#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther
৩.
-তুমি নাকি আমার ছেলেকে রিজেক্ট করেছো, কথাটা কি সত্যি, খেয়া?
আমার সামনে বসা মধ্যবয়স্ক পুরুষটির কথা শুনে মাথা উচু করে তাকিয়ে উপর নিচ করে বুঝালাম, যে সত্যিই আমি উনার ছেলেকে রিজেক্ট করেছি।
আমার মাথা ঝাঁকানো দেখে আমার দাদি আমাকে চোখ রাঙানি দিলেন। দেখ চোখ রাঙানি তাতে আমার কি!আমি তো ওই ফায়েজ চৌধুরীকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছি না।
দুপুরে ভার্সিটি থেকে বাড়িতে আসার পর দেখি এলাহি আয়োজন চলছে। আমার মা একবার এদিকে একবার সেদিকে দৌঁড়ে গিয়ে তদারকি করছে কাজের লোকদের সাথে, যেন সবকিছু পার্ফেক্ট হয়। আমার মায়ের অতি উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে উনার বেয়াই সাহেব আজ প্রথমবারের মতো এই খাঁন বাড়িতে পর্দাপন করবেন।
চেষ্টা করেছিলাম গা ঢাকা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো কিন্তু তার আর সম্ভব হলো কই! আমার দাদি এসে আমার হাত চেপে ধরলো, আমি পিছু ফিরে দাদির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলি,
-আসলে, হয়েছে কি দাদি আমি আমার ব্যাগ রেখে চলে এসেছি।
-ওহ্ তাই। তাহলে তোর বামহাতে যেটা আছে ওটা কি বাজারের ব্যাগ?
দাদির কথা শুনে চোরা চোখে তাকিয়ে দেখি আসলেই আমার ব্যাগ আমার হাতেই আছে।
-খেয়া, মিথ্যে যেহেতু বলতে পারিস না। তবে কেন বলিস? এবার আয় আমার সাথে, তোকে আজ আমি নিজ হাতে তৈরি করে দিব।
কি আর করার দাদির পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম।
সর্বপ্রথম দাদি আমাকে ভাত খাইয়ে দিলো। এরপর, দশমিনিটের মতো রেস্ট করতে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছুসময় পর ফিরে এলেন শপিংব্যাগ নিয়ে। আমি শোয়া থেকে উঠে বসে দাদির দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। দাদি হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন, হাসিমুখে বললেন,
-এটাতে তোর জন্য শাড়ি আছে। তুই তো আবার শাড়ি পড়তে ভীষণ ভালোবাসিস।
আমি মাথা নাড়িয়ে হু বলে খাট থেকে নেমে দাদির কাছ থেকে শপিং ব্যাগটি নিয়ে খুলে শাড়িটা বের করলাম। লাল রঙের জামদানী শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ, পেটিকোট।লাল রঙের শাড়ি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো।
-দাদি, আমি কি নতুন বৌ? যে তুমি আমার জন্য এই রঙের শাড়ি নিয়ে এসেছো। এই রঙের শাড়ি পরে লাজুকলতা সেজে তোমার ভাতিজার সামনে গিয়ে বলবো, কেমন আছেন মাহমুদ চাচা?
আমার কথা শুনে দাদি আমার মাথায় চাপড় দিয়ে বলে,
-বড্ড কথা বলিস, খেয়া। আমার কথামতো না চললে তোর বাবাকে বলবো তোকে ওই নায়ক সাহেবের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে।
দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি আসলেই আমার সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটি আমার দাদি! মানে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে কে,স্বয়ং আমার আপন দাদি!
শাড়ি হাতে নিয়ে রাগ করে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।শাড়ি পড়ে দাদির সামন গিয়ে দাঁড়ালাম মুখ কালো করে। দাদি আমার মনখারাপের তোয়াক্কা না করে, আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো আয়নার সামনে রাখা টুলে।
আধঘন্টা ঘোষামাজা করার পর আমার রেহাই মিললো দাদির হাত থেকে। দাদি এবার আমার থুতনিতে হাত রেখে বললেন,
-দাদিবু, আয়নায় তাকিয়ে দেখ তো তোকে কেমন লাল বৌ দেখাচ্ছে!
-তোমরা দেখো আমার নিজেকে দেখার দরকার নেই।
রাগ নিয়ে কথাটি বলে মোবাইল হাতে নিয়ে গেমস খেলতে লাগলাম।
মায়ের কথা শোনা গেলো, মা দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
-মা, আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসুন মাহমুদ ভাই চলে এসেছেন।
দাদি উপুড় হয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন। আর আমি এতক্ষণ যতই রাগ আর সাহস নিয়ে ছিলাম মাহমুদ চাচা চলে এসেছেন এই কথা শোনার পর আমার পা কাঁপছে। উনি যদি বিয়ের ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তবে কি উত্তর দিব আমি?
নানান চিন্তা করতে করতে কখন যেন আমার পিছনে এসে মা দাঁড়িয়েছে টের পায়নি।মা, আমার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠি৷ পরমূহুর্তে, পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি মা এসেছে। মা, আমাকে উনার সাথে যাওয়ার জন্য ইশারা করতেই, আমি মা’কে বলি,
-মা, এইভাবে চাচার সামনে না গেলে হয় না?
মা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছি কি-না! আমার গালে হাত রেখে বললেন,
-তুই হয়তো ভয় পাচ্ছিস এই ভেবে যে, মাহমুদ ভাই ফায়েজের বাবা। যদি উনার ছেলেকে রিজেক্ট করার ব্যাপারে তোকে কিছু প্রশ্ন করে এই ভেবে, তাই তো?
আমি মাথা নাড়িয়ে হু বললাম।
-তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি, সেই সিদ্ধান্ত তোর বাবা,দাদি আর আমি মেনে নিবো।তবে,এমন কোনো কথা বলিস না যাতে কেউ বলতে পারে তোর লালন-পালনে আমরা কোনো ঘাটতি রেখেছি।
মায়ের কথায় নিশ্চয়ই কোনো জাদু আছে। হুট করে আমার ভয়ের মাত্রা অনেকটা কমে গেলো। মা’কে জড়িয়ে ধরলাম, মা হেঁসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-পাগলি, এখন চল।
মায়ের কথায় হেসে মা’কে বলি,
-চলো পাগলির মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মা আমার দিকে রাগীদৃষ্টিতে তাকিয়ে, পরক্ষণে হেসে ফেললেন।
মা আমার হাত ধরে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন।ড্রইংরুমে যাবার পর দেখি আমার দাদি হাসিমুখে কথা বলছে মাহমুদ চাচার সাথে।
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দাদি আর মাহমুদ চাচা আলাপচারিতা বন্ধ করে ফিরে তাকালো।মা বললেন,
-ভাই, এই যে আপনার ভাইয়ের মেয়ে খেয়া। খেয়া ইনি তোমার মাহমুদ চাচা।
আমি মাথা নিচু করে মাহমুদ চাচাকে সালাম দিলাম। চাচা আমার সালামের উওর নিয়ে বললেন,
-খেয়া,বসো। তোমার সাথে কথা বলি। তোমাকে আমি শেষ দেখেছিলাম যখন তোমার বয়স চারবছর আর এখন তো তুমি বাইশ বছরের হয়ে গেলে।
আমি মায়ের দিকে তাকাতেই মা আমাকে ইশারা করলেন, বসতে। আমি দাদির পাশে বসে পড়লাম। মা চলে গেলেন। আমি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন সাবজেক্টে পড়াশোনা করছি এগুলো জিজ্ঞেস করলেন। আমি সব প্রশ্নের উত্তর হাসিমুখে দিলাম।
ঠিক কিছু মূহুর্তের মাঝে চাচা আমাকে উপরোক্ত প্রশ্নটি করলেন।
-খেয়া, আমার ছেলে কি দেখতে খারাপ?
-না, চাচা।দেখতে খারাপ হবে কেন? উনি যদি দেখতে খারাপ হতো তবে কি উনি নায়ক হতেন?
-তাহলে,ওকে রিজেক্ট করার কারণ?
-আমি নায়কদের পছন্দ করি না। মাথা নিচু করে কথাটি বললাম।
এমন সময় কারো পদধ্বনি শুনে মাহমুদ চাচা, দাদি, আমি সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি নায়ক সাহেব এসেছেন।
ফায়েজকে এইসময়ে আমাদের বাড়িতে আসতে দেখে আমি কিছুটা বিরক্তবোধ করছি।
দাদি তো ফায়েজকে দেখে খুশিতে আত্মহারা, মা কিচেন থেকে এসে ফায়েজকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বসার জন্য অনুরোধ করে চলে যায়।
আমি একবার ইশারায় দাদিকে বলেছিলাম, আমি ঘরে চলে যাই৷ কিন্তু, দাদির চোখ রাঙানো দেখে অসহায় হয়ে নায়ক সাহেবের মুখোমুখি হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
এরইমাঝে মা এবং আমাদের গৃহকর্মী এসে বিভিন্ন রকমের খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। আমি নায়ক সাহেবের নজর থেকে বাঁচার জন্য সেখান থেকে উঠে মায়ের কাছে চলে এলাম। এটা সেটা মা’কে এগিয়ে দিচ্ছি।
তখন আমি টেবিলের উপর গ্লাস সাজিয়ে রাখছিলাম এমন সময় আমার পিছন থেকে একটি হাত এসে পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে নিলো।আমি অবাক মিশ্রিত অভিব্যক্তি নিয়ে পিছনে ঘুরে দেখি নায়ক সাহেব পানি খাচ্ছে। ভীষণ রকমের রেগে গেলাম, কত বড় সাহস আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছে!
দুহাত কোমরে রেখে জিজ্ঞেস করি,
-নায়ক সাহেব এতদিন তো ভেবেছি আপনি অশুদ্ধ পুরুষ, এখন তো দেখছি কিভাবে পানি পান করতে হয় সেটাও জানেন না।
ফায়েজ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে খেয়ার দিকে, খেয়া ফায়েজের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-পানি দাঁড়িয়ে পান করতে নেই, বসে পান করতে হয়।গ্লাসটি আমার হাতে দিন।
খেয়া ফায়েজের হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে টেবিলের উপরে রেখে কিচেনে চলে গেলো।
ফায়েজ তার বাবার পাশে গিয়ে আবারও বসে পড়লো।
ফায়েজ আর তার বাবা রাতের খাবার খেয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। বিদায়ীক্ষণে ফায়েজের দুচোখ খেয়াকে খুঁজে বেরিয়েছে কিন্তু ফলাফল জিরো। কারণ, খেয়া তার মাথাব্যাথার অজুহাত দেখিয়ে ঘরে থেকে বের হয় নি।
*******************
-ফায়েজ, তুমি আমার সাথে মিথ্যে কথা বললে কেন?
ফায়েজ তখন স্ক্রিপ্ট পড়ছিল, তার বাবার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে ফায়েজ৷ হাত থেকে কাগজটি টেবিলের উপর রেখে তার বাবাকে বললো,
-বাবা,ভিতরে আসেন।
ফায়েজের বাবা এসে ছেলের খাটের উপরে বসলেন।ফায়েজ চেয়ার টেনে এনে তার বাবার মুখোমুখি বস বললো,
-আপনাকে এই কথা জব্বার বলেছে, তাই না বাবা?
-হ্যা,গতকাল রাতে তোমার কথার সাথে তোমার চেহারার মিল খুঁজে পাইনি আমি, ফায়েজ। তুমি আমার ছেলে ফায়েজ আমি জানি তুমি কখন খুশী থাকো আর কখন তুমি দুঃখী থাকো।তবে, কেন আমার সাথে মিথ্যে বললে ফায়েজ?
-বাবা,আমি চাইনি।আপনি এটা জেনে কষ্ট পান আপনার পছন্দ করা পাত্রী আপনার ছেলেকে মুখের উপর রিজেক্ট করে দিয়েছে। তাছাড়া?
-তাছাড়া, কি? আমি আজ খেয়াকে একই প্রশ্ন করেছি সেখানে তার জবাব ছিল সে নায়ক পছন্দ করে না। তাহলে, তুমি কেন?
-কারণ, বাবা আমি খেয়াকে পছন্দ করে ফেলেছি। আমি সময় নিয়ে যত্ন নিয়ে চেষ্টা করবো খেয়াকে আমার জীবনে নিয়ে আসতে।
ফায়েজের বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। তিনি তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, আসলেই কি ফায়েজ খেয়াকে পছন্দ করেছে নাকি শুধুই মনগড়া কল্পকাহিনি!
#চলবে