#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৪
আলতাফ আংকেল মেহমেদের জন্য বাবার কাছে আমাকে চেয়ে বসলেন। আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এটা সত্যি যে আমি মন, প্রান এবং হৃদয় দুটোই মেহমেদকে চেয়ে এসেছে। কিন্তু, মেহমেদের বিচার বিবেচনা থেকে মেহমেদ আমাকে চেয়েছে কিনা আমি তা জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি কখনো। মেহমেদ আমার সম্পর্কে কতটুকু জানে আমি তাও জানি না।
আমি নিতান্তই একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পরে আমার আর কখনো মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। আর সত্যি বলতে ইচ্ছেও হয়নি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার। বয়স আমার তখন সবেমাত্র তিন। সেভাবে কিছুই মনে করতে পারি না। আবছা আবছা মনে পড়ে আমার বড় ভাই আরশান ভাইয়ার কথা। তিনি এখন কোথায় আছেন কেমন আছেন কিছুই জানি না আমি। আমার জীবনে বাবা ব্যাতীত কেউ ছিল না কখনোই। দাদীমা আমার জীবনের খুব বড় একটা অংশ ছিল। আমি তাকে-ও হারিয়ে ফেলেছি।
বাবা সবকিছু বিবেচনা করে রাজি হলেন মেহমেদের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রসঙ্গে। সেদিন ও্রথমবারের মতো মেহমেদ জুবায়ের নামক পুরুষটি আমার বাড়িতে এলো। অতি সন্নিকটে থাকা সত্ত্বেও আমি তাঁর নিকট একবারও তাকাতে পারিনি। আমার চোখের দু’পাতায় অবস্থানরত লাজ লজ্জা আমায় কোনো ভাবেই মেহমেদের দিকে তাকাতে দিচ্ছিলো না। সময়টা অন্য হলে আমি বেহা’য়ার মতো মেহমেদের দিকে চেয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন কেন যেন সেটা পারছি না। যাওয়ার আগে মেহমেদ একবার উঁচু গলায় আমায় ডেকে বসলো, “লাবণ্য”
আমি অবাক ও বিস্মিত! না চাইতেও আমি সারা দিয়ে ফেললাম। শরীরের গোপনে সৃষ্টরত কম্পন মেহমেদ দেখলো না। আমার বুকে এক গুপ্ত ঝড় নেমে গেল। মেহমেদের নিষ্পাপ দৃষ্টি আমার ভেতরটা ছিড়েখুঁড়ে দিলো। কথা বলার ছলে বারবার মেহমেদের চোখদুটোর দিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এটা সত্যি নয়! এটা আমার মস্তিষ্কের করা এক অনুরূপ কল্পনা! এক সুন্দর সমুদ্রের ন্যায় গভীর দৃষ্টি আমি আজ অবধি কখনো দেখিনি।
সেই মুহূর্তে আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,
” ওগো হে প্রেমিক পুরুষ। তোমার অক্ষি যুগলের দাপটে আমি যে পুড়ে যাচ্ছি বারংবার!”
বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করে সকলে যখন চলে গেল।আমি তখনও মেহমেদের কথাই স্মরণে রেখে দিচ্ছিলাম।
এরপরে দিনগুলো ছিল আমার স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর! আমি সারাটাদিন বয়ে যেতো মেহমেদের অপেক্ষায়। কাজ শেষে মেহমেদ যতটুকু সময় আমাকে দিতো। ততটুকু সময় যেন চোখের মুহূর্তেই শেষ হয়ে যেতো। মেহমেদের পছন্দে বিয়ের প্রত্যেকটা জিনিস কিনেছিলাম আমি। এই দিনটার অপেক্ষায় অপেক্ষাকৃত ছিলাম আমি। আমার জীবনে এমন একজন মানুষ আসবে যে আমার ওপরে নিজের অধিকার ফলাবে। আমি যাঁর ওপর অধিকার বসত একটা কথা বলতে পারবো। যে হবে সম্পূর্ণ রূপে আমার। নিজের বলতে তো শুরু থেকেই আমার কিছু ছিল না। আমি ছিলাম বরাবরই শুন্য!
আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন ছিলো মেহমেদ ও আমার বিয়ের দিন। যে আমি কখনোই হালকা রং ব্যাতীত অন্য রং ছুয়ে দেখিনি। সেই আমি সেদিন নিজের পছন্দ অপছন্দ সব একপাশে রেখে; মেহমেদের পছন্দের লাল রং নিজের গায়ে মুড়িয়ে ছিলাম। আমার ভাগ্যের মতো আমার হাতে মেহেদীর রং দিয়েও মেহমেদের নামই লিখা ছিল। ভাগ্য আমাকে বারবার নিরাশ করলেও এবার করলো না। আমি আমার মেহমেদকে পেয়ে গিয়েছিলাম আজীবনের মতো। আমার মন সেদিন আবার বলে উঠলো,”মেহমেদ আমি যদি আবার জন্মাতাম এই পৃথিবীতে তবে তোমার ছায়াতরু হয়েই জন্মাতাম। যেখানে তুমি নেই সেখানে আমার যাতায়াত আমার প্রয়োজনীয়তা অতি তুচ্ছ! ”
চলবে…