#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-০৭
গ্রামের কিছু ছেলেদের হাতে কয়েকটা কিল গুতো খেয়ে তখন বিয়ের স্থান থেকে পালিয়েছিলো জয়নাল। মনিও বিয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলো তখনকার মতো। তবে সে বেশ অবাক হয়েছিলো সেই মুহূর্তে। মনির উৎসাহু দৃষ্টি সন্দিহান ভাবে মায়ের দিকে তাকালে মা ওকে ইশারায় বুঝিয়েছিলেন “আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। সবই আল্লাহর হাতে।”
রাতের বেলা খাবার খাওয়ার নিমিত্তে ঘরে ঢুকে রহিম। বিয়ে ভাংগার পর থেকে তিনি একবারের জন্যও এদের মা মেয়ের সামনে আসেনি। মনির মাকে মনে মনে হলেও কিছুটা ভয় পাচ্ছেন তিনি।
খাবার বেড়ে দিয়ে পাশেই বসে রইলো মনির মা। রহিম কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে বললো
-মনি খাইছে কিছু?
-নাহ।
-কেন? সারাদিন না খাওয়া মাইয়াডা, অহনো কিছু খায় নাই কেন?
-মাইয়ার চিন্তা আপনে করেন?
-এই কথা কস কেন? মাইয়াডা একার তোর না, আমারও।
-এইডা যদি মনে করতেন তাইলে মাইয়ারে এতো বড় সর্বনাশের পথে ঠেইলা দিতেন না।
-পুরান কথা টানিছ না মনির মা। যেইডা হওনের তো হইছেই।
মনির মায়ের মনের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেলো হটাৎ। তিনি নিজেকে সামলাতে না পেরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন
-হুম গেছে, জয়নাল গেছে। কিন্তু কথাডা ঠিকই থাইকা রইছে। মাইয়ার বদনাম হইছে, অহন সবাই মনিরে পাঁচ কথা শুনাইবো। বিয়ার দিন বিয়া ভাংগন কিন্তু মাইয়াগো লাইগে সুখের না। হাজার নিষেধ কইরাও ওই জয়নালের ভুত আপনের মাথা থেইকা নামাইতে পারি নই। ওই জয়নলা আপদ তো বিদায় হইলোই, মাঝখান থেইকা আমার মাইয়ার উপ্রে দাগ পরলো।
রহিম মিয়া গলার স্বর নরম করে বললো
-যেইডা হইছে আমার ভুলে হইছে, মাইয়ারে কেন মাইনষে কথা শুনাইবো। আর সবাইতো জানছেই বিয়াডা ভাংছে কেন।
-শুনেন মনির বাপ, কাঁচা কথায় দুনিয়া চলেনা। সবাই জানলেও যে মনি কথা শুনবোনা, দশজনের মইধ্যে দুইজন যে মনিরে বাজে কথা কইবোনা, সেইডা আপনে বিশ্বাস করেন?
রহিম মিয়া কিছু মুহূর্ত নিস্তব্ধ রইলো। এরপর সন্দিহান চোখে মনির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-কিন্তু জয়নাল এই কথাডা কেন কইলো?
-কোন কথাডা?
-তুই নাকি ওরে শিখাইয়া দিছোস, আমার সবকিছু ওরে দিয়া দিতে?
মনির মা অস্বাভাবিক ভাবে তাকালো রহিম মিয়ার দিতে। মুহুর্তেই ফিরে গেলো সকালের ঘটনায়।
খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পরেন তিনি। কাউকে কিছু না বলে, খুবই সাবধানে বেরিয়ে পরেন ঘরের বাইরে। এই কনকনে ঠান্ডায় শীতল বাতাসে হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে যেতে লাগেন সামনের দিকে। উদ্দেশ্য জয়নালদের বাড়ি। তখনও ভালো করে ভোরের আলো ফুটেনি, এরই মধ্যে জয়নালের বাড়ি গিয়ে পৌঁছে যায় তিনি।
অন্যসব বাড়ি হলে তখন বিয়ের রেশে বাড়িটা গমগমে থাকতো, তবে জয়নালের বাড়িতে যে এইসব কিছুই হবেনা সেটা তিনি নিশ্চিত ছিলেন। একেতো জয়নাল এক গাঞ্জাখোর ভন্ড, এলাকার লোকজন তার বাড়িতে কখনোই আসেনা। তার উপর ওর বাপ সর্বোচ্চ লেভেলের কিপ্টে।
মনির মা খুবই সন্তর্পণে জয়নালের ঘরের বেড়ার পাশে গিয়ে দাড়ান। যে পাশটায় জয়নাল থাকে সে পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে থাকেন জয়নালকে। দুই একটা ডাক দেওয়ার পরেই ঘুম ভেংগে যায় জয়নালের। যদিও বিয়ে করবে সেই উত্তেজনায় প্রায় সারারাত জেগেই কাটিয়ে দিয়েছিলো সে।
এতো ভোরে মনির মাকে দেখে বেশ অবাক হলো সে। তবে জয়নালকে দেখেই দাঁতকপাটি বের করে হেসে দিলো মনির মা। এতে আকস্মিক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো জয়নাল। থতমত খেয়ে বললো
-চাচী আপনে, এই ভোরের বেলা আপনে এইহানে কি করেন?
-তোমার কাছেই আইছি বাজান।
-কেন? কোনো সমস্যা হইছে?
-না তেমন কিছুনা।
মনির মা এবার চারপাশটায় চোখ বুলাতে লাগলো। কেউ দেখে ফেলে কিনা সেই ভয়টা তার মনে জেঁকে আছে। জয়নাল আবারও তাড়া দিলো মনির মাকে। বললো
-কি হইলো চাচী?
-আসলে আইজ দিন গেলে তুমি আমার ঘরের পুলা হইবা। আমাগো কোনো ছেলেপুলে নাই। মাইয়াডাই সব। তোমার চাচা আর আমার দুই জনেরই খুব শখ ছিলো মাইয়া বিয়া দিয়া পুলা আনমু। আর সেই জন্যই তোমার চাচা তোমার কাছে বিয়া দিতে চাইছে মনিরে। যদিও প্রথমে আমার মত আছিন না। কিন্তু অনেক চিন্তা কইরা দেখলাম, যার তার কাছে বিয়া দিলে তো আমরা জামাই পামু ঠিকই, কিন্তু পোলার আশা সেই আশাই থাইকা যাইবো।
কিন্তু বাপ, তুমি এইডা কি বোকামি করতাছো?
-কি করছি চাচি?
-বিয়ার সময় ছেলেপক্ষ মাইয়ার বাপের কাছ থেইকা যৌতুক নেয়, আর তুমি কিনা তোমার চাচারে নিজেই টেকা দিতাছো? এতে কি হইবো একবার চিন্তা করছো?
-কি হইবো?
-তোমার চাচার মনে কিন্তু অহনোই লোভ জন্মাইয়া গেছে। সেতো মনে মনে ভাইবা রাখছে, মনিরে তোমার কাছে বিয়া দিয়া বাড়িঘর সব বেইচ্চা দিব। গরুডাও বেচঁবো। আর আমার মাইয়া আর তুমি পাইবা কাঁচকলা। শুধু তাই না, সে প্রতিনিয়ত তোমার কাছ থেইকা টেকা নিবো। যদি না দেও, তয় মনিরে তোমার ঘরে রাখবোনা।
-চাচা এইসব কইছে? খানিক রাগ ভেসে আসলো জয়নালের চোখে মুখে।
-সেইডাই তো কইলো। দেইখো তুমি আবার এইসব নিয়া উনার লগে রাগারাগি কইরোনা। আমি কিন্তু তোমারে একখান ভালা বুদ্ধি দেওনের লাইগাই আইছি।
জয়নাল ভ্রু বাকিয়ে বললো
-কি বুদ্ধি?
-তুমি আইজ আমাগো বাড়ি যাইবা, গিয়া কইবা তোমার নামে তার সবকিছু আগে লিইখা দিতে, নইলে তুমি বিয়া করবা না।
-বিয়া করমু না? অবাক হয়ে বললো জয়নাল।
-আরে বাজান, বিয়া তো করবাই। আগে অভিনয় করবা বুঝলা।
-যদি মা মানে?
-মানতে বাধ্য। যখন কইবা বাড়িঘর লেইখা না দিলে তুমি বিয়া করবা না, তহন গড়গড় কইরা রাজি হইবো সবকিছু লেইখা দিতে। আর কোনো ঝামেলা করলেও তো আমি আছিই।
জয়নাল কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। এইপর একটা ভ্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বললো
-ঠিক আছে চাচি, আপনে শুধু আমার দিকটা দেইখেন।
_____
এভাবে একধ্যনে নিজের দিকে মনির মাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিব্রত হলো রহিম। পরক্ষনে মেজাজ সামান্য খিটখিটে করে বললো
-এমনে চাইয়া রইছোস কেন? কি জিগাইছি তোরে?
ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো মনির মা।এরপর দৃষ্টি স্বাভাবিক করে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো
-আপনে এইডা মানেন যে আমি এইগুলা ওরে শিখাইয়া দিমু? নিজের ভালা তো পাগলেও বুঝে, তয় আমি কেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হইয়া নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারমু?
-তা ঠিক। তয় শুধু শুধু পুলাডা এইসব বলতে যাইবোই কেন?
-আপনেরে ছোট করনের লাইগা। খুব তো পুলা ভালা পুলা ভালা কইরা নাচঁছিলেন। এইবার ভালার কারিশ্মাডা দেখাইলো, আর কিছুই না।
পরের দিন নিয়ম মাফিক আবারও স্কুলে চলেছে মনি। যদিও সে আজ আসতে চায়নি, মায়ের বিশেষ জোরাজুরিতে আসতে বাধ্য হয়েছে একমত। রাস্তায় কিছু লোক আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখছে তাকে। কেউ কেউ ফিসফিস করে কি যেনো বলছে। ব্যাপারটায় বেশ অস্বস্তিতে পরছে সে।
ক্লাসেও ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেনি মনি। বারবার চোখের সামনে গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই ভেসে আসছে।
টিফিন পিরিয়ডে সবাই যার যার মতো খেতে গেলেও নিজের যায়গায় ঠাই বসে রইলো মনি। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। অন্যদিন একটা প্লাস্টিকের বক্সে করে ভাত নিয়ে আসলেও আজ আনেনি। সাথে টাকাও নেই যে কিছু কিনে খাবে। অবশ্য কিছু খেতে ইচ্ছেও করছেনা তার। সে বেঞ্চের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে রইলো।
হটাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে বসলো মনি। ইতি ওর পাশে বসেই মিটমিট করে হাসছে। ব্যাপারটায় বেশ বিরক্ত হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলোনা মনি। ইতি ব্যাঙ্গ করে বললো
-কি রে মনি, তোর নাকি কাল বিয়ে ভেংগে গেছে?
-জানোই যখন জিগাও কেন?
-শোন মনি, যেসব মেয়েদের বিয়ের দিন বিয়ে ভাঙ্গে তাদের কি বকে জানিস?
মনি প্রশ্নভরা চোখে তাকালো ইতির দিকে। ইতি সেটা খেয়াল করে অট্রহাসিতে মেতে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো
-অলক্ষী বলে বুঝলি। এইবার তোর কি হবে রে মনি? কে বিয়ে করবে তোকে?
মনি রেগেমেগে বললো
-আমার চিন্তা করনের লাইগা আর বাপ মা আছে। তুমি তোমারে নিয়াই থাকোনা। খামোকা আমারে নিয়া চিন্তা কইরা মাথার চুলগুলা ঝরাইয়ো না।
-একেই বলে, কথার বেলায় অষ্টরম্ভা। থাক তুই তোর মতো।
ইতি চলে গেলে মনি আবারও মাথাটা বেঞ্চে ছোয়ালো।
বিকেলে সবাই একে একে প্রাইভেটে গেলেও মনি গেলোনা। এমনিতেও মন মানসিকতা ঠিক নেই, তার উপর ইতির বলা তিক্ত কথা তাকে ভিতর থেকে আরো জখম করে দিচ্ছে।
হামিদ স্যার মনিকে দেখতে না পেয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন
-কি ব্যাপার, আজ আবার মনি মিসিং?
-জ্বি স্যার।
-কারণটা কি?
-ওর কালকে বিয়ে ভেংগে গেছে স্যার। সেইজন্যই মনে হয় আসেনাই। অন্য একটা মেয়ে বললো
-খুবই দুঃখজনক ঘটনা। বিয়ের ব্যাপারটা তো জানতাম না। তোদের কাউকে কি বলেনি?
-না স্যার। হটাৎ করেই নাকি ওর বাবা ঠিক করছিলো। সেও জানতোনা আগে থেকে।
-ওহ, কিন্তু স্কুলে তো দেখলাম।
রুমের অপর পাশ থেকে কথাটা কানে এলো নিয়ানের। মনির কাল বিয়ে ছিলো সেটা তার জানা ছিলোনা। বিয়ে ভেংগে গেছে সেটাও সে জানেনা। সেতো মনির বন্ধু, তার তো এটা জানা উচিত ছিলো। মনিরও উচিত ছিলো তাকে জানানো। ব্যাপারটা খুবই খারাপ। নিয়ান যাত্রা শুরু করলো মনিদের বাড়ির দিকে। এমনিতেও তার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। ভেবেছিলো মনি এলে তাকে নিয়ে আজ আবারও গল্প করবে।
মনিদের বাড়ির পাশে গিয়ে দেখল একজন মাঝ বয়সী মহলা উঠোনে বসে বেত দিয়ে কিছু একটা বুনছেন। উনি আদৌ মনির মা নাকি অন্যকেউ সেটা সে জানেনা। নিয়ান গরু বেধে রাখা গাছটার পাশে দাঁড়িয়েই বাড়িটায় উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। এই প্রথম নিজেকে কেমন যেনো চোর চোর লাগছে।
ঘরের জানলাটার দিকে আসতেই চোখ কপালে উঠলো মনির। স্যারের ছেলে এখানে কি করছে? কেউ দেখলেও তো নির্ঘাত বদনাম দেবে, এমনিতেই কাল বিয়ে হতে হতেও ভেঙ্গেছে। সে তরিঘরি করে বাইরে বেরোলো। মায়ের চোখের আড়াল হয়ে ঘরের পিছনের একপাশে গিয়ে হাতে ইশারা করে ডাকলো নিয়ানকে।
এক পর্যায়ে সেটা চোখে আসলো নিয়ানের। মুহুর্তেই হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। প্রাণবন্ত হাসি হেসে এগিয়ে যেতে লাগলো সে মনির দিকে।।
চলবে….