#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৭
বাবার দাফন কার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম বাবার ঘরের খাটটার দিকে। কালকে রাতেও তো এখানেই ঘুমিয়ে ছিলেন। আজ এভাবে আমায় একা ফেলে চলে গেলেন? আচ্ছা, সকলে আমায় এভাবে ফেলে চলে যায় কেন? বুকটা এত ভারী ভারী লাগছে কেন? আমার এই জীবনে প্রাপ্তির খাতা কী এটুকুই?
বাবাকে হারানোর আজ প্রায় দুই মাস হতে চললো। আগে মনে বিচিত্র রকমের অনুভূতি কাজ করতো। এখন এসব ভাবলেই বিরক্ত লাগে। মেহমেদের সঙ্গেও কেমন যেন দূরত্ব চলে এসেছে আজকাল। মেহমেদের মধ্যে অবশ্য এই নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। এত বড় একটা শোক কাটিয়ে উঠেছি কিছুদিন আগে। শোক পুরোপুরি এখনও কাটেনি। আজীবনে এই দুঃখ ভোলার মতোও নয়। বাবার অভাব কী আসলেই পূরণযোগ্য?
বাবা চলে যাওয়ার পরে সেভাবে বাবার ফ্ল্যাটে যাওয়া হয়নি। ওখানে গেলেই বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। সামলাতে পারি না কোনোভাবে নিজেকে। আজকেও হয়তো বাবার ফ্ল্যাটে যাওয়া হতো না। কি যেতে হচ্ছে বিশেষ একটা কারণে। বাবার কোনো এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমি অবশ্য জানি না তিনি কে। হয়তো বাবার কোনো পুরনো সহকর্মী বা খুব কাছের কেউ যাকে আমি চিনি না।
ফ্ল্যাটের সামনে যেতেই প্রচন্ড চমৎকার দেখতে লম্বা, ফর্সা গড়নের একটা পুরুষ মানুষকে দেখে আমি থেমে গেলাম। ওনাকে তো আমি সত্যিই চিনি না। এত ইয়াং একজন পুরুষের সঙ্গে বাবারই বা কীভাবে পরিচয়? আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম মানুষটির। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বেশ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,
” আর ইউ মিঃ আশফাক’স ডটার?”
আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিলাম,
” ইয়েস আই এম। বাট হু আর ইউ?”
সেই পুরুষ মানুষটি কেমন একটা হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন একটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
” আমি একচুয়েলি আরশান”
আমার তৎক্ষনাৎ মনে হলো আমার বুকে কেউ ছুঁ/ড়ি দিয়ে আঘা/ত করলো। আমি যা ভাবছি সত্যি তাই নয়তো? আমি তবুও অচেনার মতো ভান করে বললাম,
” চিনলাম না তো ঠিক।”
হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একজন ভদ্র মহিলা আমাকে বললেন,
” আমাকে চিনেছো?”
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি হতবাক হয়ে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম।দীর্ঘ সতেরো বছর পর এই দেখা?
ভদ্রমহিলা একেবারে আমার মতো দেখতে। ভদ্র মহিলা প্রচন্ড সুন্দর। তাঁর গালের ঠিক বাম পাশে একটা তিল রয়েছে। আদতে তিনি আমারই মা।
অন্য কেউ হলে মাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো জড়িয়ে ধরতো। আমার ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটলো না। তিনি যদি আমার মতো দেখতে না হতেন তাহলে আমি কখনোই তাঁকে শত দেখায়ও চিনতাম না। মনের ভেতর কেমন একটা আক্রোশ কাজ করলো। এত বছর পরে তিনি কেনই বা ফিরে এলেন? আমার সামনে এসে তিনি বললেন,
” তুমি নাকি লাবন্য তাই না? তুমি দেখতে একেবারে তোমার বাবার মতো।”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। আমার চেহারাটা মায়ের মতো। বাবার ছিটেফোঁটা অংশটুকুও আমার মধ্যে নেই।
সোফায় বসতে বসতে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন,
” আমি তোমার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েই চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাসপোর্ট জনিত জটিলতায় আর আসতে পারিনি। তোমার বাবাকে শেষ বার দেখার মতো সৌভাগ্যও হয়নি।”
আমি অত্যন্ত তিক্ত গলায় বললাম,
” যে মানুষটা জীবিত থাকাকালীন তাঁকে মূল্য দেননি। ছেড়ে চলে গিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি এত আবেগ?”
আমার বাবার প্রাক্তন স্ত্রী আমার এহেন আচরনে একটুও বিরক্ত হলেন না। স্বাভাবিক মুখ ভঙ্গি বজায় রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন,
” লাবণ্য তোমার এসব কথা বলা অনুচিত নয়। তোমার জায়গায় আমি হলে একই কথা বলতাম। আসলে বলার তো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু কীভাবে শুরু করা উচিত বলো?”
আমি স্থীর দৃষ্টিতে বললাম,
” যখন সবকিছুই শেষ তখন বলার কী থাকতে পারে।”
তিনি আবার হেসে বললেন,
” তোমার মনে এখন অনেক প্রশ্ন সেটা আমি জানি। তোমার বাবা মানুষটা প্রচন্ড ভালো একজন মানুষ। প্রত্যেকটা মেয়ের স্বপ্নের মতো মানুষ তিনি। আমাকে খুব ভালো বাসতেন তোমার বাবা। কিন্তু সব মানুষের কী ভালো বাসার মতো মন থাকে? আমি খুব ছন্নছাড়া স্বভাবের মানুষ লাবণ্য। এই সংসার জীবন কখনো আমার জন্য ছিল না। আমার জীবনে কোনো পিছুটান নেই। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি আমি দেশ বিদেশ ঘুরবো। এই স্বামী, সংসারময় জীবন আমার মনে কখনোই ভালো লাগার সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ, আমি সবসময় পিছুটান হীন স্বাধীন জীবন চেয়েছি। সেকারণেই সংসার জীবন কখনো তাঁর নিগড়ে আমাকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। কিছু কিছু মানুষের হৃদয়ে প্রকৃতি মায়া নামক বস্তুটির বসবাস থাকে না। মনে করো আমি ঠিক তেমনই একজন।”
আমি প্রশ্ন করলাম,
” এটাই কী কারণ ছিল আমার বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার?”
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” এই কারণটা কী যথেষ্ট নয় সবকিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার? ”
আমি বললাম,
” আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন কেন?”
তিনি আমায় জবাব দিলেন,
” তোমাদের দুজনের কাস্টাডি-ই আমি চাইলে নিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু নেইনি কারণ তোমার বাবাকে একেবারে একা করে দিতে আমি চাইনি।”
আমি তাঁর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার বাবা এই মানুষটিকে ভালোবেসে সবকিছু হারিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন শুধু শুন্যতা। জীবন তাঁকে এরূপ নির্মমতা কেন দিলো?
এরপর অনেকক্ষন আমাদের ভেতর কোনো কথা হয়নি। মন থেকে সেভাবে কথা আগানোর মতো সাহসও আসেনি। অপরিচিত মানুষরা প্রথমবার একত্রিত হলে এমনটাই করে হয়তো। কিন্তু এই মানুষটা তো আমার মা। এতটা তো পরিচিত হয়েও এত অপরিচিত কেন?
” বাইরে যে-ই ছেলেটা বসে আছে সে কিন্তু তোমার ভাই। তোমার মনে আছে আরশানের কথা ?”
আমি স্পষ্ট গলায় বললাম,
” চেহারা মনে করতে পারছি না। তবে, দাদীজানের কাছে শুনেছি।”
তিনি প্রশান্ত গলা বললেন,
” তোমার বাবা আগে ডায়েরি লিখতেন। এখনও লেখেন?”
আমি বললাম,
” জানি না।”
তিনি আবার বললেন,
” তোমার বাবার কবরটা কোথায় লাবণ্য?”
আমি বেশ ক্ষানিকটা সময় চুপ ছিলাম। এরপর নিরবতা ভেঙে বললাম,
” সামনের কবরস্থানেই চিরায়ত ভাবে নিদ্রিত আমার বাবা।”
চলবে…..