#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮
” আমি আরশান, চিনেছো আমাকে?”
বাংলা ভাষাতেও বিদেশি ভাষার ছাপ স্পষ্ট। বাংলা বলা যে এতটা কঠিন তা হয়তো আমার ভাইকে না দেখলে বুঝতাম না। আমি হেসে বললাম,
” হুম, চিনেছি তো।”
এরপর আমরা একে অপরের দিকে দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে ছিলাম। এত দিনের অদেখা! এত সহজে কী চোখের তৃষ্ণা মেটে? আমার পাথর হৃদয় মাখনের মতো গলে গেল। আমি জড়িয়ে ধরলাম আমার ভাইকে। আমি কখনোই আমার জীবনে মাকে চাইনি। কিন্তু আরশান ভাইয়ার অভাব বোধ করেছি। জীবনে একবার হলেও তাঁকে দেখতে চেয়েছি। মায়ের প্রতি সত্যি বলতে আমার একটা চাপা রাগ ছিল। ফেলেই তো গিয়েছিলেন তবে ফিরে এলেন কেন? এলেনই যদি তবে আরেকটু আগে কেন এলেন না?
বাবার কবরের সামনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন মা। তাঁর চোখে শোকের ছায়া ছিল কিন্তু কোনো আক্ষেপ ছিল না। আমি এই আক্ষেপটাই তাঁর চোখে দেখতে চেয়েছিলাম। এত সুন্দর সংসার, সন্তান, স্বামীকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। শুধু মাত্র স্বাধীনতার জন্য। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয় সত্যিই কী শেষ অবধি তিনি স্বাধীনতা পেয়েছিলেন?
মা আর ভাইয়া চলে গেলেন। যাওয়ার সময় মেহমেদের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। আমার অশ্রু সংবলিত চেহারা মেহমেদকে স্পষ্ট জানান দিচ্ছিলো এরা আসলে আমার কে। আমি বাবার ঘরে গেলাম। টেবিলের ওপর থেকে আমার বাবার ডায়রিটা নিলাম। বাবার লিখাগুলো কী সুন্দর ঝকঝকে! পড়তে শুরু করলাম সবটুকু। শুরুর প্রতিটা পৃষ্ঠায় বাবার বিয়ের আগে যুবক সময়কার ঘটনা লিখা। আমি মনোযোগ সহকারে গভীর ভাবে পড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর একটা পৃষ্ঠায় চাকরি হবার পর প্রথমবার বিয়ের মেয়ে দেখতে গিয়ে বাবার বিড়ম্বনায় পড়ার গল্প লিখা। মেয়েটা নাকি বাবাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল সে যেন বিয়েতে না বলে। পাশের বাড়ির মদনের সঙ্গে তাঁর গভীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। আমার এটুকু পড়ে সত্যিই হাসি পেল। কত বড় সাহস? আমার বাবাকে হুমকি?
এরপর একটা পৃষ্ঠায় খুব সুন্দর করে লাল নীল কালিতে লিখা দেখলাম। জীবনের রঙিন দিনগুলোর মতোই খুব যত্ন নিয়ে লিখা হয়েছে এগুলো।পড়তে পড়তে জানতে পারলাম এরপর বাবা যে-ই মেয়েটিকে দেখতে গিয়েছিলেন;সেটি ছিলেন মূলত আমার মা। মাকে প্রথম দেখাতেই বাবার মনে ধরেছিল। তবে, মা প্রথমবারেই বিয়ের ক্ষেত্রে রাজি হননি। এরপর কয়েক পাতা সেই বিষয়ক বাবার দুঃখ, বেদনা সংমিলিত কিছু কথা ছিল। যেটিতে কিনা একজন হতাশাগ্রস্ত প্রেমিকের আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে।
তারপর অজ্ঞাত কারণে মা হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। এরপর থেকে ডায়েরিতে তাঁদের নিত্যদিনকার সংসারজনিত ঘটনাগুলোকেই পরপর ভাবে বাবা উল্লেখ করে গেছেন। প্রচন্ড রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার প্রকাশ ছিল সেখানেও। আরশান ভাইয়া এবং আমার জন্মকে কেন্দ্র করে বাবা ডায়েরীতে কতকিছুই না লিপিবদ্ধ করেছেন! আমার বুক অবাধ জলোচ্ছ্বাসে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো।
বারবার প্রশ্ন আসছিল মনে, এত সুখের নগরী রেখে মা কেন চলে গেলেন? বাবাকে কখনোই তাঁর ব্যাক্তি জীবনের কথা জিজ্ঞেস করার মতো দুঃসাহস আমার হয়ে ওঠেনি। মনে মনে বারবার প্রশ্ন আসলেও সেটা নিজে থেকেই এড়িয়ে গেছি। কখনোই জানতে চাইনি আমার মা কোথায়। হয়তো ছোট বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম যে জীবন আমার জন্য এতটা সুখের নয়। নিজের স্বভাব কৌতুহলীপনাকে দমাতে না পেরে আমি ডায়েরির পরের অংশ গুলো খুব মনোযোগ দিয়েই পড়ছিলাম। পরের অংশগুলোতে স্বাভাবিক দিনের উল্লেখ ছিল। কিন্তু আমি মনের অজান্তেই খেয়াল করলাম বাবার লিখার ধরণ গুলো হঠাৎ বদলাতে শুরু করেছে। লিখায় আগের মতো রুমঝুম ধারাটা বজায় নেই। আচ্ছা, ব্যাক্তি জীবনের কষ্ট কী লিখার ধরনেও প্রকাশ পায়?
বাবার জীবনের খারাপ অধ্যায়গুলোর টানাপোড়েন শুরু তখন। মা হঠাৎই বাবার কাছে বৈবাহিক জীবন থেকে মুক্তি চেয়ে বসেছিলেন। বাবা প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন তাঁর জীবনে সবই আছে শুধু স্বাধীনতা ছাড়া। তিনি সংসারের এই মায়াজালে আবদ্ধরত থাকতে চান না। তিনি চান শুধু মুক্তি। এই কথাগুলোই অত্যন্ত আবেগজনিত অক্ষরে লিখা ছিল। এই পৃষ্ঠার কাগজগুলোর রং কেমন ঝাপসা ঝাপসা আর খসখসে। বাবা হয়তো এই শোকের অনল মেনে নিতে পারেননি। চোখের পানিরকণা গুলোর সাক্ষী হয়তো এই কাগজগুলোই ছিল।
এরপরের অংশটা বাবা অত্যন্ত নিরশ, কাটখোট্টা ভঙ্গিতে লিখেছেন। ভাইয়ার আর আমার কাস্টাডি পেতে বাবা মন ও আইন দুটোর সঙ্গেই লড়ে গেছেন। ভাইয়াকে তিনি কাছে পাননি। আমাকে পেয়েছিলেন এটুকুই হয়তো তাঁর জীবনের শেষ প্রাপ্তি ছিল।
আমি যে দেখতে আমার মায়ের মতোন। সেই বিষয়টা আমি পছন্দ না করলেও বাবা কিন্তু করতেন। ডায়েরিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আমি আমার মায়ের মতো দেখতে বলেই তিনি একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন৷ আমার দিকে সেভাবে চোখে চোখ রেখে তাকাননি। এর কারণটা যদিও খুবই সোজা। আমাকে দেখলেই বাবার নিজের পুরনো প্রীতি সম্মিলনের কথা তথা আমার মায়ের কথা আমলে আসতো।
চলবে….