মন ময়ূরী’ পর্ব-২২ শেষ পর্ব

0
2255

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

শেষপর্বের(অন্তিম অংশ)

সারাদিনের পর হোটেলে ফিরে এলাম ক্লান্ত শরীর নিয়ে। থাইল্যান্ডে এসেছি আজ পনেরো দিন হলো।গানের শুটিংয়ের জন্য এতদূর ছুটে আসতে হয়েছে।

গোসল সেড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি বাবা পিক সেন্ড করেছে ওয়াটস অ্যাপে। লক খুলে চেক করতেই দেখি দুইটা ছোট ছোট বেবির মুখ আমার মোবাইলের স্ক্রীণে ভেসে উঠেছে।

অজানা আনন্দে আমার পুরো শরীর কাঁপছে। একের একের এক ছবি স্লাইড করে দেখছি আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। খুশিতে আমার দুচোখ ভিজে উঠছে বারবার ।

কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার কাছে ভিডিও কল করলাম। বাবা রিসিভ করতেই আমার মোবাইল স্ক্রীণে ভেসে উঠলো, খেয়ার হাসিমাখা মুখ, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।আমার ভেজা দুচোখ দেখে খেয়া হাসিমুখে বলে উঠলো,

-কি হলো নায়ক সাহেব কান্না করছেন কেন?নাকি পরিবারের লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে বলে ভয় পাচ্ছেন?

-তুমি সবসময় আমার ভাবনার উল্টো কথা বলো।কখন এলো ওরা আমাকে বললে না পর্যন্ত,আমার মা হয়েছে নাকি বাবা?

-আমি এমনই নায়ক সাহেব। আপনার একজন মা আর একজন বাবা হয়েছে। দু’দিন বয়স চলছে ওদের দু’জনের।

-খেয়া, তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো। কোনো খুশির খবর তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি জানতে দাও না। ওরা আসবে ওদেরকে আমি নিজ হাতে প্রথম কোলে নিব আর তুমি কি-না আমাকে আজ দু’দিন পর জানালে!বাবা কোথায়?

-বাবা নেই বলতে গেলে কেউই নেই সবাই চলে গেছে আপনার সাথে আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে। আপনাকে যদি ওদের আসার কথা বলতাম তবে আপনি ঠিক মতো কাজ শেষ করতেন?আব্দুল জব্বার কিন্তু আমাকে বলেছে আজ আপনার শুটিং শেষ তবে চলে আসুন আপনার বাচ্চারা আপনাকে মিস করছে।

-আমি জানি আমার বাচ্চারা আমাকে মিস করছে কিন্তু তাদের মা?

-বাচ্চার মায়ের কি বাচ্চার বাবাকে মিস করার কথা ছিল?

-কেন আমাকে মিস করোনি?অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ফায়েজ।

-করেছি তবে আমার নায়ক সাহেবকে বাচ্চাদের বাবাকে নয়।

খেয়ার কথায় হেসে ফেললো ফায়েজ। ফায়েজের হাসি দেখে খেয়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। খেয়া আনমনে বলে উঠলো,

-নায়ক সাহেব অপেক্ষার দিনগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন?এই যে আপনার জন্য আমি আজ দুসপ্তাহ,তেরো ঘন্টা, পঞ্চাশ মিনিট, বিশ সেকেন্ড ধরে অপেক্ষা করছি, জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছে?

-আমিও অপেক্ষা করছি খেয়া। শেষবারের মতো আমার জন্য অপেক্ষা করো। দেখবে আর কখনো তোমায় ফেলে আমার বাচ্চাদের রেখে আমি কোথায় যাবো না,প্রমিজ।

***************

আমার মা আর শ্বাশুড়ি মিলে আমার ছেলে আর মেয়েকে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল। আমি বসে বসে দেখছিলাম কি ভাবে বাচ্চাদের তেল মালিশ করে দেয়?আমার ছেলে তার নানির দিকে তাকিয়ে আছে বিরক্তি নিয়ে হয়তো ওর তেল মালিশের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। আর আমার মেয়ে ওর দাদির দিকে ঠোঁট সরু করে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে সে তার দাদিকে অনেক কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বেচারি বলতে পারছে না।

আমি যখন আমার ছেলে-মেয়ের কান্ড দেখছিলাম এমন সময় বাড়িতে ফিরে আসে ফায়েজ,ফাহিম,আমার বাবা আর শ্বশুর। আজ ষোলো দিন পর ফায়েজ নামক ব্যক্তিটাকে দেখে আমার দু’চোখে অভিমানী অশ্রু এসে ভিড় জমাতে লাগলো। কিন্তু, আমি চাই না ফায়েজ আমার অভিমানী অশ্রু দেখুক। আমি চাই ফায়েজ আমার ভালোবাসা দেখুক, আমার ভালোবাসা দেখে সে মুগ্ধ হোক।যেমনটা ওর আমার প্রতি ভালবাসা দেখলে আমি মুগ্ধ হই।

ফায়েজ এগিয়ে এসে আমার পাশে বসে নিচুকন্ঠে বললো,

-মা হবার পর দেখছি আরও সুন্দরী হয়ে বসে আছো! আমি তো পাগল হয়ে পাবনায় চলে যাব, খেয়া।

আমি হাসিমুখে ফায়েজের দিকে তাকিয়ে নিচুকন্ঠে বলি,

-পাবনায় কি একা যাবে না-কি আমারও যেতে হবে সাথে?

-তুমি যেখানে আমি সেখানে তুমি কি জানোনা?

-স্যার,ভাবিকে পরেও গান শোনাতে পারবেন।দেখেন না স্যার আপনার ছেলে কিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে?

আব্দুল জব্বারের কথা শুনে উপস্থিত সকলে একসঙ্গে হেসে ফেললো আর ফায়েজ মাথা নিচু করে ফেললো লজ্জায় ।

ফায়েজ উঠে গিয়ে ওর শ্বাশুড়ি এবং মায়ের সামনে গিয়ে বসে পড়লো।ফায়েজের কোলে একে একে ওর দুই সন্তানকে তুলে দিলো ওর মা এবং শ্বাশুড়ি।

ফায়েজ ওদের কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-বাবা, বাবা হবার আনন্দ এত মধুর হয় কেন?

ফায়েজের বাবা ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কারণ তিনিও জানেন না বাবা হবার আনন্দ এত মধুর হয় কেন?

দেখতো দেখতে কেটে গেছে একমাস।

আজ ফায়েজ এবং ওর পরিবারের সকল সদস্যকে একটি এ্যাওয়ার্ড ফ্যাংশনে ইনভাইট করা হয়েছে।

খেয়া প্রথমে বারণ করলেও ফায়েজের অনুরোধে খেয়া যেতে রাজি হয়।

ফায়েজ বেস্ট এক্টর হিসেবে এ্যাওয়ার্ড পায়। এ্যাওয়ার্ড নিতে যখন ওকে মঞ্চে ডাকা হলে ফায়েজ হাসিমুখে এগিয়ে যায়।

হাসিমুখে সংস্কৃতিমন্ত্রীর হাত থেকে এ্যাওয়ার্ড নেয় ফায়েজ।এ্যাওয়ার্ড নেবার পর ফায়েজ মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্য বলে,

-আজকের দিনটা আমার জন্য অনেক মূল্যবান। আমার ক্যারিয়ারের এই প্রথম কোনো ন্যাশনাল ওনার আমি পেয়েছি আপনাদের ভালোবাসায়। আপনারা অনেকেই আমার ভার্চূয়াল বা পারসোনালি শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি আপনাদের ভালোবাসায় এতটুকু পথ এগিয়ে আসতে পেরেছি।
কিন্তু, আমার জীবনে এমন একজন আছে যাকে ছাড়া আমার এত জনপ্রিয়তার কোনো মূল্য নেই। সে হলো আমার স্ত্রী নুজহাত খাঁন খেয়া। অর্ধ শতাধিক সিনেমায় আমি নায়কের রোল প্লে করেছি এবং আমি এই নায়কের রোলে সফল হয়েছি বারবার আপনাদের অনুপ্রেরণায়।
কিন্তু, আমি চাই আমার বাস্তবিক জীবনে আমার স্ত্রীর কাছে সফল নায়ক হতে। আমার বাচ্চাদের কাছে একজন বেস্ট বাবা হতে।
হয়তো,অনেকেই বলতে পারেন আমার এই সিদ্ধান্তের পিছনে আমার স্ত্রীর হাত আছে কি-না । কিন্তু, আমি বলব আমার এই সিদ্ধান্তের ওপর ওর কোনো হাত নেই। আমার প্রত্যেকটি সফলতায় ও আমার চেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়।
আমি যদি আমার রিয়েল লাইফে বেস্ট হিরো না হতে পারি, তাহলে এত জনপ্রিয়তা আমার জীবনের কি কাজে লাগবে?
আজকের পর থেকে অফিসিয়ালি আমি আর সিনেমায় কাজ করবো না। আমি সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

ফায়েজের বক্তব্য শেষ হতেই সকলের করতালিতে মুখরিত পুরো স্টেডিয়ামে। খেয়ার মুখে প্রাপ্তির হাসি থাকলেও চোখে আনন্দের অশ্রু। আনমনে নিজেকে নিজে বলে,

-এত সুখ আমার কপালে সইবে তো?

রাত আনুমানিক বারোটা বাজে,

খেয়া তার বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে বারান্দায় ফায়েজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খেয়া দেখলো ফায়েজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ওদের বিয়ের ছবি দেখছে।

-দেখতে দেখতে আজ দু’বছর হতে চললো আমাদের বিয়ের।আচ্ছা, বিয়েতে আপনি পাগড়ি পড়ে যাননি কেন?

-পাগড়ি পরে গিয়েছিলাম কিন্তু খুলে রাখার পর আর খুঁজে পাইনি। হয়তো,তোমার বান্ধবীরা আমার জুতা চুরি করতে না পেরে পাগড়ি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আর পাগড়ির ব্যাপারে কিছু বলিনি, আমার তখন মনে মনে হরতাল চলছিল কখন তোমার নামে কবুল বলবো! পাগড়ি গিয়েছে যাক বৌ আমার হলেই হলো।

-বাব্বাহ্,আপনি এতো বিয়ে পাগল ছিলেন আমি ভাবতেও পারছি না!

-তুমি ভাববে কি করে!তুমি তো খালি প্লান করছিলে কিভাবে তোমার রুপের আগুনে আমাকে গলা চিপে মেরে ফেলবে। আমি অনেক শক্ত মনের মানুষ দেখে অন্য কেউ হলে তোমার বিরহের যাতনায় এমনিতেই মরে যেতে।

-সবই বুঝলাম, কিন্তু রুপের আগুন গলা চিপে মেরে ফেলে কি করে?

-দেখতে চাও?

-হুম।

খেয়াকে এক ঝটকায় নিজের বাহুডোর আবদ্ধে নিয়ে নিলো ফায়েজ। খেয়া হাসিমুখে বললো,

-এটাকে বুঝি রুপের আগুনে চিপে মেরে ফেলা বলে?

-আমার রুপের আগুনে মরে কি করবে? আমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে না-হয় আমায় আরও ভালোবাসো।

-সিনেমায় কাজ না করার কারণ কি,নায়ক সাহেব?

-কারণ, তো বলেছি আমি।আর করো নায়ক হবার দরকার নেই আমার শুধুমাত্র তোমার নায়ক সাহেব হিসেবে থাকলেই চলবে।

ফায়েজের কথাটি শেষ হতেই খেয়া নিঃশব্দে ফায়েজের বুকে মাথা রেখে চুপ করে আছে। ফায়েজ খেয়ার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে বলে,

-খেয়া তোমার মুখ থেকে আমি কি কখনো সেই ম্যাজিকাল তিনটি ওয়ার্ড শুনতে পাবো না?

খেয়া ফায়েজের বুক থেকে মাথা তুলে ফায়েজের দিকে তাকিয়ে বলে,

-ভালোবাসি বললে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয় না বললে প্রকাশিত হয় না?

-হয়, অনেক বেশি প্রকাশিত হয়। কিন্তু, ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে ভালোবাসি কথাটি শুনতে মন্দ লাগে না।

খেয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো এরপর ফায়েজের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বললো,

-আমার বয়স যখন ষাট তখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আধপাকা চুল দেখে দুঃখ পাবো বুড়ি যাবো বলে ঠিক তখনি আপনি এসে আমার কাঁধে থুঁতনি রেখে আমাকে স্বান্তনা দিলে আমার চলবে।
আমি যখন মৃত্যুর দাড়গোড়ায় পৌঁছে যাবো ঠিক তখন আমি চাইবো আপনার কোলে মাথা রেখে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে। আপনাকে আমি আপনাকে ভালোবাসি বলব না কারণ ভালোবাসি বললেও ভালোবাসা যায় না। প্রকাশে সস্তা হয়ে যাওয়া বস্তুর চেয়ে অপ্রকাশিত ভালোবাসা অনেক দামী। মাঝে মাঝে হৃদয় থেকে একটু করে ভালোবাসা বের করে সামনের মানুষটির কাছে বিলিয়ে দিলে অপর মানুষটি সেই ভালোবাসা উপভোগ করতে পারে। আপনাকে ভালোবাসি শব্দের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। ঠিক ততটাই যতটা কেউ এই ভালোবাসি শব্দটার ব্যাখার করতে পারেনি।

ফায়েজ মুগ্ধ হয়ে তার মন ময়ূরীর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়েজ খেয়াকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর খেয়া ফায়েজের দিকে একমনে তাকিয়ে দেখছে তার নায়ক সাহেবকে।

খেয়া জানে ফায়েজ এমন একটা মানুষ যাকে হাজার কথা দিয়ে মন ভোলানো যায় না কিন্তু একটুখানি ভালোবাসা দিলে তার জীবনটা দিয়ে দিতে কার্পন্য বোধ করবে না।

খেয়ার বিধাতার কাছে শুধুমাত্র একটি আর্জি, তার ছেলে ফুয়াদ,মেয়ে ফাতেমা আর ফায়েজকে তার জীবনের সাথে জুড়ে রাখুক, এরচেয়ে সুখকর জিনিস বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো স্থানে নেই।

ফায়েজ খেয়াকে খাটে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিতে যাবে এমন সময় ওদের ছেলে ফুয়াদ ওয়া ওয়া করে কেঁদে উঠলো।ছেলেটা হয়তো আবারও বিরক্তবোধ করছে ওর বাবা-মায়ের কান্ডে।

ফায়েজ আর খেয়া একে-অপরের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো।

#সমাপ্ত

(আসসালামু আলাইকুম। অতঃপর শেষ হলো #মন_ময়ূরী।আপনাদের ভালো লাগা কমেন্ট করে জানাবেন। আপনাদের মাঝে ফিরে আসবো নতুন কোনো ভালোবাসার জোড়াপাখিকে নিয়ে। ততদিন ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here