#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৫
বাবা আজ সকালে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। আমি ঘর গুলো গুছাতে গিয়ে পুরনো কিছু ছবির অ্যালবাম পেলাম টেবিলের ওপরে। কত যত্ন করে রাখা ছবিগুলো! কিন্তু এই ছবির মানুষগুলো আমার জীবনে নেই। মায়ের কথা আবছা মনে আছে। ভাইয়ার কথা সেভাবে কিছুই খেয়াল নেই। আমার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ভাইয়াকে একটু দেখার। কিন্তু সেটা হয়তো এই জীবনে আর কখনো সম্ভব না।
বিয়ের পর মেহমেদকে আমি সেভাবে কাছে পাইনি। নিজের পড়াশোনা তারপর বাবার দেখাশোনা করা। সবমিলিয়ে আমার সংসার জীবনের শুরুটা ছিল একেবারে অগোছালো। এরমধ্যে আংকেল একবার বলেছিলেন মেহমেদের সঙ্গে কোয়াটারে গিয়ে উঠতে। তবে, আমি চাইনি বাবাকে ছেড়ে থাকতে। এই তো এভাবেই চলছে সংসার!
সারাদিন কিংবা সারা সপ্তাহে মেহমেদ যতটুকু সময় আমাকে দেয় সেটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সারা সপ্তাহ শেষে আমি শুধু ক্ষণিকের জন্যই মেহমেদকে কাছে পাই। আমি এই সময়টুকুর জন্য সারাটা সপ্তাহ ছটফট করি। তবে, মেহমেদের ভেতরে আমি সেভাবে আমাকে কাছে পাওয়ার মতো আকুতি দেখিনি। আমি কী ভুল মানুষকে আমার জীবনে ঠাঁই দিলাম?
প্রতিদিন বেলা করে আমি একবার হলেও মেহমেদকে ফোন দেই। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি। ওর কন্ঠস্বর শুনি:এটাই আমার ভালো লাগা। সারা দিনের এত ক্লান্তি আমার নিমিষেই কেটে যায়। আজ সারাদিন আমি নিজে থেকে কোনো কল করিনি। ভেবেছিলাম মেহমেদ অবশ্যই ফোন করে একবার খবর নেবে। কিন্তু, ঘটনাটি ঘটলো তাঁর বিপরীত। মেহমেদ নিজে থেকে কোনো কল দিলো না। একপাক্ষিক এক অভিমানে আমি সেদিন সারাদিন ডুবে রইলাম। আমার মন বারবার বিষন্নতায় ডুবে যাচ্ছিলো। আমি কী ভুল মানুষকে আমার জীবনে ডেকে আনলাম?
খেতে বসে খাবার গলা দিয়ে সেভাবে নামছিল না। সেদিন রাতে বাবার সঙ্গে ছিলাম আমাদের বাড়িতে। মেহমেদ এখানে না থাকলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকি। বাবা বারবার আমার অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করছিলেন। আমি কিছুটা নিজে থেকেই এড়িয়ে গেলাম সবকিছু। আমি চাইনি আমাদের স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় কেউ বিচরন করুক।
বাবা রাতে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন। জন্মদিন আমার কাছে কখনোই খুব বিশেষ কিছু ছিল না। কারণ, আমার জন্মদাত্রী-ই আমাকে ফেলে চলে গেছেন। সেখানে জন্মদিন কীভাবে আমার জীবনের বিশেষ দিন হতো?
মেহমেদ সেইবার প্রথম বারের মতো আমাকে নিজে থেকে ফোন দিলো। আমি আনন্দে, অশ্রুতে আবেগাপ্লুত হয়ে পরলাম। মেহমেদের সঙ্গে ভেজা গলায় কথা বলছি আর চোখের পানি মুছছি। মনে হচ্ছিলো এটা যেন কোনো স্বপ্নের জগত। আমি চোখ বন্ধ করলেই হয়তো এই স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে। জন্মদিন নামক দিনটি সবসময় আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হলেও;তখন মনে হলো নাহ! আমার জীবনে সত্যিই জন্মদিন নামক একটি বিশেষ দিন আছে। যেই দিনে প্রিয় মানুষদের কাছে পাওয়া যায়।
সেই এত রাতে দরজা খুলে দেখলাম মেহমেদ গোলাপ আর কেক হাতে দাঁড়িয়ে। গায়ে তাঁর প্রচন্ড জ্বর। জীর্ণশীর্ণ ক্লান্তি মাখা এক মুখ। আমি নিজে থেকে প্রথমবারের মতো মেহমেদকে স্পর্শ করলাম। চুমু এঁকে দিলাম ওই ঘাম আচ্ছন্ন ওই ললাটে। মেহমেদের দুই বাহুতে শুধু আমার অবস্থান। আমার হৃদপিণ্ডের প্রতিটি কম্পন আমি লিখে দিলাম মেহমেদের নামে। মেহমেদের নিঃশ্বাসের প্রতিটি বিন্দু আমার বুকের ওপরে এসে ঝড়ে পরছিল। মাতাল অনুভূতিতে আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম। মন বারবার উসকানি দিয়ে বলছিল যে এটাই আমার প্রেমিক পুরুষ। এটাই সেই পুরুষ যে আমার নিকট হতে আমিকে নিঃস্ব করেছে। সেই রাতে আমরা দুজন দুজনের নিকট এতটাই মত্ত্ব ছিলাম যে কোথায় কী হচ্ছে সেদিকের খেয়াল আমাদের ছিল না। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত ছিল এটি।
চলবে….