মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে #নুজহাত_আদিবা পর্ব ৬

0
220

#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৬

“বৃষ্টিতে ভিজবেন মেহমেদ?”

মেহমেদ মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। আমি আবার বললাম,
” চলুন না”

মেহমেদ ল্যাপটপে কাজ করা বাদ দিয়ে বললো,

“উহুম না”

এরপর মেহমেদের সেভাবে কোনো হেলদোল দেখলাম না। বুকের ভেতর এবার চাপা অভিমান জেগে উঠলো আমার।আমার সামান্য একটা কথায় যাঁর ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করে না। তাঁর তো আমার প্রতি কোনো মহব্বত নেই।

সেদিন যতক্ষন বৃষ্টি হয়েছিল আমি ততক্ষনই বৃষ্টিতে ভিজেছি। কিন্তু আমার অভিমান আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। ছাঁদ থেকে নিচে এসে আবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করতেই তীব্র জ্বরে পরলাম। প্রায় চার-পাঁচদিন এই জ্বরে কাবু ছিলাম। কোনো হুশ ছিল না। যতবার জ্বরের ঘোরে চোখ মেলেছি আবছা ভাবে মেহমেদের জীর্ণশীর্ণ চেহারা দেখেছি। ক্লান্তিহীন ভাবে আমার সেবা করেছিল সে। চোখে কোনো অবহেলা অনাদর ছিল না। আচ্ছা, আমি কী জীবনে এরচেয়ে বেশি কিছু চেয়েছিলাম? চাইনি তো! আমি তো এখন সবচেয়ে সুখি একজন মানুষ। আমার কাছে ভালোবাসার মতো মানুষ আছে।

মেহমেদের আদর যত্ন এত ভালোবাসায় আমি দিন দিন আরো আদুরে হয়ে উঠছিলাম। বারবার মনে হতো মানুষটা আমার জন্য এত কিছু করে তবেও আমি কেন এত ব্যর্থ? আমি কী ঠিকভাবে ভালোবাসতে পেরে উঠতে পারিনি এখনও তাঁকে? আমার ভেতরে অনুশোচনার সৃষ্টি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল স্ত্রী হিসেবে আমার জীবনে কোনো সার্থকতা নেই। আমি ভালো ভাবে নিজের স্বামীকে আজ অবধি চিনতে পারিনি। মেহমেদের জন্য আমার শুধু ভালো লাগা ছিল; ভালোবাসাটা ছিল না। অপরদিকে মেহমেদ আমাকে সত্যিই তো ভালোবাসে। কিন্তু আমি তাঁর ভালোবাসা বুঝতেই ব্যর্থ!

মেহমেদ পরদিন কাজে চলে গেল;কাল ফেরার কথা। আমার শরীরটা আগের চেয়ে বেশ ভালো। কিন্তু মনের অবস্থা খুবই খারাপ। বারবার মনকষ্টে দগ্ধ হচ্ছিলাম আমি। জীবন থেকে কী যেন একটা হারিয়ে গেছে! আমি স্ত্রী হিসেবে কী এতটাই অসার্থক!

বাবার কাছে গেলাম। আজকাল বাবার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অসুস্থতার খাতিরে আমার সেভাবে বাবার কাছে আসা হয়নি। বরং বাবাই এসেছিলেন আমার কাছে। ছোটবেলায় শরীরটা খারাপ হলেই বাবা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারাতেন। ওই ঘুমটুকুই আমার জীবনের প্রাপ্তি ছিল। এখন আর এত নিশ্চিত হয়ে ঘুম দেওয়া হয় না।

পিতা মাতা সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারেন। এটা আবারও প্রমাণ হলো। বাবা আমাকে প্রশ্ন করেই বসলেন কী হয়েছে আমার। আমি বেশ কয়েকবার আমতা আমতা করলাম। ভেবেছিলাম আমাদের ভেতরকার কথা বাবাকে জানাবো না। কিন্তু শেষমেশ তা আর সম্ভব হলো না। আমি খুলে বললাম বাবাকে সবকিছু। মেহমেদের দায়িত্বশীলতা, ভালোবাসা, আমার ব্যর্থতা, অনুশোচনা সবকিছু বাবার সামনে তুলে ধরলাম এরপর প্রশ্ন করলাম,

” আমি তো একটা ভালো স্ত্রী নই বাবা। আমার ভেতরে কোনো ভালোবাসা কাজ করে না কেন বাবা? আমার কী মেহমেদের কাছ থেকে সরে আসা উচিত? মেহমেদকে তো আমি স্ত্রী হিসেবে এখন অবধি কিছুই দিতে পারিনি। ”

বাবা বেশ অনেকটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অকস্মাৎ তিনি হেসে বললেন,

” তোমার ব্যর্থতাই তোমার সুখের কারণ নয়তো লাবণ্য? এই যে তুমি মেহমেদের ভেতরে নিজের জন্য ভালোবাসা, অনুভূতি সৃষ্টি করে নিতে পেরেছো। এটাই কী তোমার বড় সার্থকতা নয়? ক’জন পারে নিজের জীবনসঙ্গীর ভেতরে নিজের প্রতি দূর্বলতা সৃষ্টি করতে? আর তোমার যে মেহমেদের জন্য ভালোবাসা কাজ করে না সেটা জানলেই বা কীভাবে? যদি ভালোবাসা নাই থাকতো তাহলে কেন তুমি আমার কাছে ছুটে আসলে এমন একটা পুরুষের জন্য যাকে নিয়ে তোমার কোনো অনুভূতি নেই?”

বাবার পানে আমি চেয়ে রইলাম। বাবার কোনো প্রশ্নে উত্তর আমার কাছে ছিল না।সত্যিই তো তাই! মেহমেদের কাছে আমি অপরিচিতা ছিলাম। সেই মেহমেদ আমার জন্য এতকিছু করছে। আমাকে ভালোবাসছে সেটাই কী আমার জন্য বড় পাওয়া নয়। আমার অনুশোচনা ক্রমে ক্রমে কমে যাচ্ছিলো। আমি বাসি তো মেহমেদকে ভালো। ওটা শুধুমাত্র আমার ভালোলাগা ছিল না! নাহলে যাকে আমি ভালোবাসি না তাঁর জন্য এত অন্তর পুঁড়/ছে কেন আমার?

বাবা ঘুমাতে চলে গেলেন। আমি সারারাত পাশের ঘরে নিজের নেত্রবারি বিসর্জন দিলাম। কেন মেহমেদের জন্য আমার বুকটা যে জ্বলে যাচ্ছে!

সকালে নাস্তা বানিয়ে বাবাকে ডাকতে গেলাম। বেশ কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু বাবা উঠলেন না। আমি সাবধানে গিয়ে বাবার নাকের সামনে হাত রাখলাম। হৃদ স্পন্দন পরীক্ষা করলাম৷ একি! বাবা যে নিঃশ্বাস নিচ্ছে না! মেহমেদকে ফোন করলাম। বাবাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটাল যাওয়ার কিছুক্ষন পরই ডক্টর বাবাকে মৃত ঘোষণা করলেন! আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে পরলাম! যে-ই মানুষটার সঙ্গে কাল রাতে অবধি একসঙ্গে বসে কথা বললাম। সেই মানুষটা আমার জীবন থেকে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। আপন বলতে কী আমার আর কিছুই রইলো না। এরপর আর কিছু মনে নেই। আমি চেতনা হারিয়ে ফেললাম।

পরিপূর্ণ জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম আমি মেহমেদের কাছে। প্রথমে সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। কিন্তু যখন বাবার লা/শটা স্পর্শ করলাম তখন বুঝলাম এটা আমার স্বপ্ন না। মৃত্যুর পরেও বাবার মুখটা খুব হাসিমাখা। অথচ জীবনে তিনি কত কষ্টই না সয়েছেন। নিজের স্ত্রী, সন্তান তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here