মন মুনিয়া পর্ব-৬

0
2017

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-০৬

সন্ধ্যের আগেই বাজারে চলে গিয়েছিলো রহিম মিয়া। সন্ধ্যা মিলানোর সাথে সাথেই সে আবার চলেও আসে। হাতে একটা বড় বাজারের ব্যাগ। সেই ব্যাগখানা নিয়ে সোজা চলে আসে মনির মায়ের কাছে। তিনি এখনো অগ্নিমূর্তি হয়ে বসে আছেন। উনার এই রুপকে গ্রাহ্য না করে হুংকারে বললেন
-মুখের রঙ ঠিক কইরা বাজারের ব্যাগডা নে।
-আমি পারুম নাহ।
-কেন পারবি না? কর্কশ গলায় বললে রহিম।।

-কেন পারুম না বুঝেন না? বুঝেন না আপনে? নিজের হাতে মাইয়ারে কবরে যাওনের যোগাড় কইরা দিতাছেন আর আমারে এই কথা জিগান। সরম করেনা?
-না আমার সরম নাই। অতো সরম লইয়া থাকলে এই দুনিয়ায় চলন যাইতোনা।
-আপনেও শুইনা রাখেন, এই বিয়া আমি কিছুতেই হইতে দিমুনা।
-দরকার পরলে তোরে ঘরে বাইন্ধা রাইখা পরে মাইয়ারে বিয়া দিমু। আমারে চেতাইস না বুঝলি।

রহিম মিয়া বাজারের ব্যাগটা একপাশে রেখে আবারও বেরিয়ে পরলেন ঘর থেকে। বেরোবার সাথে সাথে দেখলেন মনি ঠিক দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। উনি এক নজরে মনিকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলেন। আগের ন্যায় খসকষে গলায় বললেন
-আমি যে কেমন তা তোরে নতুন কইরা বুঝাইয়া দিতে হইবোনা। তাই মায়ের মতোন জেদ করবিনা। আমি আগে থেইকাই কইয়া থুই, কাইল যাতে কোনো অঘটন না ঘটে।

মনি কোনো উত্তর করলোনা বাবার কথায়। সে শুধু নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাবার প্রস্থানের পথে।
বাবা চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথেই ঘরে মায়ের কাছে গেলো মনি। উনি মুখ ভার করে বসে আছেন। দুচোখ বেয়ে পানি পরছে অনবরত। মায়ের এই রুপ তার সহ্য হচ্ছেনা। সে মায়ের পাশে বসে আলতো হাতে জরিয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
-ও মা, বাবা কেন এমন করতাছে?
-ওই জয়নাল তোর বাপরে তাবিজ করছে। তাই তোর বাপ এমন করতাছে।।
-তাবিজ করে নাই মা, টেকা দিছে।

মেয়ের এরুপ কথায় তার কোনো হেলদোল হলোনা। তিনি আগে থেকেই জানতেন টাকার ব্যাপারটা। রহিম মিয়া নিজেই টাকার কথাটা বলেছিলেন উনাকে।

মনি আরো কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এক সময় বললো
-আইজ জয়নাল ভাই আমার লগে রাস্তায় অনেক খারাপ ব্যবহার করছে মা।

মনির মা আতংকে তাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়ের মুখের এই কথাটা তিনি হজম করতে পারছেন না। তিনি মেয়েকে দুইহাতে শক্ত করে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন
-ওই জানোয়ারটা তোরে কি করছে?
-সকালে ইস্কুলে যাওনের পথে আমার সামনে গিয়া দাড়াইছিলো। আমারে অনেক জোর করছিলো ওর সাথে কই জানি যাওনের লাইগা। আমি যাইতে চাইনাই। তাই শেষে আমারে হাত ধইরা টানতে টানতে নিয়া যাইতে লাগলো।
-তারপর? তারপর কি করছে?

আতংকে চোখ বেরিয়ে আসছে মনির মায়ের। রাগে গলা থরথর করে কাঁপছে। মনি নিচের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমি যখন বললাম উনার এইসব ব্যবহারের কথা আমি বাবারে বলে দিমু, সে বললো বাবা নাকি আমারে পাঁচ হাজার টেকা দিয়া বেইচা দিছে। সে আমারে যেখানেই নিয়া যাক, বাবার নাকি তাতে কিছু আসে যায়না।
-তোর বাপরে তো আমি দেইখা নিমু। তার আগে কো, ওই হারামি তোর কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই তো?
-না। স্যারের একটা ছেলে আছে, সেই আমারে আইজ বাঁচাইছে মা।

মনির মা দুচোখ বুঝে উপরের দিকে তাকালো। মনির সাথে খারাপ কিছু না ঘটায় মনে মনে আল্লাহর দরবারে অসংখ্য বার শুকরিয়া আদায় করলেন উনি।

কয়েক মুহূর্ত বাদে মনির মা উঠে দাঁড়িয়ে মনিকে বললেন
-দেখিস মা, কাইল কান্নাকাটি, মন খারাপ কোনোকিছুই করবিনা। তোর বাপে যেমনে যেমনে কইবো, ঠিক সেইভাবেই থাকবি।
মনি অবাক হলো মায়ের কথায়। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও তিনি এ বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন, হটাৎ এমন কি হলো যে উনিও রাজি হয়ে গেলেন?

মনি বিস্ময়ে বললো
-কি কইতাছো মা? তুমিই তো কইছিলা জয়নাল ভাই খারাপ। এখন তুমিই কইতাছো এই কথা।
-হু কইতাছি। তুই বা আমি যদি কিছু করতে যাই, তাইলে তোর বাপে আমাগো উপরে রাগ হইবো। তোরে আর ইস্কুলে যাইতেও দিবোনা। আমি চাই তুই লেখাপড়া কইরা অনেক বড় হো। যা করনের ওই জয়নালই করবো। সাপও মরবো, আর লাঠিও ভাংবোনা।
মায়ের বলা কথাগুলো মাথায় উপর দিয়ে গেলো মনির। জয়নাল মনিকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়ানো। সে জয়নাল কিভাবে কি করবে?

মনির উৎসুক মন আর বাধ মানলো না। সে মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো
-কেমনে মা, জয়নাল ভাই কেমনে কি করবো? সেইতো বিয়ার লাইগা এতো তাড়া দিতাছে।
মনির মা বাঁকাভাবে হাসলো। এরপর অদ্ভুত ভাবে মনির দিকে তাকিয়ে বললো
-এতোকিছু তোরে ভাবতে হইবোনা। তুই শুধু তোর কাম কর।

_____
পরেরদিন সকাল থেকেই মনিদের বাড়িতে বিয়ের রেশ দেখা গেলো। মনির মাও ব্যস্তভাবে চারপাশটা সামলাচ্ছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। মেয়ের জামাইকে তো আর যেভাবে খুশি সেভাবে আপ্যায়ন করানো যাবেনা। রহিম মিয়াও এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে খুব। গ্রামের আরো কয়েকজন মানুষকেও দেখা যাচ্ছে খুব খাটতে।

বাবার ব্যস্ততায় মনির ভাবাবেগ হয়না। তবে মাকে দেখে সে খুব অবাকই হচ্ছে। এতোটা খুশিমনে তিনি কিভাবে কি করছেন?

একটা টুকটুকে লাল রঙের মোটা শাড়ি পরিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে মনিকে। ওর চারপাশ ঘিরে রয়েছে গ্রামের কয়েকটা মেয়ে। মনির পাশের বেড়াতেই একটা ছোটখাটো জানলা আছে। সেটা দিয়েই সে বাইরের সবকিছু দেখছে। মনির চোখদুটো ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে যাচ্ছে বারবার। গতকালই যে ছেলেটা ওর সাথে বাজে কিছু করতে যাচ্ছিলো, আজ তার সাথেই ওর বিয়ে। মনির খুব করে ইচ্ছে করছে সে পালিয়ে যাক। তবে এতোটা সাহস কি তার আছে?

এরই মধ্যে রান্নাবান্নার কাজ শুরু কয়ে দিয়েছে বাড়ির কয়েকজন মহিলা। ছেলেগুলো বসার জায়গায় বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। মুরুব্বিরা উঠোনের মাঝখানে বসে একটা জটলামত পাকিয়েছে। মেহমান এলে কিভাবে কি করবে, জামাইকে কি কি দিতে হবে এইসব। যদিও এইসব লোক দেখানো ছিলো। রহিম তো জানে, তার মেয়ের বিয়েটা কিভাবে হচ্ছে।

বিকেলের পরপরই জয়নাল চলে আসে মনিদের বাড়ি। সে একা এসেছে, দেখে মনে হচ্ছে সে বিয়ে করতে নয়, বিয়ে খেতে এসেছে। রহিম ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলো৷ আগের দিনই সে বলে রেখেছিলো, সে জামাই সেজে আসবেনা। তবে বাকিদের কাছে এটা দৃষ্টিকটু লাগলো। গ্রামের একজন মুরুব্বি জয়নালের কাছে গিয়ে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলো কয়েকবার। এতে জয়নালের কোনো হেলদোল হলোনা।

রহিম মিয়া চটজলদি সেখানে গিয়ে মুরুব্বি লোকটাকে বললো
-এমনে কি দেখেন চাচা?
-এই পুলা বিয়া করতে আইছে তো? চিন্তার স্বরে বললেন উনি।
রহিমা মিয়া হেসে বললো
-কি যে কন চাচা। বিয়া করতে না আইলে কেন আইছে।
-আমার তো মনে হয়তাছেনা।
-এই পুলা এমনই। আমারে বইলাই রাখছিলো সে জামাই সাইজা আসতে পারবোনা।
-এইডা কেমন কথা। বিয়ে করবো, জামাই সাজবোনা। আইচ্ছা মানলাম, তবে ওর লগে বরযাত্রী কই?

এবার রহিম বিপাকে পরলো। জামাই সাজার কথাটা নাহয় যেভাবেই হোক ধামাচাপা দেওয়া গেছে। কিন্তু বরযাত্রীর ব্যাপারটায় সেও কিছুটা চিন্তিত। রহিম জয়নালের সামনে গিয়ে বললো
-আর কেউ আইলোনা? তোমার বাপ কই?
-কেউ আইবোনা আর এই বিয়াও হইবোনা।
রহিম চমকে উঠল সেই সাথে মুরুব্বি লোকটাও। তিনি বেজায় রেগে গেলেন হটাৎ।
-এই রহিম, এই পুলা এইসব কি কইতাছে?
রহিম উনার কথায় থতমত খেয়ে জয়নালের দিকে তাকালেন। নরম গলায় বললেন
-বাপ, তোমার কি হইছে হটাৎ ? কাইল তো সব ঠিকই ছিলো।
-কাইল ঠিক থাকলে কি হইবো, আইজ ঠিক নাই। আমারে কি মনে হয় চাচা? আমি বোকা?

-এই কথা কেন কইতাছো?
-আমি এমনে এমনে বিয়া করমু না। আমারে যৌতুক দেওন লাগবো।
রহিমের চোখেমুখে হতাশার ছাপ দেখা গেলো। তিনি শ্রান্ত গলায় বললেন
-আমার ব্যাপারে তো সব জানই বাপ। সবকিছু জাইনাই তো তুমি বিয়াতে রাজি হইছিলা। আইজ তোমার মাথায় এই যৌতুকের পোকা ঢুকলো কেন?
-এতো কিছু জাইনা আপনে কি করবেন। আমার যৌতুক লাগবো। আর যৌতুক হিসেবে আমি আপনের বাড়িঘর আর গরুডা চাই।

হটাৎ রেগে গেলেন রহিম। শক্ত গলায় বললেন
-মগের মুল্লুক। কইলেই হইলো বাড়িঘর আর গরু দেওন লাগবো? তোর কাছে আমি আমার মাইয়ারে বিয়াই দিমুনা। তুই কি করবি কর।
জয়নাল দ্বিগুণ বেগে রেগে গিয়ে বললো
-তাইলে আমার দেওয়া পাঁচ হাজার টেকা ফিরাইয়া দেও চাচা।
-তুই আমারে কহন টেকা দিলি। এক টেকাও দেস নাই। ভালোই ভালোই যা, নইলে কিন্তু ফল খারাপ হইবো।

জয়নাল চেচাতে চেচাতে ডাকলো মনির মায়েরে।
-চাচী, ও চাচী একটু এইদিকে আহেন তো।
মনির মা আচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো জয়নালের কাছে। সামান্য অবাক হয়ে বললো
-কি হইছে?
-চাচী, আপনে একটু বুঝাইয়া কন তো চাচারে।
-কি কমু?
-কি কইবেন মানে? আপনেই তো কইছিলেন যেনো চাচারে কই আমার নামে বাড়িঘর আর গরুডা লিইখা দেওনের লাইগা?
-আমার মাথা খারাপ? আমি কেন এই কথা কইতে যামু। তোমারে সব দিয়া দিলে আমরা চলমু কেমনে?
জয়নাল বিস্ময়ের সাথে চোখ বড় বড় করে তাকালো মনির মায়ের দিকে।

অন্যদিকে ততক্ষণে রেগে ফেটে যাচ্ছেন সেই মুরুব্বি লোকটা। এবার তিনি আর চুপ না থেকে রহিমের দিকে তাকিয়ে বেশ রাগী গলায় বললেন
-তুই জাইনা শুইনা একটা পাগলের সাথে মাইয়ার বিয়া ঠিক করছিলি রহিম?
রহিম কঠিন চোখে জয়নালের দিকে তাকালো। এরপর শক্ত গলায় মুরুব্বি লোকটাকে বললো
-গেরামের পোলাপাইন গুলারে কন, আমাগো বাড়িত পাগল ঢুকছে। পাগলডারে যানি মাইরা এখনই বাড়িত্তন বাইড় করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here