মন ময়ূরী’ পর্ব-১৩

0
720

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

১৩.

ফায়েজ মোবাইলে তার একটি কাজ নিয়ে কথা বলছে ওর এক ডিরেক্টরের সাথে। এদিকে জব্বার অনেক আগে থেকে হাঁসফাঁস করছে কিছু কথা বলার জন্য। ফায়েজ কথা শেষ করে মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে রেখে ছাঁদে রাখা দোলনায় হেলান দিয়ে বসে চোখ বুঁজে রইলো।

নিচে সবাই যখন নববধূে দেখতে ব্যস্ত তখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ফায়েজ চট করে তার ঘর থেকে ভারী শেরওয়ানি চেঞ্জ করে অন্য এক পাঞ্জাবি পড়ে ছাঁদে চলে আসে।

ছাঁদে আসার কিছু সময় পর ডিরেক্টর কল দিলে ফায়েজ কল রিসিভ করে কথা বলে,জব্বার কখন ছাঁদে এসেছে এটাই টের পায়নি ফায়েজ।

-স্যার,আপনার কি গরম লাগতেছে?

জব্বারের কন্ঠ পেয়ে ফায়েজ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ফায়েজ ওর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আছে।ছাঁদে লাইটিং থাকার কারণে ফায়েজ অনায়াসে জব্বারের মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছে যে ও কিছু বলতে চায়।

-এখন কি গরমের দিন যে, আমার গরম লাগবে?

-আসলে হয়েছে কি স্যার,বলতে লজ্জা লাগছে তবুও না বলে থাকতে পারছি না, পেট ব্যাথা করছে।

-যে কথা বলতে তোমার লজ্জা লাগছে, সে কথা তুমি আমাকে বলবে কেন?বাদ দেও বলার দরকার নেই।

-না, স্যার।আমি এবার ঠিক আছি। আসলে বলছিলাম কি স্যার, আপনার আজ বাসররাত, নতুন বৌ আপনার ঘরে,আপনার গরম লাগার কথা তাই না, স্যার?

কিছুটা লাজুক স্বরে কথাটি বললো জব্বার। জব্বার কথা শুনে ফায়েজের কান গরম হয়ে গেলো বোধহয়।

-কি সব বলো, জব্বার! এই তুমি কি বিয়ে করেছো? উল্টা পাল্টা কথা পাও কোত্থেকে?

-স্যার, বিয়ে করলে যে মানুষ সব কথা জানে এই কথা সঠিক না। আমার চাচাতো ভাইয়েরা বিয়ে করেছে এবং ওরাই আমাকে বলছে।স্যার, আরেকটা কথা বিয়ের প্রথমরাতে না-কি বিড়াল মারতে হয় নয়তো স্বামী তার বৌয়ের সামনে আজীবন বিড়ালের মতো মিঞাও মিঞাও করে।কিন্তু স্যার,আমি ভাবছি অন্যকথা, আপনার গরম লাগছে না কেন? বিয়ের রাতে না-কি অনেক গরম লাগে স্যার! ওরাই তো আমাকে বলেছে।

-উফফ, জব্বার তোমাকে কথা বলতে দেয়া আমার উচিত হয়নি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়া মানে নিজের ইজ্জতে হাত দেয়া।আজকের পর থেকে তুমি যদি
উল্টাপাল্টা কিছু বকেছো, তাহলে আমি তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো।এখন সোজা নিচে গিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করো,তোমার শোবার জায়গা কোথায় সেট করেছে?

জব্বার ভেজা বিড়াল হয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর মিনমিনে কন্ঠে বলছে,

-কি এমন বললাম, স্যার এভাবে রেগে গিয়েছে? জব্বার তুই জীবনেও ভালো হবি না,স্যার ভালো মানুষ তাই তোর মতো একটা বলদকে এখনো চাকরিতে রেখেছে নয়তো চাকরিতে না রাখলে না খেয়ে ইট ভাঙতি!

নিজেকে নিজে বকা দিতে দিতে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো জব্বার।

এদিকে জব্বার চলে যাবার পর ফায়েজ আনমনে বলে উঠলো,

-বিড়াল মারার আগেই আমি খেয়ার সামনে বিড়ালের মতো মিঞাও মিঞাও করছি। কি এমন হলো আমার? ওকে দেখার পর থেকে সবকিছু কেমন নিয়ম-কানুনের বাইরে চলে গিয়েছে!কে জানে খেয়া এখন কি করছে?

ফায়েজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।এরপর,ধীরপায়ে ছাঁদ থেকে নেমে ওর ঘরের দিকে রওনা হলো।

ঘরের সামনে এসে ফায়েজ দেখতে পেলো দরজা ভিড়িয়ে রেখেছে।বিনা শব্দে দরজা খুলতেই ফায়েজ দেখতে পেলো, পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ অন করে খাটের উপর আলো ফেলতেই ফায়েজ দেখলো, খেয়া বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

ফায়েজ ধীরপায়ে হেটে টেবিলের ওপর মোবাইল রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো।

খাটের সাথে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো ফায়েজ। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো খেয়ার মুখের উপর ঠিকরে পড়ছে।ফায়েজ মোবাইলের ফ্ল্যাশ অফ করে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে খেয়ার মুখের দিকে। সে জানতো খেয়া আজ তার অপেক্ষায় থাকবে না, হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে!

-সেদিন তোমাকে প্রথমবার দেখার পর আমার প্রতিক্রিয়া কি ছিল সেটা নয় হয় নাই বলি।কিন্তু, বাবার কল পেয়ে যেদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমাকে লাল শাড়ীতে দেখলাম, সেদিন মনে হয়েছিল, তুমি যদি একঘন্টার জন্য হলেও আমার বৌ হতে লাল টুকটুকে শাড়ি গায়ে দিয়ে!
তখনও ভাবিনি তুমি আমার স্ত্রী হবে কিন্তু আজ তুমি আমার স্ত্রী।
আমি চাইনি আমাদের বিয়ের আসরে কেউ তোমাকে লাল শাড়ীতে দেখুক। তাই মায়ের ইচ্ছের উপর বিয়ের সকল কেনাকাটা ছেড়ে দিলাম।আমি জানি, মা লাল রঙ পছন্দ করে না। আমিও আগে পছন্দ করতাম না কিন্তু তোমাকে লাল রঙের শাড়িতে দেখে কেন যেন লাল এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় রঙ হয়ে গিয়েছে!
তো যা বলছিলাম মা তোমার জন্য আর লাল রঙ সিলেক্ট করেনি করেছে গোলাপি রঙের শাড়ি। ব্যস,আমি গিয়ে তোমার জন্য একটি লাল রঙের সুতির শাড়ি কিনে আনলাম।সেই লাল শাড়ী এখন তোমার গায়ে জড়িয়ে আছে। আমি দিলে তো জীবনেও পড়তে না তাই মাকে দিয়ে শাড়ির প্যাকেটটা তোমার কাছে পৌঁছিয়েছি।সেদিন তোমাকে লাল শাড়ীতে দেখে আমি একটা কথা বলেছিলাম,
“আমাদের বিয়ের রাতেও ঠিক এমন সাজে ক্লান্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে তো তুমি?”
তুমি হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না কিন্তু আজ আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিতে চাই। এই যে লাল শাড়ী গায়ে আমার ঘরে লাল পরি ঘুমিয়ে আছে, এইটাই বা কম কীসের!

সে রাতে ফায়েজ একফোঁটা ঘুমিয়েছে কি না সন্দেহ আছে।পুরো রাত জুড়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল খেয়ার পানে।

ইশশ,খেয়া যদি জানতো যে ও যখন ঘুম মেটাতে ব্যস্ত ঠিক তখন কেউ ওর দিকে তাকিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত!

সকালের ঝলমলে রোদের তীব্র আলো ফায়েজের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।বহুকষ্টে চোখ খুলে তাকিয়ে ফায়েজ নিজেকে আবিষ্কার করে চেয়ারে কিন্তু তাজ্জব হলেও একটি ব্যাপার হলো, ওর গায়ে কাঁথা দেয়া। তারমানে, খেয়া ওর গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়েছে!

ফায়েজ খাটের দিকে তাকিয়ে দেখে খেয়া নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে,নিশ্চয়ই খেয়া শাওয়ার নিচ্ছে।

ফায়েজ চোখ কচলে গায়ের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। এমন সময় ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হয়ে এলো খেয়া, ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে।

এই প্রথম ফায়েজ দেখলো খেয়ার কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া কেশরাশি। তাদের যতবার দেখা হয়েছে ঠিক ততবার খেয়ার চুল বাধা ছিলো।

খেয়া চুল মোছা শেষ হলে বারান্দায় গিয়ে ভেজা তোয়ালে শুকাতে দিয়ে আসে।ঘরে এসে চেয়ারের দিকে খেয়াল করতেই দেখে ফায়েজ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।তারাহুরো করে ফায়েজের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-আপনার কাছে হেয়ার ডায়ার হবে? এতবড়ো চুল আমি কতক্ষণে শুকাবো?

ফায়েজ অবাক হয়ে খেয়ার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ, এই যাবত সময়ে খেয়ার সাথে ওর যতবার দেখা হয়েছে, ঠিক ততবার খেয়াকে আত্মবিশ্বাসী রুপে দেখেছে আর আজ কি না সামান্য হেয়ার ডায়ারের জন্য চিন্তা করছে!

-ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে আছে।

ফায়েজের বলতে দেরি নেই খেয়ার নিতে দেরি হয় নি বোধহয়। কি মনে করে খেয়া হেয়ার ডায়ারটি রেখে টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ফায়েজের দিকে বাড়িয়ে দিলো,

-আসলে,আমি গোসলে যাবার আগে চাচি এসে দিয়ে গেছে, আর বলে গেছে আপনি ঘুম থেকে জেগে উঠলে আপনাকে এই চা মনে করে দিয়ে দিতে।কাপটা ঢেকে রেখেছিলাম চা এখনো গরম আছে খেয়ে নিন।

ফায়েজ হাত বাড়িয়ে কাপটা খেয়ার হাত থেকে নিয়ে নিলো।খেয়া চুল শুকাচ্ছে আর ফায়েজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,

-আরে চায়ে তো চিনি হয়নি।

খেয়া ওর চুল শুকানো বাদ দিয়ে ফায়েজের কাছে এসে বলে,

-আমি তো এক চুমুক খেয়েছিলাম, চিনি তো ঠিকই আছে।

খেয়া কথাটি শেষ করে জিহ্বায় কামড় দিয়ে উঠলো।

ফায়েজ মুচকি হেঁসে বলে,

-আমি চায়ের পরিমাণ দেখে বুঝতে পেরেছি, কারন মা জানে আমি এলাচি চা এককাপ খাই। সেখানে আজ হাফকাপ। তাই, মিথ্যে বলে আপনার কাছে সত্যটা জানতে চেয়েছি আর আমি সফল হয়েছি। আপনার এঁটো চা আমি খাই কি করে? একটা কাজ করুন আপনি চা-টা খেয়ে নিন।

খেয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিজেকে সহস্র গালি দিয়ে চায়ের কাপটা ফায়েজের হাত থেকে নিয়ে এক চুমুক মুখে দিতে না দিতে ফায়েজ টান দিয়ে খেয়ার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে ফেললো।

-থাক, আমি ও তো এই কাপে মুখ লাগিয়ে চা খেয়েছি তারমানে এই চা এঁটো হয়ে গিয়েছে। আপনার খাওয়ার দরকার নেই, আমি খেয়ে নেই।

বলে এক চুমুকে সবটুকু চা খেয়ে নিলো ফায়েজ আর খেয়া সবশেষে বললো,

-আরে আমি তো মুখ লাগিয়েছি, আপনি কেন খাচ্ছেন?

-ভেবে দেখুন কেন, খেয়েছি?

বলেই ফায়েজ শিস বাজাতে বাজাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর খেয়া পুরোটা ভেবে ফায়েজের উপর রেগে ফেটে পড়লো।মানে ও চেয়েছে ফায়েজকে এঁটো খাওয়াতে আর ফায়েজ কি করলো,নিজে এঁটো করে ওকে এক চুমুক খাইয়ে নিজে সবটুকু খেয়ে নিলো।

#চলবে

পরের পর্ব পড়তে পেইজে লাইক দিয়ে সাথে থাকুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here