মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে #নুজহাত_আদিবা পর্ব ৮

0
299

#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮

এরপর ডাইরির অর্ধেক অংশজুড়ে ছিল শুধু আমার বেড়ে ওঠা, শৈশব থেকে কৈশোর এবং যৌবনে পা দেওয়ার মধ্যকার গল্প। এটুকু অংশ আমি প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। আমাকে যে কেউ এতটা ভালোবাসে এবং আমাকে এতটা ক্ষুদ্র ভাবে কেউ লক্ষ্য করেছে এটা আমার ধারণা জ্ঞানের বাইরে ছিল। আমি তো সবসময় সকলের ধ্যান জ্ঞানের বাইরে-ই ছিলাম। তবুও আমি বাবার এতটাই কাছের ছিলাম? সত্যি? বাবা তো কখনোই তাঁর মনের কথা আমার কাছল প্রকাশ করেননি। এতটা চাপা ছিলেন তিনি?

বাবা আমার কাষ্টাডি যখন পান তখন আমার বয়স তিন কী চার। অফিস করা তারপর আমাকে সামলানো খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না। তবুও বাবা কতটা যত্ন নিয়ে আমার খেয়াল রেখেছেন। বাবা! আমি যে মায়ের চেয়েও তোমার কাছে বেশি ঋনী। আমার ঋনের বোঝা কী এতটাই ছিল যে আমায় ফেলে এভাবে চলে গেলে?

শেষ কিছু পাতায় এসে আমি থামলাম। এই ডায়েরি পড়তে গিয়ে আমি এক বিন্দুও বিরক্তি অনুভব করিনি। কারণ, এটা যে আমার গল্প আমার পরিবারের গল্প। আমার সবকিছু, আমার পুরো জীবন এই ডায়েরীতে জড়িত। শেষ পাতাগুলোতে আমার লিখায় আগের মতো সেই উত্তেজনা আবার প্রকাশ পেয়েছে। নিরশ ভাবটা যে নেই তা লিখার ধরণেই প্রকাশিত। শেষ পাতায় বাবা লিখেছেন,

” আমার সারা জীবনে আমি ভেবেছি লাবণ্য তোমারই মতো বেলী। বেলী তুমি সংসার ধর্ম থেকে ছিটকে দূরে সরে গেছো। এক দফায় নয় বরং কয়েক দফায় তুমি বলেছিলে তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারো না।
মায়া তোমার ভেতরে নেই। যেহেতু লাবণ্য তোমার মতো দেখতে ;তাই আমি ভেবেছি সেও একই পথে চলবে। কিন্তু না, লাবণ্য কিন্তু তোমার মতো নয় বেলী। কালই সে প্রমান করেছে সে তোমার মতো নয়। এই যে স্বামীর প্রতি লাবণ্যর এত অভিমান, এত অভিযোগ! এটাতেই কী প্রমাণ হয় না লাবন্য তোমার মতো নয়?

আমি আমার সারাজীবন তোমাকে নিয়েই আঁটকে গেছি। কিন্তু, তুমি কী দারুণ ভাবে জীবনকে উপভোগ করেছো। আমার আর লাবণ্যর ভাগ্য কতটা একই তাই না? আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি আর লাবণ্য তাঁর মাকে। লাবণ্যকে সবসময় তোমারই ছায়া তোমারই প্রতিচ্ছবি মনে হয়েছে আমার। কিন্তু সে একদমই তোমার মতো নয়। তাঁর স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রতি তাঁর যথেষ্ট সম্মান, ভালোলাগা রয়েছে। অভিমান, অভিযোগ রয়েছে। আজকাল কয়টা সম্পর্কেই বা এই জিনিসটুকু আছে? স্বাধীনতা দিক থেকে এগিয়ে গেলেও তুমি জীবনের দিক থেকে তুমি পিছিয়ে গিয়েছো বেলী। তোমার জীবনে সব আছে কিন্তু ভালোবাসা, মায়ার কোনো সম্পর্ক কিংবা বন্ধন নেই। তুমি সত্যিই ব্যর্থ বেলী। এই দিকে তোমাকে ভালোবেসে আমি সবসময় সকল কিছুর উর্ধেই রয়েই গেলাম। এটাই আমার জীবনের সময় বড় সার্থকতা। আমি ভালোবাসতে জানি বেলী।”

ডায়েরীতে মায়ের উদ্দেশ্য লিখা এই শেষ অংশটুকু পড়ে আমার বুকের নিমিত্তে যতটুকু বেদনারা লুকিয়ে ছিল সব উপচে পড়লো। বাবা মারা যাওয়ার আগের দিন আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঘরে গিয়ে এটুকু লিখেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। বাবা আপনি কী জানেন, আপনার সারাটা জীবন আপনি একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসে গেছেন। এভাবে ভুল মানুষকে হৃদয় কেন দিলেন বাবা? আপনি তো সত্যিই মহান, একজনকে জীবনের শেষ অবধি ভালোবেসে গেছেন। আপনার তো তুলনাই হয় না। সবকিছু পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও এই পাওয়া ও হারানোর উপাখ্যানে আপনি চির বিজয়ী। কারণ আপনি ভালোবাসতে জানেন।
আর মা রইলো আপনার কথা আপনি বাস্তবিক অর্থেই একজন ব্যর্থ মানুষ। আপনার স্বাধীনতাই যে আপনার সবচেয়ে বড় পরাধীনতা সেটা কী আপনি জানেন? শেষ অবধি কিন্তু আপনার জীবনে শুধু স্বাধীনতাই রয়ে গেল। কোনো ভালোবাসার পিছুটান কিন্তু রইলো না। আপনি একা বড়ই একা!

তারপর বাবার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতরে জমাট বেঁধে রাখা কষ্টের ভার অনেকটাই কমে গিয়েছিল। নিজের মনের নির্দেশে বাবার কবরের ওপরে বেলী ফুলের গাছ পুঁতে রেখে এসেছিলাম। বাবা পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকাকালীন বুকে বেলীর স্মৃতিগাঁথা নিয়েই বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পরেও বেলীর অতুলনীয় নিযার্সে বেলীর পাপড়ির মতো অমলিনতায় ফুটে উঠুন। বেলীর শুভ্রতায় ছেঁয়ে থাকুন আপনি।

নিজের সাংসারিক জীবন থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছিলাম আমি। একের পর এক জীবনে এক ধাক্কা। সবকিছু সামলে উঠতেই আমার জীবনে আবার একটা বড় পরিবর্তন। দুপুরে মেহমেদের নিজের কাজের জন্য বের হচ্ছিলো। বের হওয়ার সময়েই তুমুল বৃষ্টি। দেরী হওয়ায় বেচারা বৃষ্টির ভেতরেই বেরিয়ে গেল। মাঝরাস্তায় গিয়েই আমার চিৎকার আমার দিকে ফিরি তাকালো মেহমেদ। বৃষ্টির পানি উপেক্ষা করে গিয়ে মেহমেদের কানে কানে ফিসফিস করে আমি বললাম,

” আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

মেহমেদ পিলে চমকে আমার দিকে তাকালো। চোখের উত্তেজনাই বলে দিচ্ছিলো সে ঠিক কতটা খুশি। এরপর তীব্র বৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও দুজন একসঙ্গে ভিজেছি। উপভোগ করেছি প্রকৃতির অশ্রুধারাকে। বৃষ্টির কনাগুলো যখন মেহমেদের গালবেয়ে, চোখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমি মনের সকল তৃষ্ণা মিটিয়ে তা দেখেছি। প্রিয় মেহমেদ এভাবেই আমার ভালোবাসাকে সবসময় গ্রহন করো। আমিও ঠিক এভাবেই তোমাকে ভালোবাসতে চাই।

আমার দেড় বছরের একটা ছোট মেয়ে আছে। সে আমায় তাঁর নিজের ভঙ্গিমায় কতকিছু বলে। আমার সঙ্গে তাঁর কত কথা! মেহমেদ সময় পেলেই চায়ের কাপ নিয়ে আমার পাশে বসে গল্প করে। আমার এই ক্লান্ত দৃষ্টিতে আমি যখন মেহমেদ এবং আমার মেয়ের দিকে তাকাই আমার মনে হয় এখানেই আমার সকল সুখ বরাদ্দ। পৃথিবী তুমি সত্যিই বড়ই মহান। আমার জীবনে এখন আর কোনো চাওয়া নেই৷ আমার অপ্রাপ্তিগুলোকে আমি মেনে নিয়েছি। এতকিছুর মাঝেও আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমি মেহমেদের মনে আমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পেরেছি। আর আমার সবচেয়ে বড় সার্থকতা আমি ভালোবাসতে পেরেছি। জীবন আমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছে। বিনিময়ে দিয়েছে তাঁর বহুগুন।

সমাপ্ত…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here