বন্ধুতে বয়সটা কোনো ম্যাটার না। মনের সাথে মনের মিল হলেই বন্ধুত্ব করা যায়।
-আমার মনের সাথে কি আপনার মনের মিল আছে? শান্ত গলায় অদ্ভুতভাবে প্রশ্ন করলো মনি। নিয়ান একটা মনখোলা হাসি দিয়ে বললো
-আমার তো সেটাই মনে হচ্ছে।
মনি হতভম্বের মতো কিছক্ষন তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সেদিকে চেয়ে আছে। হটাৎ মনি জোরেসোরে এক দৌড় দিলো। দৌড়ের চোট এতোটাই যেনো ২০ মিনিটের পথ ৫ মিনিটেই চলে যাবে। নিয়ান সেদিকে অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিনমিনে গলায় বললো
-অদ্ভুত! সে সত্যিই এক দৌড় বালিকা।
বাড়ি যাওয়ার পরপরই রহিম মিয়া অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করতে লাগলো মনির সাথে। যে বাবা মনির সাথে ভালো মুখে কোনো কথায় বলে না, সে আজ মনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। বার বার মনিকে জিজ্ঞেস করছে ওর কি কি লাগবে। এমনকি সকালে জয়নালের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়েও তিনি কিছু বলেন নি। অন্যসময় হলে মনিকে সে যাচ্ছেতাই কথা শোনাতে। মারতেও হাত কাপতো কিনা সন্দেহ।
মনি চিন্তিত মনে মায়ের কাছে গেলো। ঘরের অন্যপাশের বিছানাটার উপর মুখ ভার করে বসে আছেন উনি। চেহারায় স্পষ্ট রাগের ছাপ। মনি ধীরে ধীরে মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে শান্তগলায় জিজ্ঞেস করলো
-ও মা, আব্বার কি হইছে আইজ?
-তোর বাপের শইলে রং লাগছে। মাইয়ার বিয়ার বাও করছে কাইল।
-কোন মাইয়ার? বিস্ফোরিত গলায় বললো মনি।
মনির মা হটাৎ ফুসে উঠলেন। ক্ষীপ্ত গলায় প্রচন্ড ধমক দিয়ে বললেন।
-তোর বাপের কয়ডা মাইয়া? তোর বিয়া।
মায়ের কথায় চমকে উঠলো মনি। সে বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো বারবার।
চলবে….